সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন
ওয়েব ডেস্ক: তদন্ত-সাক্ষ্য আর যুক্তিতর্ক; এই তিনের সমন্বয়ে দীর্ঘ যাত্রা। জুলাই গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলা এখন চূড়ান্ত সিঁড়িতে। রায় ঘোষণার পরই অপেক্ষা ঘুচবে দেশের মানুষের। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাজায় কিছুটা হলেও হাসি ফুটবে হাজারও শহীদ-আহত পরিবারের মুখে। এ রায় শুধু একক ব্যক্তির নয়, দেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসের বয়ান বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছাত্র-জনতার জোয়ারে চব্বিশের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। একই পথে হাঁটেন এ মামলার ‘অন্যতম কমান্ডার’ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গদি ছাড়তেই আওয়ামী লীগ সরকারের দোর্দণ্ড এই প্রতাপশালীদের বিরুদ্ধে দায়ের হয় অসংখ্য মামলা। দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, দুর্নীতি, গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন তারা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় আটকে গেলেন তাদেরই একজন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। নিজের হুকুমদাতাদের ছাড়াই জেলে যেতে হয় তাকে। যদিও রাজসাক্ষী হয়ে কপাল খোলার কিছুটা চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে এ মামলার রায় শুনছে গোটা বিশ্ব। সরাসরি দেখছে বিচারকাজও।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, আইসিটি বিডি মামলা নম্বর ২/২০২৫। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট শুরু হয় তদন্ত। একই বছরের ১৬ অক্টোবর মিস কেস ফাইল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। আর বাকি দুজনের নামে জারি হয় এর পরদিন। এর মধ্যে চলতি বছরের ১৬ মার্চ গ্রেপ্তার হন চৌধুরী মামুন। এরপর ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুন ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করে প্রসিকিউশন।
ফরমাল চার্জের সঙ্গে ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার দালিলিক সাক্ষ্য জমা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পত্র-পত্রিকা, দেশি ও আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন, শহীদ-আহতদের তালিকা সম্বলিত গেজেট, বই, স্মারকগ্রন্থ, ঘটনাস্থলভিত্তিক আন্দোলনে আহত-নিহতের তালিকা, গাল ও গ্রাফিতির বই, অভ্যুত্থানকালীন প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পাতা সম্বলিত বই, শহীদ ও আহতদের চিকিৎসা সনদ, পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল প্রতিবেদন, অস্ত্র ও বুলেট ব্যবহারের হিসাব সম্বলিত জিডি ও প্রতিবেদন, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল ইত্যাদি। ৯৩টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব দালিলিক সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। ৩২টি বস্তু প্রদর্শনীর মাধ্যমে অসংখ্য বুলেট, পিলেট, রক্তমাখা কাপড়, ভিডিও ও অডিও সম্বলিত ডিভিডি, পেনড্রাইভ, বই ইত্যাদি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৫৪ জন সাক্ষী হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি
চলতি বছরের ১ জুন আইসিটি বিডি কেস নম্বর ২/২০২৫ এর কার্যক্রম শুরু হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।পলাতক শেখ হাসিনা ও কামালকে গ্রেপ্তারে ১৭ জুন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। হাজির না হওয়ায় ২৪ জুন স্টেট ডিফেন্স হিসেবে আইনজীবী মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন নিয়ে শুনানি শুরু করে প্রসিকিউশন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ১০ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ওই দিনই নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এরপর ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। একই দিন জুলাই আন্দোলনে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণের জবানবন্দির মাধ্যমে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের সাক্ষে ৮ অক্টোবর সম্পন্ন হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
যুক্তিতর্ক শুরু হয় ১২ অক্টোবর। টানা ৯ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক পাল্টা যুক্তিখণ্ডন শেষে ২৩ অক্টোবর সমাপনী বক্তব্য দেন দেশের প্রধান আইন কর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ হয় ১৩ নভেম্বর। এরই ধারাবাহিকতায় আজ রায় ঘোষণা করা হবে।
শেখ হাসিনার মামলায় পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে প্রথমটি হলো উসকানি। গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন তিনি। ১৮ জুলাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাবেক এই সরকারপ্রধান। ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি হেলিকপ্টারে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন হাসিনা।
তার এমন প্রত্যক্ষ নির্দেশনার মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০০ ছাত্র-জনতা। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার আন্দোলনকারী। তৃতীয় অভিযোগটি হলো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা। আর চতুর্থ-পঞ্চম অভিযোগটি যথাক্রমে চানখারপুলে ছয় হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া। এই পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দাবি প্রসিকিউশনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী শহীদ-আহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
সব সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেছে প্রসিকিউশন। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে।