স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(পর্ব ০৭)
উপমন্যু রায়
সাত
কাল ভোর রাতে ফের সেই স্বপ্নটা দেখল কুশল। সেই স্বপ্নটা! ঝাঁ–চকচকে একটা দামি গাড়ি। আর এক সুবেশা সুন্দরী।
স্বপ্নে দেখল, কুশল তখন হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে হেঁদুয়ার কাছে চলে এলো। বেথুন কলেজের উলটো দিকের ফুটপাথে দাঁড়াতেই তার সামনে সেই গাড়িটা এসে থামল। নেমে এলো সেই সুন্দরী। শুধু তাই নয়, তার সিগারেট জ্বালিয়ে দিল অভিনব একটি লাইটার দিয়ে। তার পর সেই ধোঁয়া। আর, ধোঁয়াতেই মিলিয়ে যায় সুবেশা।
কাল রাতে তার জ্বর এসেছিল। বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তাই বেশি দেরি করেনি। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিল। ঘুমও চলে এসেছিল দ্রুত। একেবারে গভীর ঘুম। তবে মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙে। বাথরুমে যায়। তার পর একটা সিগারেটও খায়। শেষে এক গ্লাস জল খেয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাতে তার ঘুমন্ত দু’চোখে হানা দেয় স্বপ্নটা।
শরীরটা ভালো নেই বলে টিউশনি থেকে সে–দিন ছুটি নিল সে। সারাদিন বাড়িতেই থাকল। বিকেলের দিকে বাড়িতে মন টিকল না। একটু হাঁটবে ভেবে বাইরে বের হল।
সে দিন বিকেলের আলো বেশ মনোরম ছিল। স্কটিশ চার্চ কলেজের গলিতে যযাতিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল কুশলের। যযাতিদা কোনও কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। কুশলের হাতেও কোনও কাজ ছিল না। অর্থাৎ, দু’জনের হাতেই ছিল কিছুটা সময়।
যযাতিদাই কুশলকে নিয়ে হেঁদুয়ায় গিয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসলেন। শুরু হল আড্ডা। এ–কথা সে–কথার পর দু’জনের আলোচনায় উঠে এলো ভারতীয়দের যৌন প্রবৃত্তি।
যযাতিদা কোনও ভনিতা না করেই ভারতীয়দের যৌন–সততা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। বললেন, ‘‘দেখবি, আমাদের দেশের মানুষের মধ্যেই সেক্স নিয়ে বেশি শুচিবাই দেখা যায়। যেন সেক্স ব্যাপারটা খুবই খারাপ। যদি নিখুঁত ভাবে এ দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে সেক্স নিয়ে রিসার্চ চালানো যেত, তা হলে দেখা যেত, ভারতীয়দের মধ্যেই সেক্স নিয়ে বেশি ভণ্ডামো রয়েছে। সোজা কথায় বলা যেতে পারে, আমরা অধিকাংশই যৌন–অসৎ।’’
কুশল হাসল। বলল, ‘‘কথাটা ভুল নয়। আর, তার প্রমাণ তো আমাদের দেশের জনসংখ্যা। আর কিছু না পারুক, জনসংখ্যা কী হারে বাড়াতে হয়, পৃথিবীতে বোধ হয় আমাদের মতো আর কোনও জাতি জানে না!’’
যযাতিদাও হাসলেন। বললেন, ‘‘আমরা বিয়ে–সংসারকে জন্ম–জন্মান্তরের বন্ধন বলে মনে করে থাকি। বিশ্বাস করি, স্বামী–স্ত্রী যেন একে অন্যের জন্যই জন্ম নিয়েছে। একমাত্র দু’জনের মধ্যে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ওই দু’জনের কারও সেক্স হতে পারে না। কিন্তু, সকলে যদি বুকে হাত দিয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারত, দেখা যেত, সেক্স নিয়ে ওই অহমিকা স্রেফ মিথ্যে কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।’’
কুশল মাথা নেড়ে স্বীকার করে নেয়। বলে, ‘‘হ্যাঁ, সেক্স নিয়ে যারা হতাশায় ভোগে, মানে যাদের সেক্স পার্টনারের অভাব থাকে, তারাই সেক্স নিয়ে মহান সব কথা বলে! অবৈধ সম্পর্কের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।’’
যযাতিদা ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘সম্পর্ক সম্পর্কই। তার আবার বৈধ–অবৈধ কী? এ–সব বলে আমরা আসলে সমস্ত সম্পর্কেরই অসম্মান করি। আসলে নিজের গোপন ইচ্ছেকে আড়াল করতে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে আমরা ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করে থাকি। কিন্তু সত্য হল, সম্পর্ক কখনও ‘অবৈধ’ হয় না!’’
কুশল হাসিমুখে মাথা নাড়ে। বলে, ‘‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।’’
যযাতিদাও হাসেন। বলেন, ‘‘তুই কী বলতে চাইছিস, আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, সবাই তা নয়। যদি তা–ই হত, তা হলে তুই নিজের সম্পর্কে কী বলবি?’’
