1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  4. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  5. shanto.hasan000@gmail.com : রাকিবুল হাসান শান্ত : রাকিবুল হাসান শান্ত
  6. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  7. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  8. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :

স্বপ্ন শূন্যতা এবং: উপমন্যু রায় (পর্ব-০৩)

  • Update Time : শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২
  • ৭২৪ Time View

স্বপ্ন শূন্যতা এবং
‌(‌পর্ব ০৩)‌

উপমন্যু রায়

তিন

কুশলের খুব মন খারাপ আজ। কেন যে খারাপ, সে জানে না।
তবে, এমন মন খারাপ তার মাঝে মাঝেই হয়। কোনও বারই সে এমন মন খারাপের অর্থ বা কারণ, কিছুই খুঁজে পায়নি। প্রকৃতির মতোই যেন তার মনের আকাশে হঠাৎ হঠাৎই মেঘ জমে ভার হয়ে আসে, বৃষ্টির অপেক্ষা করে। তবে প্রকৃতির সঙ্গে তার মনের তফাত এইটুকুই যে, প্রকৃতিতে বৃষ্টি এসে সমস্ত কিছু নির্মল ও মুক্ত করে দেয়। কিন্তু, কুশলের মনে বৃষ্টি আসে না। তার মন ভিজিয়ে দেয় না। কেবল গুমরে ওঠে। গুরগুর করে।
কুশল তবু অপেক্ষা করে। ভাবে, হয়তো এবার বৃষ্টি হবে। কিন্তু, বৃষ্টি আর হয় না।
কুশল বিছানায় একা বসেছিল। টিউশনি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, ছাত্রের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। সে নাকি বন্ধুদের সঙ্গে ঝাড়গ্রাম ঘুরতে গিয়েছে। দু’দিন পর ফিরবে। তাই আজ তাকে পড়াতে যেতে হবে না।
এই একটি ছেলেই একা পড়ে তার কাছে। বিনিময়ে মাসে বারোশো টাকা। বড়লোকের ছেলে। তার বাবার দাবি মেনে তাকে একাই পড়ায় কুশল। নতুবা সে গ্রুপ হিসেবে পড়িয়ে থাকে।
এখন তার আরও দুটি ব্যাচ আছে। একটি ব্যাচে চারজন। অপর ব্যাচে পাঁচজন। চারশো করে দুটি ব্যাচ থেকে সে পায় প্রায় তিন হাজার ছশো টাকা। তিন ব্যাচ থেকে মাসে চার হাজার আটশো টাকা।
এখন টিউশনির বাজার খুব একটা নেই। পাঁচ বছর আগেও সে আরও তিনটে ব্যাচ পড়াত। তবে এখনও পর্যন্ত তার টিউশনির সেরা সময় এমএ পাশ করার পর। সেই সময় সে আটটা ব্যাচও পড়িয়েছে।
তখন টিউশনির জন্য বাবা–মায়েরা বেকার ছেলেমেয়েদের ডাকতেন। পরে ধীরে ধীরে সেই সুযোগ কমতে থাকে। এখন তো প্রায় কেউ ডাকেনই না। এখন বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই স্কুলের শিক্ষক–শিক্ষিকাদের কাছে পড়ে।
তা ছাড়া কলকাতায়, বিশেষ করে উত্তর কলকাতায় বাঙালির সংখ্যা একেবারে কমে গিয়েছে। আর, বাংলা নিয়েও কলকাতায় তেমন কেউ বোধ হয় আর পড়ে না। তাই তার ছাত্রছাত্রী কমতে কমতে আজ দশে দাঁড়িয়েছে।
মাসে মাত্র চার হাজার আটশো!‌ এই টাকা দিয়েই তার আর মায়ের সংসার চলে। এর বাইরে মোবাইলের খরচও আছে। তার ও মায়ের দুটি মোবাইল। মায়ের মোবাইলে মাসে একবার টাকা ভরে। মা সাধারণত খুব প্রয়োজন না পড়লে ফোন করেন না। তবে বাড়ির বাইরে থাকার সময় সে ফোন করে মায়ের খবর নেয়।
তা ছাড়া যযাতিদা এবং ছাত্রদের সঙ্গেও প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে হয় তাকে। তবে কারও সঙ্গে ফোনে গল্প করে না। সে জানে, মোবাইলে কারও সঙ্গে গল্প করা তার কাছে একটা বিলাসিতাই। তাই তার মোবাইলের পিছনে মাসে মোটামুটি একটা খরচ হয়। এর বাইরে আছে কেবল টিভির ভাড়া। অবসর সময়ে মা টিভি দেখেন।
এ ভাবে চার হাজার আটশো টাকায় সে আজকের দিনেও সংসার চালায়! এ কথা কেউ জানতে পারলে চোখ কপালে তুলবে। নিজের রোজগারের কথা মাথায় এলেই তার মনে পড়ে যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর লেখা একটা কবিতা। তিনি রসিকতা করে একবার লিখেছিলেন, ‘‘সবাই টাকার বশ, টাকাতেই যত রস। টাকা যার তার বশ, ব্যাপ্ত হয় দিক দশ, ধনরূপ মদের গন্ধে ত্রিভুবন ভরেছে।’’
টাকার যে কী মূল্য, তা সে জানে। জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। যে টাকা সে রোজগার করে, তা দিয়ে যে আজকের দিনে কিছুই করা যায় না, তা তার চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝবে না! কিন্তু, যযাতিদা তো জানেন কুশলের এমন আর্থিক অবস্থার কথা। তা হলে কী করে যে তিনি তাঁকে বিয়ে করতে বলেন, কে জানে!
চারটে বাজে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল কুশল। দুপুরের খাবার খেয়ে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘লোটাকম্বল’ বইটা নিয়ে বিছানায় গিয়েছিল। সে কোনও দিনই দুপুরে ঘুমোয় না। সেই অভ্যাস তার নেই।
পাজামা খুলে প্যান্ট পরল। তার পর জামায় শরীর গলিয়ে ব্যাগে কিছু প্রুফের কাগজ আর হিসেব লেখা পকেট ডায়েরি ঢুকিয়ে পাশের ঘরে গেল। মা টিভি দেখছিলেন। মাকে সে বলল, ‘‘মা, একটু বের হচ্ছি।’’
মা জানতে চাইলেন, ‘‘পড়াতে যাচ্ছিস?’’
সে বলল, ‘‘না। সন্তু ঘুরতে গেছে। তাই আজ ওকে পড়াতে যেতে হবে না।’’
মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তা হলে কোথায় যাবি?’’
সে বলল, ‘‘প্রেসে। কিছু কাজ আছে।’’
মা ফের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ফিরবি কখন?’’
সে জবাব দেয়, ‘‘সন্ধের একটু পরেই।’’
মা হাসিমুখে বললেন, ‘‘তোর যযাতিদার কাছে যাবি না?’’
হাসে সে–ও। বলল, ‘‘না। আজ আর যাব না।’’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল কুশল। হেঁটেই চলে এলো শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। এখানেই সুজনদার প্রেস। কুশলকে দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কী ব্যাপার কুশল? আজ তো তোমার আসার কথা নয়!’’
কুশলও হেসে জবাব দিল, ‘‘হ্যাঁ। আসলে আজ আমার টিউশনি নেই। তাই ভাবলাম আপনার কাছ থেকে একটু ঘুরে যাই। আর দেখা প্রুফগুলিও আপনাকে ফেরত দিয়ে আসি।’’
সুজনদা হেসে বললেন, ‘‘ভালোই হল।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘আর হ্যাঁ, তুমি তো এখন ফ্রি।’’
মাথা নেড়ে কুশল বলল, ‘‘হ্যাঁ।’’
সুজনদা বললেন, ‘‘কয়েকটা আর্জেন্ট প্রুফ আছে। দেখে দেবে?’’
