শিল্পকারখানা খোলা রেখে ব্যাংক বন্ধের ঘোষণা বাস্তবসম্মত নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা সরকারকে ব্যাংক বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। আর শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে এবং একইসঙ্গে ব্যাংক বন্ধ থাকলে গোটা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেক্ষেত্রে সব বিল এক মাসের জন্য স্থগিত রেখে ব্যাংক লেনদেন চালু রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ব্যাংক বন্ধের বিষয়ে মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও শিল্পোদ্যোক্তারা এ অভিমত প্রকাশ করেন।
গত সোমবার (১২ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফ সাইট সুপারভিশন থেকে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বুধবার (১৪ এপ্রিল) থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের দেয়া কঠোর লকডাউনে সব ব্যাংক বন্ধ থাকবে। লকডাউন চলাকালে ব্যাংকের শাখার পাশাপাশি আর্থিক সেবা দেয়া ব্যাংকের সকল উপ-শাখা, বুথ ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবাও বন্ধ থাকবে। তবে খোলা থাকবে এটিএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ অনলাইন সব সেবা।’
ওই সার্কুলারে আরও বলা হয়, ‘সরকার ঘোষিত বিধি-নিষেধ চলাকালে সাধারণভাবে সকল তফসিলি ব্যাংক বন্ধ থাকবে। এ সময়ে ব্যাংকের সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীকে নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। সমুদ্র/স্থল/বিমান বন্দর এলাকায় (পোর্ট ও কাস্টমস এলাকা) অবস্থিত ব্যাংকের শাখা/উপশাখা/ বুথসমূহ খোলা রাখার বিষয়ে বন্দর বা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
‘ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্ব স্ব ব্যাংক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সীমিতসংখ্যক জনবল দ্বারা খোলা রাখতে পারবে। এটিএম ও কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন চালু রাখার সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সহায়তায় এটিএম বুথগুলোতে পর্যাপ্ত নোট সরবরাহসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা সার্বক্ষণিক চালু রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক অ্যাখ্যা দিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর কথা বলছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের দাবি, ব্যাংক বন্ধ হলে অর্থনীতির সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও এরই মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কথা হয় গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শিল্পকারখানা খোলা রাখা মানে প্রত্যেকের ট্রানজেকশন প্রয়োজন। পণ্য আমদানি-পণ্য রফতানি সবই করতে অর্থের প্রয়োজন। তাহলে সে কীভাবে এটা করবে? আবার নিত্যপণ্যের দোকানি ১০/১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করল এখন সে টাকা কোথায় রাখবে?’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘শিল্প-কারখানা, কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা চালু রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে সরকারি প্রজ্ঞাপনে। এবার বলেন ব্যাংক বন্ধ থাকলে শিল্প-কারখানা কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা আছে কি-না? দেশের আর্থিকখাতের প্রধান ব্যাংক বন্ধ থাকলে আমদানি-রফতানিসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। সীমিত পরিসরে হলেও ব্যাংকিং লেনদেন সচল রাখা যেত।’
আহসান এইচ মনসুরের মতে, ব্যাংক বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। তার কাছে এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক মনে হয়েছে। সেজন্য এটা নিয়ে ভাবা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতি ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বাজার বন্ধ হতে পারে, কিন্তু ব্যাংক কীভাবে বন্ধ হয়, এটা আমার মাথায় আসে না। শিল্পকারখানায় অর্থের প্রয়োজন, সেখানে ব্যাংক বন্ধ হলে তাদের কী হবে। আবার এটিএম দিয়ে তো আর সব টাকা উত্তোলন করাও যাবে না। ব্যাংক বন্ধ করে এটিএম বুথ খোলা রাখা আরও বিপদ ডেকে আনা। এটিএম-এ বাটন প্রেস করার প্রয়োজন হয়, সংক্রমণের সম্ভাবনা সেখানেই বেশি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হয় ব্যাংক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত যুক্তিসম্মত হয়নি। এখনো সময় আছে, এ সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদলানোর। প্রয়োজনে এক-তৃতীয়াংশ কর্মী দিয়ে ব্যাংক চালানো যেতে পারে। ১৫ জনের মধ্যে আজ পাঁচ জন ব্যাংক লেনদেন করবে, দুই দিন পরে আবার তারা আসবে। আরও একটি কাজ করা যেত, সেটি হলো—অন্য সব বিল এক মাসের জন্য স্থগিত করে ব্যাংক লেনদেন চালু রাখা যায়।’
বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘লকডাউন দীর্ঘ সময় ধরে চললে এবং একই সময়ে ব্যাংক বন্ধ থাকলে শিল্পের জন্য ক্ষতি হবে। তবে সাময়িক হলে এর প্রভাব তেমন একটা পড়বে না।’