বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: এবার বিমান লিজ নিতে উদ্যোগী হয়েছে পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকার। আর সেই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই তীব্র কটাক্ষ করলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম না করে তাঁকে তিনি ‘স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, পুষ্পক রথে চড়বেন।
রাজ্যের তৃণমূল সরকার একটি বিমান তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিতে চায়। সেজন্য ই–টেন্ডারও দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। সেই ই–টেন্ডার থেকে জানা গিয়েছে, ওই বিমানটিকে কমপক্ষে আট থেকে দশ আসনের এয়ারক্রাফট হতে হবে। সূত্রের খবর, জাতীয় দলের মর্যাদা পেতে এবার বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দেবে তৃণমূল। এমনকী, লোকসভা নির্বাচনেও ভিনরাজ্যে প্রার্থী দিতে পারে তৃণমূল। আর তাই সেই রাজ্যগুলিতে প্রচারে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। এ ছাড়া বিজেপি–বিরোধী বিভিন্ন দলের প্রচারেও তিনি অংশ নেবেন বলে বিরোধী দলগুলিকে জানিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে রাজ্য থেকে দ্রুত যাতায়াতের জন্য সরকারের একটি বিমান প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্বয়ং দলনেত্রী। সাধারণত দেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সুরক্ষিত বিমান থাকে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তেমন উদাহরণ বিশেষ নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে জলঘোলা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্যে সেই ইঙ্গিতই এদিন পাওয়া গিয়েছে।
রাজ্যের বিমান লিজ নেওয়ার উদ্যোগে বিরক্ত শুভেন্দু অধিকারী বুধবার টুইট করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেই কটাক্ষ করেন। নাম না করে তাঁর প্রতি রীতিমতো শ্লেষ ঝরিয়ে তিনি লেখেন, ‘সাধারণ মানুষ যখন ভুয়ো টিকা নিয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত্র, তখন (স্বঘোষিত) প্রধানমন্ত্রীর জন্য আসছে পুষ্পক রথ! এবার হেলিকপ্টারের বদলে ১০ আসনের বিলাসবহুল বিমান নিচ্ছে রাজ্য। কিন্তু হঠাৎ এমন বিমান লিজ নেওয়ার কারণ কী? সারাদেশে সরকারি খরচে লোকসভা ভোটের প্রচার করাটাই কি আসল উদ্দেশ্য?’ টুইটের সঙ্গে তিনি ই–টেন্ডারের একটি নথিও যুক্ত করে দেন। উল্লেখ্য, নথিটি ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেপলমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডের টেন্ডার সংক্রান্ত। শুভেন্দুর টুইট প্রকাশ্যে আসতেই পাল্টা মুখ খুলেছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও। তিনি বলেছেন, ‘এমন বিমান থাকা তো রাজ্যের পক্ষে গর্বের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর জন্য যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিমান কেনা হয়, তা নিয়ে আগে কথা বলুক বিজেপি।’
কিন্তু কথা হল, দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গুরুত্ব, মান ও মর্যাদায় সম–স্থানে পড়েন না। তাই দু’জনের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় পুরোপুরি আলাদা। তাই রাজ্যের বিমান লিজ নেওয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিমান থাকার বিষয়টি মোটেও এক নয় বলেই মত তথ্যাভিজ্ঞ মহলের। তাদের মতে, সৌগতবাবুর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, বিমানটি লিজ নেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই। ফলে নিজের অজান্তেই তিনি রাজ্যের বিরোধী দলগুলির সামনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ করে দিলেন। তা ছাড়া অনেক দিন আগে থেকেই বিজেপির তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য অভিযোগ করা হয়ে থাকে, তিনি নাকি পশ্চিমবাংলাকে আলাদা দেশ ভাবেন। আর নিজেকে ভাবেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য এবং আচরণে সেই প্রমাণই বারবার উঠে আসে বলে বিজেপির রাজ্য নেতারা বহুবার অভিযোগ করেছেন। এদিন রাজ্যের বিমান লিজ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্যেও সেই অভিযোগই নতুন করে তোলা হয়েছে।
এদিনই রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেছেন, ‘রাজ্যে গণতন্ত্র বলে কিছুই আর নেই। না হলে মুখ্যমন্ত্রী যে সব আচরণ করেন এবং কথাবার্তা বলেন, তার প্রতিবাদ করতেন অনেকেই। কিন্তু মাননীয়ার রোষানলে পড়তে হবে বলে আতঙ্কে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেন না।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, ‘কথায় কথায় মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলেন। আর অতিসরলীকরণ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অর্থ করে দিয়েছেন অনেকগুলি রাষ্ট্র মিলে একটি দেশ। আমাদের দেশও তাই অনেকগুলি রাষ্ট্র মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। তাই তাঁর কাছে পশ্চিমবাংলাও একটি রাষ্ট্র। আর সেই রাষ্ট্রের প্রধান হলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী পদ যেহেতু চিহ্নিত, তাই সেটি আর পরিবর্তিত করতে পারছেন না। কিন্তু নিজেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীই ভাবেন।’ ওই নেতা আরও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বলতে যা বোঝায়, তার মধ্যে এমন ভাবনা যে একেবারে ভুল, তা হয়তো নয়। তবে তার মধ্যে অনেক সাংবিধানিক কার্যকারণ সম্পর্ক এবং শর্তাদি রয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয় সে–সব জানেন না, নতুন জানলেও তা স্বীকার করেন না।
ওই নেতার বক্তব্য, আর সেইজন্যই তিনি রাজ্যের সাধারণ মানুষের করের টাকায় নিজের জন্য বিমান কিনতে উদ্যোগী হয়েছেন। সেই করের টাকাই ক্রমাগত খরচ করে তিনি বিভিন্ন রাজ্যে দলীয় প্রচারে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নিজের জন্য নির্দিষ্ট সরকারি বিমানে পশ্চিমবাংলায় বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি যদি যাত্রীবাহী সাধারণ বিমানে রাজ্যে প্রচারে আসতেন, সেটা কি ঠিক হত? নাকি সেটা সম্ভব? ওই নেতার কথায়, ‘আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে–সব বোঝেন না। বুঝতে চানও না। তাই তাঁকে বোঝানো যাবে না। তিনি নিজেকে সবজান্তা মনে করেন।’