1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  4. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  5. shanto.hasan000@gmail.com : রাকিবুল হাসান শান্ত : রাকিবুল হাসান শান্ত
  6. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  7. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  8. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :

সুন্দরী, সেগুন আর ম্যান গ্রোভের দেশে (শেষ পর্ব)

  • Update Time : সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ৪৪৫ Time View

সুন্দরী, সেগুন আর ম্যান গ্রোভের দেশে
লতিফুর রহমান প্রামানিক
(পঞ্চম পর্ব)

১২/১২/২১. সকাল সকাল নাস্তা সেরে নিলাম। আমরা এখন ফিরতি পথে রয়েছি। সমূদ্র ছেড়ে পশুর আর রূপসার বুকে চলা ফেরা শুরু হলো। সকাল নয় টা নাগাদ আমাদের জাহাজ থেমে গেল, সমূদ্র আর নদীর মোহনার বুকে। আমাদের জাহাজ ঘুরে নেয়া হলো একটা সরু খালের মধ্যে। আরও একটা জাহাজ ও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সকালের স্নিগ্ধ রোদ, হাতের উভয় পাড়ে অফুরান জংগলের সারি।  সম্ভবত হাই ভাই নয়তো বা এমদাদ ভাইয়ের চোখে পড়ে যায় একটা পড়ে যায় একটা হরিণের বাচ্ছা। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটি হরিণ চোখে পড়ে গেল। প্রতিবার বনের ভিতর কোন প্রানীর সাক্ষাৎ মানেই হলো চরম প্রাপ্তি যেন।  জাহাজ আবারও এগিয়ে চলছে। একদম মাঝ নদীর বুকে থেমে গেলো। প্রচুর বড় বড় জাহাজ আর নৌকার সারি সেখানে।
আমরা নৌকায় উঠে পড়ি। অনেক স্রোত। ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের শরীরে। কিন্তু ভয় টা এর মধ্যে অনেক খানি কমে এসেছে। আসলে পরিবেশ আর পরিস্থিতি মানুষের জীবন কে অনেক বদলে দেয়। দেখতে দেখতে এসে পড়ি করমজল এর ধারে।

করমজল পর্যটন কেন্দ্র সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ৩০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, রেসাস বানর সহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল এবং টাওয়ার। জেলেদের মাছ ধরার কর্মজজ্ঞ এই পর্যটন কেন্দ্রে অতিরিক্ত প্রাপ্তি। বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রটি করমজলে অবস্থিত।

বর্ণনাসম্পাদনামংলা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করমজল পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। পর্যটন কেন্দ্রের প্রথমেই রয়েছে সুন্দরবনের মানচিত্র, যা সুন্দরবন সম্পর্কে মানচিত্র প্রাথমিক ধারণা দেয়। সামনে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি মাঙ্কি ট্রেইল নামের হাঁটা পথ ধরে এগিয়ে গেলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এই পথে এগিয়ে পশুর নদীর দেখা পাওয়া যায় চাইলে সেখানে নির্মিত বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নেওয়া যাবে।

সরকারীভাবে পরিচালতি একমাত্র লবন পানির কুমির ও বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপ (বাটাগুড় বাল্কা) প্রজনন কেন্দ্র। এটি বানিশান্তা  ইউনিয়ন সংলগ্ন সুন্দরবনে অবস্থিত। এখানে পর্যটক সরাসরি পূর্বানুমতি ছাড়া যেকোন সময় সুন্দরবন সম্পর্কে সম্মক ধারনা ও জ্ঞান লাভ করতে পারেন। প্রাকৃতিক পরিবেশে চিত্রল হরিণ, বানর ও কুমির দেখার সুযোগ রয়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরীন চিত্র অবলোকনের জন্য দেড় কিলোমিটার কাঠের ট্রিল আছে। উপরের চিত্র দেখার জন্য ৪৫ ফুট উচু একটি আরসিসি টাওয়ার আছে। জলজ প্রাণী সম্পর্কে জানার জন্য ডলপিন ডিসপ্লে, চিত্রল হরিণের চামড়া, বাঘের কঙ্কাল, কুমিরের ডিম, বিবিধ শ্রেণীর উদ্ভিদ চেনার জন্য আঞ্চলিক, প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক নামের নেমপ্লেট, সুন্দরবনের মানচিত্র, ৩টি বড় কুমির যথাক্রমে রোমিও (পুরুষ), জুলিয়েট ও পিলপিল (নারী)  রয়েছে। দায়িত্বপ্র্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার তত্বাবধানে এই মুহুর্তে ২১৭টি বিভিন্ন বয়স ও আকারের কুমির রয়েছে। ২ মিটার দৈর্ঘ্য হলে কুমিরের বাচ্ছা নদীতে অবমুক্ত করা হয়। পর্যটক ওঠা নামার জন্য রয়েছে ২টি সুদৃশ্য আধুনিক ঘাট।
দাকোপ উপজেলা সদর থেকে করমজলের দুরত্ব ৩০ কি:মি:, জেলা শহর থেকে ৫৫ কি:মি:। এখানে নৌপথ ও সড়ক পথে সহজেই ভ্রমন করা যায়।

সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে পথের মাথায় একটি শেড রয়েছে। এই জায়গা থেকে পশ্চিম দিকে আরও একটি কাঠের নির্মিত ট্রেইল দেখতে পাওয়া যাবে। এই পথ আপনাকে নিয়ে যাবে কুমির এবং হরিণ প্রজনন কেন্দ্র এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। এই টাওয়ার থেকে আশেপাশের সৌন্দর্য্য দেখা যাবে।

পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশপথেই চোখে পড়বে মাটিতে শোয়ানো বিশাল আকৃতির মানচিত্র যা আপনাকে সুন্দরবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেবে। মানচিত্রটিকে পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। এরই নাম মাঙ্কি ট্রেইল। এই নামের সার্থকতা খুঁজে পাবেন ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। হাতে যদি কলা বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে পথ চলেন তবে বানরগুলো আপনাকে ঘিরে ধরতে পারে। শুধু কি তাই। তার জলন্ত সাক্ষী আমি হয়েছিলাম। শিরিন আপা আমাকে আর রেশমাকে দুটো কোক এর বোতল কিনে দেন। আমি সেটা নিয়ে নদীর ধারে গিয়ে মোবাইলে কথা বলছিলাম আর আরেক হাতে কোকের বোতল আর স্কিনটাচ মোবাইল টা ছিলো। হটাৎ করে ছো মেরে একটা বানর কোকের বোতল টা নিয়ে গিয়ে পানিতে ধুয়ে নিয়ে ঢকঢক করে পান করতে থাকে। আমি নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমাদের দলের লোকজন ও হাসাহাসি করতে থাকে। আমি ধন্যবাদ দেই বানর কে, যে সে আমার ভাগ্যিস মোবাইল টা নিয়ে যায়নি। তাহলে আর হয়তো মোবাইল টা পেতাম না। দারুণ দ্রুত আর চালাকচতুর এসব বানর। করমজল এ তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে এবার হাড়েমজ্জায় টের পেলাম। আমরা টাওয়ার এর উপর দাঁড়িয়ে সমগ্র বনের উপরে এর বিশালতা দেখে অবাক হলাম। শুধু গাছ আর গাছ। এর যেন শেষ নেই এখানে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এখানে ঘুরে বেড়াই আমরা। হরিণের দল আর কুমিরের আয়েশি ঘুম দেখলাম। সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকলো। বনের বুক চিরে কাঠের তক্তা বসিয়ে ব্রিজ ধরে পাইন গাছের আর গোল পাতার ফাঁকে ফাঁকে চললাম। এক অসাধারণ পরিবেশ, নির্জন, শান্ত আর কিছু কিছু ভয়। সামান্য কিছু পর পর বিশাল বিশাল গুইসাপ মাঝে মাঝে ভড়কে দেয় আমাদের।
হাটতে হাটতে ক্লান্ত প্রায়। কিছুটা বনের ভিতর জিরিয়ে নিলাম কেউ কেউ। মুগ্ধ হলাম যেন। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হলে ক্লান্তি আর বেশি স্থায়ী হয় না।
আবারও নৌকায় উঠে পড়ি। জাহাজে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। আর ঘন্টা পথ এরপর আমাদের যাত্রার পরিসমাপ্তি হবে। জল ছেড়ে শহরে আরও কটা ভ্যেনু রয়েছে।
সবাই ব্যস্ত ব্যাগ পত্র গোছানো নিয়ে। নেমে পড়ি মোংলা বন্দর এর ঘাটে।

