বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
মুখ্যমন্ত্রী নন, এবার শুভেন্দুর নিশানায় স্বয়ং প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে শাসক দলের বহু দুর্নীতি আড়াল করার অভিযোগও এনেছেন তিনি। জানিয়েছেন, আলাপনবাবু বহু বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফের দাবি জানিয়েছেন। যদিও আলাপন–অধ্যায়কে ‘সমাপ্ত’ বলে এদিন উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে।
বাংলার প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বুধবার রাজভবনে যান শুভেন্দু। সেখানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ জানান তিনি। রাজ্যপালের হাতে ভোট পরবর্তী হিংসার রিপোর্ট তুলে দেন তিনি। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, ভোটের ফল বের হওয়ার পর এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ২৭ জন বিজেপি কর্মী খুন হয়েছেন। অভিযুক্ত তৃণমূল। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সেই সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও নানা তথ্য দিয়ে অনেক অভিযোগ জানান।
এর পর রাজভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন শুভেন্দু। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যোগ দেননি। আসলে তিনি অনেক বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। তাই তাঁকে আড়াল করার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘গত বছর করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তখন মুখ্যমন্ত্রী এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গড়েছিলেন। সেই কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন আলাপনবাবুই।’ শুভেন্দু দাবি করেন, ‘বিরোধী দলনেতা হিসাবে আমি চাই, সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হোক, রাজ্য সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনুক।’
শুভেন্দু সরাসরি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে বলেন, ‘আসল কথা হল, অনেক বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আলাপনবাবু। তাঁর সঙ্গে শাসক দলের মধ্যে কোনও দূরত্ব ছিল না। এখনও নেই। সত্যি কথা বলতে কী, শাসক দলের সঙ্গে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই তাঁর সঙ্গে শাসক দলের বক্তব্য হুবহু মিলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, আলাপনবাবু নন, শাসক দলের কোনও নেতা কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন, কী করে একজন আধিকারিক এবং শাসক দল একই কথা একই সুরে বলেন? আধিকারিক থাকার সময় থেকে তিনি শাসক দলের সমস্ত দুর্নীতি, অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। সেইজন্যই তাঁকে আড়াল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল। না হলে দুর্নীতির ভয়ঙ্কর অভিযোগে অনেক রাঘব–বোয়ালই ফেঁসে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে ফেঁসে যেতে পারেন আলাপনবাবুও। তাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত অপমান করে চলেছেন তিনি। সেজন্য সংবিধানের রীতিনীতির বাইরে যেতেও কোনও দ্বিধা হচ্ছে না তঁার বা মুখ্যমন্ত্রীর।’
বুধবার শুভেন্দু এ ভাবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করায় বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের না থাকা নিয়ে প্রথমে শুভেন্দু আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেননি। বরং তাঁর প্রধান নিশানাই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে থাকতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছেন। এমন সব কথাও বলেছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু মঙ্গলবার থেকেই তঁার সুর বদলাতে শুরু হয়ে। সূত্রের খবর, সোমবার রাত থেকেই তাঁর কাছে আলাপনবাবু সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে আসে। তার পরই তাঁর বক্তব্য বদলে যায়। তাই মঙ্গলবার থেকেই তিনি আলাপনবাবুর দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেন। ওইদিন কেন্দ্রীয় সরকার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো–কজ করলে, তিনি কেন্দ্রের কাছে আলাপনের কড়া শাস্তি দাবি করেন। আর, বুধবার দুর্নীতিতে যুক্ত রয়েছেন বলে সরাসরি অভিযোগ করেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলাপন চ্যাপ্টার ওভার। তবে, তাঁর যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়, রাজ্য সরকার তাঁর পাশে থাকবে।’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে ‘চ্যাপ্টার ওভার’ বলা নিয়ে রাজ্য তথা জাতীয় স্তরেও জল্পনা শুরু হয়েছে। কারণ, এদিনই যেমন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে শুভেন্দু অধিকারী একরাশ অভিযোগ করে এসেছেন, তেমনই এদিনই আরও একটি তথ্য নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। কয়েক বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ডি লিট’ দেয়, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সম্পর্কে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। স্বভাবতই কেউ কেউ সেই বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
পাশাপাশি আরও একটি তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে এদিন। এতদিন মুখ্যমন্ত্রী বলে এসেছেন, পর্যবেক্ষণ বৈঠকের দিন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই তিনি নাকি দিঘা চলে যান। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ঠিক নয়। প্রধানমন্ত্রী এমন ধরনের কোনও অনুমতি মুখ্যমন্ত্রীকে সেদিন দেননি। তথ্যাভিজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সেইজন্যই মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে এখন ধামাচাপা দিয়ে দিতে চাইছেন? সেই সঙ্গে রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, এই বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে তিনি আর আগ্রহী নন। তাই তাঁকে এ বিষয়ে যাতে আর প্রশ্ন করা না হয়। আর সংবাদ মাধ্যম যেনও বিষয়টি থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়।
এই প্রসঙ্গে বিজেপির জাতীয় স্তরের এক নেতা কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘এ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়, পশ্চিমবাংলায় কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে!’