কুশল বলল, ‘‘নিশ্চয়ই।’’
সুজনদা প্রেসের এক কর্মীকে ডেকে বললেন, ‘‘ওকে নতুন বইটার প্রুফগুলো দিয়ে দিন।’’ তার পর কুশলকে বললেন, ‘‘দেখা হয়ে গেলে ফেরার পথে হিসেব করে তোমার সব টাকা নিয়ে যেও।’’
কুশল হাসিমুকে মাথা নেড়ে ওই কর্মীর পিছু পিছু পাশের ঘরে গেল।
…সাতটা নাগাদ প্রুফ দেখা শেষ হল কুশলের। সব গুছিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরাল। চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে একটু আরাম করে বসে সিগারেট টানতে লাগল। সিগারেট টানা শেষ হলে সুজনদার ঘরে গেল।
কিন্তু সুজনদা নেই। ঘরে একজন বসেছিল। সে বলল, ‘‘একটু বেরিয়েছেন। চলে আসবেন। প্রেস তো বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। মনে হয় না সুজনদার আসতে আর বেশি দেরি হবে।’’
সুজনদার ঘরের বাইরে বারান্দায় একটি চেয়ারে গিয়ে বসল কুশল। অপেক্ষা করতে লাগল তাঁর জন্য। কিন্তু চুপ করে কতক্ষণই বা বসে থাকা যায়!
প্রেসের এক কর্মীর কাছ থেকে খবরের কাগজ চেয়ে নিল। তার পর ফের নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। একটা একটা করে পাতা ওলটাতে লাগল। সকালের কাগজ সাধারণত বিকেলে কেউ পড়ে না। আর কুশল অনেকদিনই খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছে। কারণ, খবরের কাগজ পড়তে তার ভালো লাগে না।
আগে পড়ত। যখন কলেজে পড়ত, তখন সকাল হলেই সেদিনের কাগজ দেখার জন্য মন আনচান করে উঠত। এখন আর করে না। কারণ যযাতিদা। হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রেও দায়ী যযাতিদা।
তিনিই প্রথম কাগজের চরিত্রটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। আমাদের দেশের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার খবরের কাগজগুলোকে যে ‘সংবাদপত্র’ বলা হয়, ইংরেজিতে যাকে ‘নিউজ পেপার’ বলে, বাংলায় সেই অর্থে কোনও ‘নিউজ পেপার’ নেই।
যযাতিদা বলেছিলেন, ‘‘নিউজ বানান কী? এন ই ডবলিউ এস। এন মানে নর্থ, ই মানে ইস্ট, ডবলিউ মানে ওয়েস্ট আর এস দিয়ে সাউথ। মানে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম— সমস্ত দিকের খবর থাকবে যে কাগজে, সেটাই হল সংবাদপত্র।’’
চমৎকার ছিল যযাতিদার কথাগুলো। কিন্তু, তখন পরিষ্কার বুঝতে পারেনি কুশল। তাই বলেছিল, ‘‘তাতে কী হল?’’
যযাতিদা হেসে বলেছিলেন, ‘‘হল না? খবরের মানে তো বললাম। কিন্তু, খবরে কী থাকবে? সেখানে থাকবে পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর। খবরটাকে যদি প্রশ্ন করিস, কে বলেছে? কাকে বলেছে? কী বলেছে? কোথায় বলেছে? কখন বলেছে? —সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি। মানে, ইংরেজিতে পাঁচটা ডবলিউর উত্তর পাবি। এগুলি হল হু, হুম, হোয়াট, হোয়্যার এবং হোয়েন। এখন তুই আমাকে বল, এখানকার কাগজগুলি পড়ে কি এই পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিক পাস?’’ একটু থেমে নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, ‘‘পাস না। বদলে পাবি গাঁজাখুরি সব গল্প। আবার সেই গল্পও ভারি অদ্ভুত। দেখবি একটাই গল্প এক–একটা পেপারে এক–এক রকম। কয়েকটা পেপার যদি এক সঙ্গে পড়িস, তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। নিজেই সমস্যায় পড়বি কোন পেপারের গল্পটা বিশ্বাস করবি ভেবে!’’