ঘড়ির কাঁটার সময় তখন ২.৩০ মিনিট। আরেক বার পিছন ফিরে তাকিয়ে থাকি। অজস্র স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম যেন। ভ্রমণে পরিপূর্ণ সুখ যেন সবার মনে। বাস ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ছুটে চলছি ষাট গম্বুজ মসজিদ আর খান জাহান আলী মাজার পথে। দেশের অন্যতম এই স্থান দুটো দেখার ইচ্ছে টা বহুদিন ধরে।
আমরা বাসে উঠে খান জাহান আলী সেতু পেরিয়ে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। প্রায় বিকেল আসন্ন তখন। রাস্তার দু ধারে জালের মতো বিছিয়ে আছে চিংড়ি মাছের ঘের। দেখতে দেখতে এসে পড়ি সেই বিখ্যাত মাজার এরিয়া। আমরা খানিকটা পায়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি ততই উপরে যাচ্ছি আমরা। অনেক উঁচুতে যেতে হয় মাজারের কাছে যেতে।
অনেক সুন্দর কারুকাজ আর অসাধারণ দালানের নির্মাণ শৈলী। আমরা কয়েক জন ভিতরে চলে যাই মাজারের ভিতর টা দেখার জন্য।
সামনে প্রকান্ড দিঘি আর পাখির চোখের মতো চকচকে তার জল।
খান জাহান আলী (১৩৬৯ – ২৫ অক্টোবর ১৪৫৯) ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক। তার অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে উলুঘ খান, খান-ই-আজম ইত্যাদি।

হযরত উলুঘ খানজাহান আলি ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি ( সূত্র দরকার)। ধারণা করা হয় যে তার পূর্বপুরুষগণ তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন। খানজাহান আলির প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লিস্থ বিখ্যাত অলিয়ে কামিল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কুরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
খানজাহান আলি ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ এ মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্নর) পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদল সহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন (সূত্র প্রয়োজন)। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বারবাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন।
খানজাহানের প্রথম স্ত্রীর নাম সোনা বিবি। কথিত আছে সোনা বিবি ছিলেন খানজাহানের পির নুর-কুতুবুল আলমের একমাত্র কন্যা। খানজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন। খানজাহান আলি তার দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদ এবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে এই দুই স্ত্রীর নাম লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কারণ খান জাহান আলী ইসলামি সংস্কৃতির একজন পৃষ্ঠপোষক ও আরবি ফারসি শাস্ত্রে শিক্ষিত একজন মুসলিম সাধু ছিলেন। “সোনাবিবি ও রূপাবিবি” এ ধরনের নামকে অযৌক্তিক মনে করা হয়।
হযরত খানজাহান আলি অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯ তারিখে (মাজারশরিফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরি ২৬শে জিলহাজ) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

বিশাল পুকুর ঘাটের চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছে পরিপূর্ণ। তবে এই পুকুর আর মাজার ঘিরে এখানে কিছু অসাধু মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে। আমাদের পুরো পুকুরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য হাতে তেমন
সময় ছিলো না। হয়তো ঘন্টা দুই লাগবে পুরো পুকুরের চারিদিকে ঘুরে আসতে। ভীষণ গভীরতা বলে পানির রঙ নীলচে আর টলটলে।  আমরা পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রচুর ছবি তুলছিলাম।
সেলিম ভাই। একজন দারুণ ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। সুযোগ পেলেই ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। এবার পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন আমাদের সাথে। বন্ধুসুলভ সম্পর্কের মতো তার সাথে। আমাকে তো সেখানেই বলে দিল, দেখ এরপর কোথায় যাওয়া যায়।
আমরা মাজারের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। লেখার সুত্র জানার জন্য আমার আগ্রহ টা কিছুটা বেশি। তবে আশেপাশের লোকেশন চমৎকার লাগলো। দারুণ ছিমছাম আর গোছানো।
হযরত খানজাহান (রঃ) এর মাজারগাত্রে উৎকীর্ণ শিলালিপি পাঠ করে তাঁর কিছুটা পরিচয়ের সূত্র পাওয়া যায়। কিন্তু এ সাধকের প্রকৃত নাম ও বিসত্মারিত পরিচয় আজও সঠিকভাবে জানা যায়নি। উক্ত শিলালিপিতে তাঁর নাম পরিচয়“ খানে আযম খানজাহান” ও “উলুঘ খানহাজান”লেখা আছে। শিলালিপিতে আরবী ও ফারর্সী ভাষায় তাঁর মৃত্যু তারিখ ৮৬৩ হিজরী ২৬ জিলহজ্ব বুধবার (মোতাবেক ১৪৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর মতামতরে ২৪ অক্টোবর) উলেস্নখ আছে। “উলুঘ ” তুর্কী শব্দ এবং তা পারিবারিক উপাধি । এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি উলুঘ নামক কোন এক তুর্কী পরিবারের সমতান । কোন কোন লেখকের মতে তিনি পারস্য মতামতরে আরব দেশ থেকে দিলস্নী হয়ে এ দেশে আসেন । তুর্ক- আফগান আমলে সেনাপতির সম্মানিত উপাধী ছিল খানে আযম । এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি একজন সেনা নায়কও ছিলেন এবং “খানে আযম খানজাহান” উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল । এ মহান সেনা নায়ক ও সাধক তাঁর নিজ পরিচয় সম্বন্ধে কিছু লিখে রেখে যাননি। লোক পরম্পরায় তাঁকে সবাই খানজাহান আলী (রঃ) নামেই চিনে এসেছে।

তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্বন্ধেও খুব বেশী কিছু জানা যায় না । যতদুর জানা যায় তিনি সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করেন এবং তাঁর এক বা একাধিক স্ত্রী ছিল। তবে তিনি নিঃসমত্মান ছিলেন। গবেষকগণ অনুমান করেন তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্-এর সমসাময়িক এবং সম্ভবতঃ তিনি গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সেনানায়ক ছিলেন। সুলতানের প্রতিনিধিরূপে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বাগেরহাট অঞ্চলে বিশাল জনপদ সৃষ্টি করেন এবং রাজ্য বিসত্মার করে শাসন কাজ চালাতে থাকেন। সে জন্যই তিনি এ অঞ্চলের নামকরণ করেন “খলিফাত-ই-আবাদ”। খানজাহান (রঃ) এমন এক মহাপুরম্নষ ছিলেন যাঁর মহতী গুনাবলীর দ্বারা বাগেরহাটসহ সমগ্র ভাটি অঞ্চল উপকৃত ও ধন্য হয়েছে। কথিত আছে এ মহাপুরম্নষ মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যশোরের বারোবাজার থেকে শুরম্ন করে সমগ্র ভাটি অঞ্চল জুড়ে ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ ও ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন। মুসলমানদের প্রথম আবাদকৃত এ অঞ্চলে উপাসনার জন্য মসজিদগুলি এবং নোনা পানির দেশ ভাটি অঞ্চলে পানীয় জলের এ দীঘিগুলি আপামর জনগণের কাছে খোদার আশীর্বাদের মতই প্রতিভাত হয়েছিল। আরও কথিত আছে, এ দেশে আগমনের সময় তাঁর সাথে যে ৩৬০জন আউলিয়া এসেছিলেন সম্ভবতঃ তাঁদের সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ ও ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন। প্রথমে শাসকরূপে জীবন শুরম্ন করলেও পরবর্তীতে ধর্ম চিমত্মা ও জনসেবাই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন এক অলৌকিক ক্ষমতাবান মহাপুরম্নষ । দুঃস্থ মানুষের মুখে ক্ষুধার অন্ন বিতরণ, জলকষ্ট নিবারণের জন্য  অসংখ্য দীঘি খনন, রাসত্মাঘাট নির্মাণ,হাট-বাজার স্থাপন, মানুষের ধর্মীয় উপাসনার জন্য অপূর্ব স্থাপত্য সুষমামন্ডিত অগণিত মসজিদ নির্মাণ প্রভৃতি অসংখ্য কীর্তিরাজি কালের শত ভ্রম্নকুটি উপেক্ষা করে আজও সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসার বাণী বহন করে চলেছে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের বিসত্মীর্ণ জনপদের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি ঘরে ঘরে।

