ওয়েব ডেস্ক: পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক সীমানার বহু অংশ এখনো বলতে গেলে অরক্ষিত। কাঁটাতার দিয়ে চিহ্নিত হয়নি বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার আর ভারতের সীমানা। দুর্গম কোনো কোনো সীমান্তে এখনো পৌঁছাতে পারেনি বিজিবিও। এর সুবিধা নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরাও নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করছে।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এখন সীমানা চিহ্নিত করে সড়ক নির্মাণ করছে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশান ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামছুল আলম বলেন, একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত সীমানা আমরা শুধু মানচিত্রে দেখেছি। সীমান্তে এখনো আমরা অনেক জায়গায় যাচ্ছি, যেখানে অতীতে কারও পদচিহ্ন পড়েনি। এখন আমার জায়গার মালিকানা আমি বুঝে নিচ্ছি। ভিনদেশের কেউ সহজেই বুঝতে পারবে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে দেশকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছি।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজে নেমে সেনা কর্মকর্তারা দেখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকা এতটাই দুর্গম যেখানে জানবাজি রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এর বাইরে হেলিকপ্টার ছাড়া বিকল্প কোনো যানবাহনে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে এসব এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই সমতলের জনগণের। ওই এলাকাগুলোতে নেই মোবাইলের নেটওয়ার্কও। এ কারণে দুর্গম পাহাড়ে অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যায় অনেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন বাসিন্দারা জানান, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতায় অতিষ্ঠ পাহাড়ের নিরস্ত্র বাসিন্দারা। যেকোনো সময় তারা নিজেদের লোকজনের বাসায়ও হানা দেয়। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য নিয়ে যায়। এর বাইরে তাদেরকে চাঁদা দেওয়া ছাড়া ব্যবসা করতে পারে না সমতলের বাসিন্দারাও। চাঁদা না দেওয়ায় অপহরণ এবং হত্যার শিকার হতে হচ্ছে অনেককে।
সেনা কর্মকর্তারা জানান, সড়ক নির্মাণের কাজের কারণে দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করছেন কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে পাহাড়ের বাসিন্দাদের। পাহাড়িদের নানা কাজে সহায়তা করছে সেনাবাহিনী। যোগাযোগ বাড়ার কারণে অপরাধীদের তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত ২৭ জুন সীমান্ত সড়ক বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীর একটি টিম সীমান্ত সড়ক পরিদর্শনে যায়। সেদিন বান্দরবানের থানচি উপজেলার বঙ্কুপাড়া এলাকায় জড়ো হয় দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দারা। তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী বাঁশি বাজিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের বরণ করে নেয় এবং সেনবাহিনী যাওয়ার খুশিতে একটি নৃত্যও পরিবেশন করে।
পাহাড়িদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে, এই দৃশ্য সেটির একটি উদাহরণ বলে মনে করেন সেনা কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর ১৭ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমরা পাহাড়িদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করি। নানা সময় ক্যাম্প থেকে পানি কিংবা খাবার দিয়ে সহযোগিতা করি। বিভিন্ন উৎসবে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের সম্পর্কে তাদের ধারণা একেবারেই পজিটিভ।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, অনেক সীমান্তে আগে বিজিবি ছিল না। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে বিজিবির টহল বেড়েছে। বহিঃশত্রুকে মোকাবিলায় সীমান্ত সড়ক হবে এখন প্রথম ঢাল। পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে কাজ করা যাবে বেশি। সড়কে নিয়মিত টহলের মাধ্যমে দেশের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দমনেও ভূমিকা রাখা যাবে।
সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের আওতাধীন ২০ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসিফ আহমেদ তানজিল বলেন, একসময় জেলা শহর কিংবা অন্য কোনো স্থানে অপরাধ করে দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা যেত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে তাদেরকে সহজে আইনের আওতায় আনতে পারত। কারণ, ওইসব এলাকায় হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। এখন যে এলাকায় সড়ক হচ্ছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কুইক রেসপন্স করতে পারছে। এ কারণে ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিশীলতা বেড়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারির সুযোগ পাচ্ছে তারা। বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা, ড্রোন নজরদারি এবং রেডিও কমিউনিকেশন ব্যবস্থার সমন্বয়ে একাধিক সংস্থা মিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হচ্ছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামছুল আলম বলেন, সীমান্তবর্তী অনেক এলাকায় বিজিবির ক্যাম্প ছিল না। এখন বিজিবি ক্যাম্প সড়কের পাশে অর্থাৎ সীমানার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে চোরাকারবারিদের দমনের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করতে পারছেন তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত সড়কটি অনেক আগেই আমাদের করা দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য ছিল না বলে পারিনি। এখন সুযোগ যেহেতু হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। এই বিস্তৃত সড়কটি হবে সীমান্তে বাংলাদেশের ঢাল। এটি দিয়ে চলাচল শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীরা নিজেদের গুটিয়ে নেবে। তারা এখন বাইরের শত্রুর সহায়তায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
সোর্স: ঢাকা পোস্ট