কুশল বলেছিল, ‘‘কিন্তু আমাদের দেশে তো গণতন্ত্র আছে!’’
যযাতিদা বলেছিলেন, ‘‘হুম, —গণতন্ত্র! কিন্তু, কী রকম সেই গণতন্ত্র? লক্ষ্য করে দেখবি, একই খবর একটা কাগজে পজিটিভ অ্যাঙ্গেলে লেখা হয়েছে তো অন্য কাগজ সেই খবরটাই নেগেটিভ অ্যাঙ্গেলে লিখেছে। কোনটা বিশ্বাস করবি? জানি বলবি, গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী, পাঠক কী গ্রহণ করবে, আর কী করবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের হাতেই ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। পাঠক যে কাগজের খবর গ্রহণযোগ্য মনে করবে, সেই কাগজই কিনবে। একদম ঠিক কথা, কিন্তু, সমস্যা কী জানিস? খবরের নামে কাগজগুলি যে সব গল্প লেখে, আর বিভিন্ন কাগজ অনুযায়ী তার মূল কথা বদলে যায়, তাকেই বা কী ভাবে ব্যাখ্যা করবি? সত্যি বলতে কী, এটা পাঠকের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা! হ্যাঁ, প্রতারণাই। গণতন্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে তো প্রতারণাকে সমর্থন করা যায় না!’’
কুশলের কাছে তখনই ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়।
যযাতিদা আরও বলেছিলেন, ‘‘এখন তো সংবাদ মাধ্যমগুলিরও একটা রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকে। ফলে নিজেদের বিরোধী রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করে। সব সময় তার ভুল খুঁজে বেড়ায়। না হলে মিথ্যা সংবাদই প্রকাশ করে দেয়। ন্যায়–অন্যায়ের ধার ধারে না। সেইজন্য এখানকার কাগজগুলিকে নিউজ পেপার নয়, বলা ভালো ভিউজ পেপার। তবু যদি ভিউজটা ঠিক–ঠাক হত! সেই ভিউজে সততা থাকত! কিন্তু, এই ভিউজও ঠিক নয়। স্বার্থ আর অভিসন্ধিও থাকে সেই ভিউজে। সেই ভিউজ দিতে গিয়ে ইয়েলো জার্নালিজমেও কাগজগুলি দ্বিধা করে না। প্রয়োজনে পেইড নিউজও প্রকাশ করে।’’
যযাতিদার সৌজন্যে সংবাদ মাধ্যম যেন কুশলের কাছে একেবারে নগ্ন হয়ে গিয়েছিল।
যযাতিদা কিন্তু সেখানেই থেমে যাননি। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘আর একটা ব্যাপার আছে। তা হল, কাগজগুলি কোটি কোটি টাকা খরচ করে অফিস খুলেছে। শুধু জনসেবা করার জন্যই তো তারা পত্রিকা অফিস খোলেনি, খুলেছে ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু, এই ব্যবসাটা কী রকম জানিস? —মনে রাখবি, এই ব্যবসা দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ব্যবসা থেকে লাভ করা খুবই কঠিন। ব্যবসাটার সাধারণ নিয়ম হল, আমি পাঠককে খবর দেব, আর পাঠক সেই খবরের জন্য কাগজ কিনবে। এটাই ব্যবসা। কিন্তু, আসল কথা হল, শুধু কাগজ বিক্রি থেকেই এই ব্যবসা চলে না। কারণ, কাগজ বের করতে যে বিপুল খরচ হয়, সেই খরচ পোষানো যায় না শুধু কাগজ বিক্রি করে। তাই প্রয়োজন বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে মোটা টাকার বিজ্ঞাপন।’’
