দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ মুক্তিপণের দশ লাখ টাকা দিতে রাজি হলেও শেষ রক্ষা হয়নি রকিবুলের। মানবপাচারকারীদের বুলেটের আঘাতে নিহত অপর ২৫ বাংলাদেশির মতো তাকেও জীবন দিতে হয়েছে।
আর তার মৃত্যুর খবরে শোকের মাতম বইছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের বাড়িতে। রকিবুলের মা মাহিরুন নেছা কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
লিবিয়ায় গত বৃহস্পতিবার অপহরণকারীদের হাতে নিহত ২৬ বাংলাদেশির একজন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম খাটবাড়িয়ার ঈসরাইল হোসেন দফাদারের ছোট ছেলে রকিবুল ইসলাম রকি। সংসারে সচ্ছলতা আনতে মাত্র ২০ বছর বয়সে মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল লিবিয়ায়। ভিটে বাড়ির একটি অংশ বিক্রি করে ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দালালের মাধ্যমে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ছেড়েছিল সে। গিয়েছিল ভাগ্য পরিবর্তন ও জন্মদাতা বাবা-মায়ের মুখে একটু হাসি ফোটাতে।
কিন্তু বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর পরিবর্তে তাদের বুকে এখন এক সাগর কান্না। এখন তারা অন্তত রকির লাশটা ফেরত চান।
রকিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি টিন শেডের ঘরের সামনে উঠোনে হাউমাউ করে কাঁদছেন রকির মা মাহিরুন নেছা। তাকে ঘিরে বসে অন্য স্বজনদের চোখেও পানি। কাঁদতে কাঁদতে মাহিরুন নেছা আহাজারি করছেন।
তিনি বলেন, ভিটে বাড়ি বেচে ১০ লাখ টাকা দিয়ে রাস্তায় থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমার সোনারে বাঁচতে দিল না তারা।
এদিকে পাশেই একটি চেয়ারে রকির বাবাকে বসিয়ে রেখেছেন কয়েকজন স্বজন। ছোট সন্তান হারিয়ে শোকে নির্বাক পাথর তিনি। কাঁদতেও যেন ভুলে গেছেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে আপন মনে কি যেন বলছেন।
রকির শোকার্ত বড় ভাই সোহেল রানা জানান, তারা চার ভাই বোন। রকি সবার ছোট। রকি যশোর সরকারি সিটি কলেজের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। ভিটে বাড়ির একটি অংশ বিক্রি করে ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দালালের মাধ্যমে ভাইকে লিবিয়ার ত্রিপোলি পাঠানো হয়। তার এক আপন চাচাতো ভাইও থাকেন লিবিয়ার ত্রিপোলিতে। সেখানেই তার যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু দালাল তাকে ত্রিপোলিতে নিতে পারেনি। রকির বিমানটি বেনগাজিতে অবতরণ করেন। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে দালাল তাকে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে নিতে পারছিলো না। এজন্য সে বেনগাজীর একটি তেল কোম্পানিতে কাজ নেয়। সেখানে ২ মাস কাজ করে। কাজের সুবাদে পরিচয় হয় এক বাংলাদেশি দালালের সাথে। ওই বাংলাদেশি রকিকে বেনগাজী থেকে ত্রিপোলিতে চাচাতো ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ৭০ হাজার টাকায় চুক্তি করে।
সে অনুযায়ী গত ১৫ মে রকি দালালের সাথে বেনগাজী থেকে রওনা হয় ত্রিপোলির উদ্দেশে। পথে ত্রিপোলির কাছাকাছি মিজদাহ নামক স্থানে ১৭ মে তারা অপহরণকারীদের হাতে জিম্মি হয়।
সোহেল রানা আরো জানান, পরের দিন সন্ধ্যার দিকে তার কাছে বাংলাভাষী একজন ফোন করে। সেই ব্যক্তি নিজের পরিচয় না দিয়ে রকির মুক্তির জন্য ১২ হাজার ইউএস ডলার অথবা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ লাখ টাকা দাবি করে। এসময় অপহরণকারীরা তার সাথে রকির কথা বলায়। রকি সোহেলকে জানায়, তাকেসহ অন্য জিম্মিদের অপহরণকারীরা খুব নির্যাতন করছে এবং টাকা না দিলে হত্যা করা হবে।
এরপর প্রতিদিনই অপহরণকারীরা রকিকে নির্যাতন করে টাকার দাবিতে ফোন করাতো এবং দুবাইয়ের একটি একাউন্টে টাকা জমা করতে বলতো। একপর্যায়ে ১০ লাখ টাকা দিতেও রাজি হয়েছিলেন এবং পহেলা জুন টাকা দেয়ার সময় নির্ধারিত হয়েছিল।
সোহেল রানা আরও জানান, গত বৃহস্পতিবার (২৮ মে) রাতে রকি তাকে ফোন দেন। সাথে ঘটনাস্থলের গুগল ম্যাপের ছবিও পাঠান। ফোনে রকি অপরহণকারীদের সাথে জিম্মিদের মারামারির ঘটনা জানিয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাতে বলেন। এরপর গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে অপহরণকারীদের হাতে জিম্মি হওয়া আহত মাগুরার তরিকুলের মাধ্যমে রকির মৃত্যু সংবাদ পান।
তিনি বলেন, তাদের পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েছেন। তারা অন্তত ভাইয়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে ও দাফন করতে চান। এজন্য তারা রকির মরদেহ ফিরিয়ে আনতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন