বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলেই থাকছেন। সৌগত রায়ের এই দাবির পর একদিনও কাটেনি। বুধবার বেলার দিকে তাঁর সমস্ত দাবিই এক কথায় খারিজ করে দিলেন পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী। উত্তর কলকাতায় মঙ্গলবার সন্ধ্যার ম্যারাথন বৈঠকে তাঁকে নিয়ে তৃণমূলে যে আশার প্রদীপ জ্বলেছিল, বুধবার দুপুরের অনেক আগেই সেই প্রদীপ নিভে যায় একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে। মেসেজটি করেছেন স্বয়ং শুভেন্দু। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়কে করা ওই মেসেজে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ‘তাঁর পক্ষে একসঙ্গে কাজ করা মুশকিল।’
সৌগত রায় তথা পশ্চিমবাংলার কিছু সংবাদ মাধ্যমের তরফে দাবি করা হয়েছিল, মঙ্গলবার তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক নাকি ইতিবাচক হয়েছে। বৈঠকে শুভেন্দু ও অভিষেকের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা বিতর্কিত প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। ছিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌগত রায়ও। বৈঠক চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ফোনে কথা হয় শুভেন্দুর। বৈঠক চলেছিল সাড়ে নটা পর্যন্ত। তার পরই সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌগত রায় বৈঠক নিয়ে সরাসরি কথা বলেন। দাবি করেন, সব নাকি মিটে গিয়েছে। তবে মঙ্গলবার রাতে বৈঠক নিয়ে মুখ খোলেননি শুভেন্দু। বরং কিছু সংবাদ মাধ্যমে যে ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়, তাতে ঘনিষ্ঠ মহলে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাংবাদিককে সংবাদ হিসেবে প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মুখ থেকে না কিছু শুনছেন, ততক্ষণ এইসব বাজারি সংবাদ উপেক্ষা করুন। বরং নিজের কাজ নিজে করুন।’ ফলে সৌগত রায় এবং এক শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমের দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয় মঙ্গলবার গভীর রাতেই।
ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায় বুধবার বেলা ১১টা নাগাদ। তখন তিনি সৌগত রায়কে মেসেজ করেন। তাতে লেখেন, ‘এখনও আমার বক্তব্যের কোনও সমাধান হয়নি। আর, সে সব না করেই আমার ওপর সব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। ৬ ডিসেম্বর আমার সাংবাদিক বৈঠকে সব কথা বলার কথা ছিল। তার আগেই সংবাদ মাধ্যমের কাছে সব কথা বলে দেওয়া হল। আপনাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা মুশকিল। আমাকে মাফ করবেন।’ জানা গিয়েছে, মঙ্গলবারের বৈঠকে দুই পক্ষ নিজেদের বক্তব্য পরস্পরকে জানিয়েছেন মাত্র। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি। তাই সৌগত রায়ের দাবি ঠিক নয় বলে তাঁর অভিমত। তিনি তৃণমূলেই থাকছেন, এমন কোনও কথা তিনি বলেননি। অথচ তা একতরফা ভাবে প্রচার করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সূত্রের খবর, বৈঠকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোর যে থাকবেন, তা তাঁকে আগে থেকে জানানো হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন, অন্য বৈঠকগুলির মতো মঙ্গলবারও সৌগত রায় এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবেন। কিন্তু অভিষেক এবং পিকে–কে দেখে নিজের অসন্তোষ গোপন রাখেননি তিনি। শুধু তাই নয়, বুধবার সকালে তাঁর অনুগামী নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। সকলকে জানিয়ে দেন, তাঁর সিদ্ধান্ত না জেনে কেউ যেন কোনও পদক্ষেপ না করেন।
এদিকে, শুভেন্দুর বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর তৃণমূল যেমন শুভেন্দু অধিকারীকে ধরে রাখার আশা এক প্রকার ছেড়েই দেয়, অন্যদিকে তেমনই বিপাকে পড়ে যান স্বয়ং সৌগত রায়। তিনিই আগাগোড়া ইতিবাচক দাবি করে আসছিলেন। মঙ্গলবারও জোর গলায় তিনি শুভেন্দুর তৃণমূলে থেকে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। বুধবার দুপুরে তাই কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে সৌগত বলেন, ‘কাল বৈঠকে যে কথাবার্তা হয়েছিল, তার এক বর্ণও আমি মিথ্যে বলিনি। ওই বৈঠকে শুভেন্দু ছাড়া আমরা চারজন উপস্থিত ছিলাম। এখন যদি তিনি মন পরিবর্তন করে থাকেন, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি তাঁরই। তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে জানাবেন।’ কিন্তু ফের কি বৈঠক হতে পারে? দলনেত্রীকে কি তিনি মেসেজ বা এই ব্যাপারে কিছু বলেছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সৌগত যে কথা বলেন, তাতে স্পষ্ট, শুভেন্দুকে ধরে রাখার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তৃণমূল। তিনি বলেন, ‘তিনি যদি মত বদলেই ফেলে থাকেন, তা হলে কথা বলে আর লাভ কী?’ অন্যদিকে, এদিন বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন শুভেন্দুর তীব্র সমালোচক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে এদিন তাঁর বক্তব্যে ধার ছিল না। তিনি বলেছেন, ‘খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল ইতিবাচক বৈঠকের কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। আসলে অধিকারী পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমাদের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করা। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখা।’ আগে শুভেন্দুকে তাঁর আক্রমণ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সব ঘটনার পোস্টমর্টেম নাই বা করলেন।’
শুভেন্দুর সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার পর তৃণমূলের নেতা ও কর্মীদের অনেকেই সৌগত রায়ের ওপর ক্ষুব্ধ। যদিও প্রকাশ্যে তাঁরা কেউই সৌগত রায়ের বিরুদ্ধে কোনও রকম মন্তব্য করেননি। তবে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় সরাসরি আক্রমণ শানিয়েছেন সৌগত রায়ের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, ‘সৌগত রায় দলে নিজের গুরুত্ব বাড়াতেই এইসব ভুলভাল কথা প্রচার করেছেন। আমি আগেই বলেছি, ভাইপোর মাফিয়াযোগ নিয়েই দলে মতপার্থক্য ও গোলমালের সৃষ্টি হয়েছে। সৌগত রায় সে সব বুঝতে চাননি।’ সৌগত রায়ের পাশাপাশি নাম না করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আক্রমণ করে তিনি। বলেন, ‘ভাইপোকে কিছু বলার সাহস তৃণমূলের কারও নেই। এমনকী পিসিও তাঁকে কিছু বলতে পারেন না। তৃণমূলের অভ্যন্তরে কী ঘটনা ঘটে চলছে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের সিনিয়র নেতারাও আজ তৃণমূলের ওপর বিরক্ত।’ উল্লেখ্য, কৈলাস বিজয়বর্গীয়ই একমাত্র নেতা, যিনি মঙ্গলবার রাতেই সৌগত রায়ের দাবি খারিজ করে দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বিতর্কের যে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন শুভেন্দু, তাতে মনে হয় না এত সহজে মীমাংসা সম্ভব।
এরই মধ্যে আবার বোমা ফাটিয়ে দিলেন তৃণমূলের আরেক নেতা। বুধবার এক সংক্ষিপ্ত ফেসবুকবার্তায় শীলভদ্র দত্ত লেখেন, ‘বন্ধু, আবার দেখা হবে।’ এই বার্তাকে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মনে করা হচ্ছে, তাঁর এই বার্তার উদ্দেশ্য শুভেন্দু অধিকারী। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে শুভেন্দু অধিকারী কি বিজেপিতেই যোগ দিচ্ছেন? সেখানেই কি যাচ্ছেন শীলভদ্র দত্ত? তাই কি দু’জনের দেখা হওয়ার কথা বলেছেন তিনি? যদিও এর পরিষ্কার জবাব এদিন পাওয়া যায়নি শীলভদ্রের তরফে। তবে, এদিন সকালে শীলভদ্র দত্তের মানভঞ্জন করার জন্য তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কিন্তু সেই সময় শীলভদ্র বাড়িতে ছিলেন না। তাই দু’জনের দেখা হয়নি। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন, এলে কী হবে? তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি আর তৃণমূলে থাকছেন না।
শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে মুখ খুলেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়ও। কোনও রাখঢাক না করে তিনি বলেছেন, ‘শুভেন্দু আমাদের দলে এলে ভালো হবে। দল মজবুত হবে। দলের ভোটব্যাঙ্কও শক্তিশালী হবে। খাতায় কলমে এখনও তৃণমূলের বিধায়ক শুভেন্দু। তাই এখনই সব বলা ঠিক হবে না। তবে শুভেন্দু বিজেপিতে এলে তাঁকে স্বাগত জানানো হবে।’ এ ছাড়াও তিনি বলেন, ‘শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আমার অনেক দিনের সম্পর্ক। অনেক কাছ থেকে তাকে দেখেছি। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেন। অনেক সভা–সমাবেশে আমরা একসঙ্গে উপস্থিত থেকেছি। তাঁর অনুগামী কর্মী–সমর্থকরা যে কোনও দলের পক্ষেই সম্পদ। শুভেন্দুকে তাঁরাও ভালবাসেন।’