যযাতিদার কাছেই কুশল জেনেছিল বিজ্ঞাপনের জন্য কাগজগুলির চরিত্র বিক্রি হয়ে যাওয়ার খবর। অনেকটা যেন টাকার জন্য নারীর নিজের সম্মান বিক্রি করে দেওয়ার মতো। একটা উদাহরণ দিয়ে যযাতিদা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। বলেছিলেন, ‘‘তোর বা আমার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের ওপর কাগজ চলে না। তবে এ ভাবে আসা টাকাটা তাদের কাজে লাগে। অতিরিক্ত আয় বলতে পারিস। তারা নির্ভর করে বড় বড় শিল্প বা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপনের ওপর। তাই তারা এমন কোনও খবর প্রকাশ করবে না, যা ওই সংস্থাগুলির ব্যবসার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে, তা— সেই ব্যবসা যতই নীতিহীন বা অন্যায় হোক না কেন! কিছুদিন আগে একটি বহুজাতিক পানীয় সংস্থার একটা খবর প্রচারে এনেছিলেন এক সমাজকর্মী। দু–একটি মাঝারি মাপের কাগজ প্রথমে তা প্রকাশ করলেও পরে চেপে যায়। আর বড় কাগজগুলি তো সেই খবরকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি। খবরটা কী জানিস? খবরটা ছিল তাদের পানীয় উৎপাদনের ভিতরের ব্যাপার সংক্রান্ত। রীতিমতো নোংরা জলই পানীয় তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। সেই জলে আবার মরা ইঁদুর, সাপও মাঝেমাঝে পাওয়া যায়। —ভেবে দ্যাখ অবস্থাটা! প্রশ্ন উঠেছিল, টাকা দিয়ে যে ঠান্ডা পানীয় আমরা গরমের সময় তৃপ্তির সঙ্গে পান করি, তা সত্যিই কতখানি সুপেয়?’’
কুশলের কিছু বলার ছিল না। কারণ, ভয়ঙ্কর সত্য বলেছিলেন যযাতিদা। কে জানে সত্য হয়তো এমন ভয়ঙ্করই হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘এই সেদিনও এমনই একটা খবর একটা মাঝারি মাপের প্রচারিত কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এখন তো আমরা আবার খাবার জলও কিনে খাই! বিভিন্ন সংস্থা বোতলে জল ভরে বিক্রি করে। কিছুদিন আগে বাজারে বিক্রি হওয়া এই রকম একটি বড় বোতলে একটা মরা টিকটিকি পাওয়া গিয়েছে! ব্যাপারটা কী ভয়াবহ, কল্পনা করতে পারিস? সাধারণ বুদ্ধি কী বলে? টিকটিকি নিশ্চয়ই ওই বোতলে ছিল না? যে জায়গায় জল রাখা ছিল, তাতে ছিল। সেই জল যখন বোতলে ভরা হয়েছে, সেখান থেকে টিকটিকিটা বোতলে চলে এসেছে। তা হলে যত বোতলে ওই জল ভরা হয়েছে, সমস্ত বোতলের জলই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে! কিন্তু, সেই খবরটা নিয়ে বেশি জল ঘোলা হওয়ার আগেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওই কাগজ ব্যাপারটা চেপে যায়। আর অন্য কাগজগুলি তো সেই খবরকে পাত্তাই দেয়নি!’’
