বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:হেমতাবাদের বিজেপি বিধায়কের ‘রহস্যমৃত্যু’ নিয়ে রীতিমতো তরজা শুরু হয়েছে পশ্চিমবাংলার তৃণমূল সরকার এবং বিজেপির মধ্যে। রাজ্য সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আত্মহত্যারই ইঙ্গিত মিলেছে। তা ছাড়া, বিধায়কের আত্মহত্যার পেছনে লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় জড়িত থাকতে পারে বলেও সরকারের তরফে বলা হয়েছে। যদিও সরকারের যাবতীয় বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। তারা এখনও ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড়। সিবিআই তদন্ত চেয়েছেন প্রয়াত বিধায়কের স্ত্রীও। শুধু তাই নয়, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র নেতৃত্বে বিজেপি নেতারা এদিন দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে বিধায়কের ‘খুন’ নিয়ে অভিযোগ জানান। পাল্টা শনিবারও ডেরেক ও’ব্রায়েনের নেতৃত্বে তৃণমূল নেতারা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।
হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায় নাকি আত্মহত্যাই করেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সেই ইঙ্গিতই করা হয়েছে। মঙ্গলবার নবান্নে সাংবাদিকদের এ কথা জানান রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘গলায় চাপ লেগে মৃত্যু হয়েছে বিধায়কের। গলা এবং বাঁ হাত ছাড়া শরীরের অন্য কোনও অংশে আঘাতের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাই প্রাথমিক ভাবে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে।’ সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, গলায় এমন ফাঁসের দাগ হল অ্যান্টি মর্টেম। এটা প্রাথমিক ভাবে আত্মহত্যারই ইঙ্গিত। মৃত্যুর পর দেহকে ঝোলানো হয়নি। গলার ফাঁসেই বিধায়কের মৃত্যু হয়েছে। যদি তিনি খুন হতেন, তা হলে তাঁর গলায় একটানা একটিই দাগ থাকত।
বিধায়কের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আলাপন বলেন, ‘বিধায়কের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ প্রয়োজনীয় সমস্ত তদন্ত করছে। তাঁর এই মৃত্যুর পিছনে থাকতে পারে লেনদেন সংক্রান্ত কোনও বিষয়। তদন্তে তেমনই একটি বিষয় উঠে আসছে।’ যদিও রাজ্য সরকারের এমন যুক্তি মানতে রাজি নয় বিজেপি। দলের শীর্ষস্তরের রাজ্য নেতা রাহুল সিনহা স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন, খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালাতে চাইছে রাজ্য সরকার। তিনি বলেছেন, ‘ময়নাতদন্তের আগেই সোমবার দেহ দেখে পুলিশ জানিয়ে দেয়, বিধায়ক নাকি আত্মহত্যা করেছেন। সে ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত যে কতখানি ঠিকমতো হয়েছে, তা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। আর সেই রিপোর্ট যে সরকারের আত্মহত্যার তত্ত্বকে বৈধতা দেবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
রাহুল সিনহাও এদিন বিজেপি বিধায়কের মৃত্যুর সিবিআই তদন্ত চেয়েছেন। পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমাদের দাবি, বিধায়কের এই রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত করানো হোক সিবিআইকে দিয়ে। নতুবা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক এই ঘটনার।’ পাশাপাশি রাজ্য সরকারের বক্তব্য মানতে রাজি নয় প্রয়াত বিধায়কের পরিবারও। প্রয়াত দেবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী চাঁদিমা রায় মঙ্গলবারও পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমার স্বামী আত্মহত্যা করতে পারেন না। এটা খুন। এই ঘটনার সিবিআই তদন্ত চাইছি আমরা।’ রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে, সেই রিপোর্টও খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসন মূল ঘটনাকে ধামাচাপা দিতেই আত্মহত্যার গল্প সাজাচ্ছে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিতে আমার স্বামীর ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমাকে সে কথা আমার স্বামী অনেকবার বলেছিলেন। বিজেপি নেতাদেরও সে কথা জানিয়েছেন।’
এদিকে, প্রয়াত বিধায়কের পরিবারের সঙ্গে সহমত গ্রামবাসীদের অনেকেই। এদিনও তাঁরা স্পষ্ট প্রশ্ন করেছেন, হাত বাঁধা অবস্থায় কেউ কী করে আত্মহত্যা করতে পারে? ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাইছেন তাঁরাও। যদিও ঘটনায় মালদা থেকে সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মী নিলয় সিংহকে আটক করেছে সিআইডি। তাঁকে রায়গঞ্জে নিয়ে গিয়েছে তারা। এ ছাড়া বিধায়কের মৃত্যুর ঘটনার জন্য চাঁচলের বাসিন্দা মাবুদ আলি নামে আরেকজনেরও খোঁজ শুরু করেছে পুলিশ। বিধায়কের সুইসাইড নোটে নাকি এই দু’জনের নাম উল্লেখ করা রয়েছে। যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ পুলিশের এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। সোমবারও বিধায়কের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তিনি তৃণমূলের স্থানীয় এক যুবনেতার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। মঙ্গলবার তিনি দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক কারণেই খুন হয়েছেন বিধায়ক। তাকে আত্মহত্যা বলে রাজ্য সরকার চালিয়ে দিতে চাইছে। সিবিআই তদন্ত হলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘অন্য কোথাও খুন করে বিধায়ককে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে সুইসাইড নোট পুলিশ তাঁর পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকও বলেছেন, ‘আবার নতুন করে ময়নাতদন্ত হোক। তবে তার আগে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা দিন। তার পরই সেই তদন্ত হোক। তবেই সত্য প্রকাশিত হবে।’ বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় তো পুলিশের বলা সেই সুইসাইড নোটকেও জাল বলে উল্লেখ করেছেন। জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও গোলমাল আছে। পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে তৃণমূল। রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার প্রধান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম এদিনও দাবি করেছেন, ‘মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে বিজেপি। ব্যক্তিগত ভাবে আমিও তাঁকে চিনতাম। কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করলেন, তার তদন্ত চলছে। সত্য নিশ্চয়ই প্রকাশিত হবে। বিজেপির রাজনীতি সফল হবে না।’