খাঞ্জেলী দীঘির উত্তর পাড়ে এক উচ্চ ভূমিতে তাঁর সমাধি সৌধ নির্মিত। সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতি, এর আয়তন ৪২ফুট X৪২ ফুট এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ফুট, এর ছাদে একটি গম্বুজ আছে। সমাধি সৌধের ভিতর একটি প্রসত্মর নির্মিত বেদিতে হযরত খানজাহান (রঃ)এর মাজার অবস্থিত । দরগাহ বা সমাধি সৌধের সহাপত্য শিল্প অনেকটা ষাটগুম্বজের ন্যায়। শিলালিপিতে মৃত্যু তারিখ, দাফন তারিখ ছাড়াও আলস্নাহর নাম,কোরআন শরিফের কয়েকটি সূরা এবং তাঁর উপর আলস্নাহর শামিত্ম বর্ষিত হোক ইত্যাদি লিপিবদ্ধ আছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত তাঁর রম্নহানী দোয়া লাভের আশায় মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এছাড়া প্রতি বছর ২৫ অগ্রহায়ণ এ মহান সাধকের মাজার প্রাঙ্গনে বার্ষিক ওরশ মোবারক এবং চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে এক বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ ওরশ ও মেলায় দূর-দূরামত্ম থেকে হাজার হাজার ভক্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মাজারে সমবেত হন।
আমরা এবার চল্লাম আরেক ঐতিহাসিক বিখ্যাত মসজিদ ষাট গম্বুজ মসজিদ এর দিকে। চমৎকার জায়গা টা। ফুলের বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে সেই মসজিদ।

ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন। এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটির মধ্যে অবস্থিত; বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এই সম্মান প্রদান করে।

মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। ষাট গম্বুজ মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১ টি, সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় ৪ টি মোট ৮১ টি। কালের বিবর্তনে লোকমুখে ৬০ গম্বুজ বলতে বলতে ষাট গম্বুজ নামকরণ হয়ে যায়, সেই থেকে ষাট গম্বুজ নামে পরিচিত।

ইতিহাসসম্পাদনাসুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়। এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। তুঘলকি ও জৌনপুরী নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।
আমি আর বকুল মসজিদের ভিতর চলে গেলাম। বিশাল আকার ভিতর দিকে।
বহির্ভাগসম্পাদনামসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা, ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আজান দেবার ব্যবস্থা ছিল। এদের একটির নাম রওশন কোঠা, অপরটির নাম আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে। এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬ সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়,বরং গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো। মিনারে গম্বুজের সংখ্যা ৪ টি-এ হিসেবে গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৮১ তে । তবুও এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের সাত গম্বুজ এবং তা থেকে ষাটগম্বুজ নাম হয়েছে। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গম্বুজগুলো ৬০ টি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।

অভ্যন্তরভাগসম্পাদনামসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্যমন্ডিত। এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে যেখানে ১টি মিহরাব থাকার কথা সেখানে আছে ১টি ছোট দরজা। কারো কারো মতে, খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে নামাজের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, আর এই দরজাটি ছিল দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হত।ইমাম সাহেবের বসার জায়গা হিসেবে রয়েছে মিম্বার।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। দিনের আরেকটা সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাক্ষী হয়ে গেলাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি ভর করেছে সবাইকে।
সন্ধ্যা বাজারে কেউ কেউ মাছ কিনে প্যাকেট করার তাগিদ। আবিরের সাথে দেখা হলো সেখানে। সে এখানে পড়ে। বাড়ির খোঁজ খবর নিলাম ইত্যাদি। চুই ঝালের দোকানে এমদাদ ভাই সহ কিছুটা কিনে খুলনার শেষ লাল চায়ের স্বাধ মুখে নিয়ে চলে গেলাম স্টেশনে।
রাত ৯.৩০ মিনিট। ট্রেনের সীটে বসার পালা আমাদের। ট্রেনে উঠে বহু কথা হলো তাতা ভাইয়ের সাথে। রাজনীতি, প্রাক্টিস, আইন কানুন আর ভ্রমণের সালতামামি। ট্রেন চলছে নিজ গতিতে।
ভোর ছয়টা বাজে।পাব্বতীপুর রেল জংশন এ পা বাড়াই। ক্ষুধার্ত হয়ে কয়েকটি শুকনো বিস্কুট আর স্টেশনে এক কাপ দুধ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো রাজু ভাইয়ের সাথে। আলাপ পরিচয়। আবারও দেখা হবে।
বদরগঞ্জ এ নামার আগে আরেক বার হাত নাড়িয়ে বিদায় বন্ধু গন। প্রশংসা মহান প্রতিপালকের যিনি পায়ের ধাপ আরেক বার বাড়িতে ফেলার সুযোগ করে দিলেন।
তারপর সারাদিন সেই লম্বা ঘুম।

সুত্র সহায়তা: উইকিপিডিয়া, পত্রিকা আর বিভিন্ন জার্নাল।

সমাপ্ত।

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..