এমন কথা শুনলে সকলেরই মন খারাপ হয়ে যাবে। কুশলেরও হয়েছিল। তবে যযাতিদা একটু হেসে বলেছিলেন, ‘‘তবে আশ্চর্য কী দ্যাখ, ওই বিষাক্ত জল খেয়ে কেউ অসুস্থ হয়েছে কিনা, তা কিন্তু আমরা জানতে পারিনি। দু–একজন হয়ে থাকলেও থাকতে পারে। সে–সব খবর ছাপার দরকার মনে করেনি কাগজগুলি। অথবা, সেই খবরগুলি সংগ্রহের চেষ্টাও করেনি। তা হলে কী করে এই আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলির ওপর ভরসা করব বল তো? আর, তা ছাড়া আমাদের দেশটা তো ছোট নয়। তাই কে, কোথায় ওই জল খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে, তার খোঁজ কে আর রাখবে! তবে‌ গণহারে শরীর খারাপ বোধ হয় হয়নি। হলে নিশ্চয়ই আমরা খবর পেতাম। আসলে কী জানিস?’’ মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘‘ভেজাল খেতে খেতে আমরাও বোধ হয় ভেজাল হয়ে গিয়েছি! তাই বিষও আমরা হজম করে ফেলি! বরং আমার মনে হয়, স্বাস্থ্যকর খাবারই আমাদের সহ্য হবে না!’’ বলেছিলেন, ‘‘আমরা হলাম ভেজাল দেশের মানুষ!’’
এর পরও কুশল অনেক দিন কাগজ পড়েছে। টিভি চ্যানেলের খবর দেখেছে। যযাতিদার কথা মিলিয়ে দেখেছে, তিনি একদম ঠিক বলেছেন। তার পরই খবরের কাগজ পড়া সে একেবারে ছেড়ে দেয়। টিভি চ্যানেলের খবরও আর দেখে না। তথাকথিত দেশ, সমাজ, সময় বা রাজনীতির খবর না জেনেও সে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। অসুবিধে হচ্ছে না!
টিভি দেখলে দ্যাখে বড়জোর ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বা হিস্টরি চ্যানেল। বাড়িতে টিভি বেশির ভাগ সময় দেখেন মা–ই। টিভি দেখাই মায়ের একমাত্র বিনোদন। সে কিন্তু গল্পের বই পড়ে। সে–জন্য কেউ যদি তাকে অ–জ্ঞান বলে, তাতে তার কোনও আক্ষেপ নেই। আজকাল তো গল্পের বই অকর্মণ্য এবং অলস ব্যক্তিরাই পড়ে বলে অনেকে বলে থাকেন!
এখন কুশলের মনে হয়, আমাদের দেশের কাগজ পড়ে পণ্ডিত বা জ্ঞানী হওয়ার চাইতে মূর্খ থাকা অনেক ভালো। আমাদের বাঙালি সমাজ অবশ্য এমন কথা স্বীকার করবে না। তবে— অনেকে অবশ্য বাঙালিকে সচেতন জাতি বলে থাকেন। কিন্তু, অপ্রিয় সত্যি হল, বাঙালি কাগুজে সচেতন। কাগজ পড়েই সে পণ্ডিত। আর সেই পণ্ডিত হতে গিয়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পিছতে পিছতে অন্যের করুণার পাত্র হয়ে গিয়েছে! হ্যাঁ, এটাই সত্যি। ভয়ঙ্কর সত্যি!
আর, ভাবা হল না। সুজনদা চলে এসেছেন। কাগজটা সরিয়ে রেখে তাঁকে অনুসরণ করল সে। ঘরে ঢুকে সুজনদা বললেন, ‘‘এসো, তোমার হিসেবটা করে ফেলি।’’
সুজনদার সঙ্গে তাঁর ঘরে ঢুকল কুশলও।
সুজনদা একটা খাতা বের করলেন। তার পর কুশলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তোমার কাছে কী হিসেব আছে বলো?’’
কুশল ব্যাগ থেকে সেই ছোট পকেট ডায়েরি বের করে বলল, ‘‘দু–হাজার সাতশো পঞ্চাশ টাকা।’’
সুজনদা চমকে উঠে বললেন, ‘‘অ্যাঁ—। কী বললে?’’
কুশল আবার বলল, ‘’দু–হাজার সাতশো পঞ্চাশ।’’
সুজনদা অবিশ্বাসীর চোখে কুশলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার পর বললেন, ‘‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’’
এবার কুশলের অবাক হওয়ার পালা। সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘‘মানে?’’
সুজনদা বলল, ‘‘তুমি এত টাকা বাড়িয়ে বলছ কী করে কুশল?’’
ভুরু কুঁচকে গেল কুশলের। বলল, ‘‘আমি প্রায় সাড়ে তিনমাস কোনও টাকা নিইনি। সব মিলিয়ে এই টাকাই হয়েছে।’’
সুজনদা বললেন, ‘‘আমার খাতায় তোমার সব কাজ লেখা আছে।’’
কুশল বলল, ‘‘বেশ তো। আপনার খাতাই দেখুন।’’
সুজনদা খাতা বের করে তাকে দেখালেন।
দেখে কুশলের ভিরমি খাওয়ার জোগার! সে অবাক হয়ে দেখল, সুজনদার খাতায় তার কাজের মূল্য লেখা রয়েছে মাত্র এক হাজার সাড়ে ছশো টাকা! কিন্তু, তা কী করে সম্ভব?
সুজনদা বললেন, ‘‘দ্যাখো তোমার প্রতিটি কাজের কথা এখানে লেখা আছে।’’
নিজেকে সংযত রেখে কুশল বলল, ‘‘আমার মনে হয়, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে সুজনদা। একটু ভালো করে আমার ডায়েরির সঙ্গে আপনার খাতাটা ট্যালি করে দেখুন।’’
কিন্তু— হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন সুজনদা। বললেন, ‘‘তুমি আমাকে মিথ্যেবাদী বলছ? তোমার স্পর্ধা তো কম নয়!’’
কুশল বলল, ‘‘না–না, আমি আপনাকে সে সব কিছুই বলছি না। কিন্তু, —একটু হিসেবটা মিলিয়ে দেখলে হয়তো কোথায় ভুল হয়েছে, ধরা পড়ে যাবে!’’
সুজনদা চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘‘দ্যাখো কুশল, আমি তোমাকে ভালো ছেলে বলেই জানতাম। কিন্তু, তুমি যে এমন দু–নম্বরি ছেলে, তা আমার জানা ছিল না!’’
সুজনদার কথায় মাথা গরম হয়ে গেল কুশলের। একই সঙ্গে অবিশ্বাস। সব মিলিয়ে বোবা হয়ে গেল সে। কিছু বলতে পারল না।
সুজনদা ক্যাশ বাক্স খুলে গুণে গুণে এক হাজার সাড়ে ছশো টাকা তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার পর বললেন, ‘‘তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। তুমি এখন এসো।’’
এবার ভয়ঙ্কর রাগ হল কুশলের। তবু কোনও রকমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘দু–হাজার সাতশো পঞ্চাশ টাকা যে আপনি দেবেন না, সেটা বলুন, মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমার সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না।’’
সুজনদা বেশ জোরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘বাজে কথা বলছি! তুমি টাকা বাড়িয়ে বলবে, আর আমি চুপ করে থাকব?’’
এবার চেঁচিয়ে উঠল কুশলও, ‘‘আমি বাড়িয়ে বলছি, নাকি আপনি কমিয়ে লিখেছেন, —তা আমি যেমন বুঝতে পারছি, তেমনই আপনিও জানেন। ঠিক আছে, আপনাকে আর টাকা দিতে হবে না।’’ বলে এক হাজার সাড়ে ছশো টাকা নিয়েই সে বেরিয়ে এলো সুজনদার ঘর থেকে।
বেরিয়ে দেখল প্রেসের দু–একজন কর্মী চিৎকার–চেঁচামেচি শুনে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ হনহন করে প্রেস থেকে বেরিয়ে এলো কুশল। বেরিয়ে একটা কথাই তার মনে হল, সত্যি, মানুষ আজ কী হয়ে গিয়েছে!  (‌ক্রমশ)

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..