কুশল গম্ভীর হয়ে যায়।
যযাতিদা বললেন, ‘‘আরে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সেক্স সত্য। সেক্সকে অস্বীকার করতে পারেননি দেব–দেবী থেকে মহাপুরুষ, কেউই। আর আমাদের সাধারণ মানব–সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে যতই প্রেম–ভালবাসার কথা বলিস না কেন, সবই আসলে সেক্স। সেক্স ছাড়া নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও সম্পর্ক হয় না। হতে পারে না।’’
যযাতিদা এমনই। কখন যে কী নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠবেন, তা আগাম অনুমান করা কঠিন। কুশল জানে। যে দিন মাথায় যা আসবে, কুশলকে দেখলে তা নিয়েই আলোচনা শুরু করে দেবেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই কুশল চুপ করে থাকে।
যযাতিদা বলে চললেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে পশুদের সঙ্গে মানুষের কোনও তফাত নেই। পশুরা তিনটি ব্যাপার বোঝে। খাওয়া, বাথরুম আর সেক্স করা। এর জন্য কোনও রকম আপস তারা করে না। প্রয়োজনে প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন পর্যন্ত করে। নারী–পশুরাও ভীরু–কাপুরুষ পশুকে নিজের সন্তানের পিতা করতে চায় না। সোজা কথায়, সঙ্গমের অধিকার দেয় না। মানুষও তাই। শুধু বিভিন্ন দোহাই দিয়ে আমরা ব্যাপারটাকে পালিশ করেছি মাত্র। আর কিছু না।’’
কুশল বুঝতে পারে, ‘‘এবার যযাতিদা তাঁর স্বভাব–ধর্মে ফিরেছেন। কিন্তু, যযাতিদার কথার মধ্যেই স্ববিরোধিতা রয়েছে। যযাতিদাই বললেন, নারী–পশুরা ভীরু–কাপুরুষ পশুকে নিজের সন্তানের পিতা করতে চায় না। মানুষও নাকি তাই! তা হলে কুশলকেই বা মেয়েরা পছন্দ করবে কেন? সে–ও তো ব্যর্থ, ভীরু, কাপুরুষ একটি সাধারণ ছেলে! এমন ছেলেকে নিয়ে কোনও মেয়ে আবেগ বা শরীরী তৃষ্ণায় ভেসে যেতে পারে না। তা হলে যযাতিদা প্রেম–বিয়ের কথায় তাঁকে নিয়ে পড়েন কেন?’’যযাতিদা কিন্তু কুশলের মনের কথা টের পেলেন না। বললেন, ‘‘আমাদের ধর্মকথায়ও তাই আছে। হিন্দুধর্মের পুরাণ ঘাঁটলে এমন গল্প অনেক পাবি। খ্রিস্টান ধর্মেও এমন কাহিনির অভাব নেই। আরে যিশুর কথাই ধর না। মেরি আসলে যিশুর কে?’’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘যিশু যে বিবাহিত ছিলেন, সে কথা নিশ্চয়ই জানিস?’’
কুশল বলে, ‘‘শুনেছি। যিশুর বিবাহিত জীবন নিয়ে অনেক কাহিনি লেখা হয়েছে। যিশু বিবাহিত ছিলেন বলে অনেক গবেষকই দাবি করে থাকেন।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, ১৯৫৩ সালে নিকোস কাজানজাকিসের লেখা ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অফ ক্রাইস্ট’ এবং তার পর মিশেল বেঁজ, রিচার্ড লেই ও হেনরি লিঙ্কন মিলিত ভাবে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ডেন ব্রাউনের ‘দ্য ড্য ভিঞ্চি কোড’ বইয়ে ম্যাগডালেনকে যিশুর স্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করা হয়।’’
কুশল চুপ করে থাকে। সে জানে, পৃথিবীর আদিকাল থেকে, যবে থেকে প্রাণের সৃষ্টি, আরও ভালো করে বললে, প্রাণ থেকে অপর প্রাণের সৃষ্টি, তবে থেকেই যৌনতা প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেই নির্লজ্জ সত্য। অন্তত যে সব প্রাণী যৌন জননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে। তবে, মানুষ যেমন যৌনতাকে ব্যবসা থেকে শারীরিক বিনোদন, সমস্ত কাজে ব্যবহার করে থাকে, অন্য কোনও প্রাণী যৌনতাকে সে–ভাবে ব্যবহার করে না।
যযাতিদা বললেন, ‘‘এবার তোকে বলি সাম্প্রতিক সময়ের একটি কথা। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পুরনো দস্তাবেজ থেকে যিশু খ্রিস্টের জীবনী নিয়ে রচিত একটি পুঁথি উদ্ধার হয় ২০১৪ সালে। আরামিক ভাষায় লেখা ওই পুঁথিটার নাম ‘দ্য লস্ট গসপেল’ বলে ধারণা পুরাতাত্ত্বিকদের।’’
কুশল তাকিয়ে থাকে যযাতিদার দিকে। কোনও কথা বলে না।
যযাতিদা হাসিমুখে বললেন, ‘‘পুঁথিটির পাঠোদ্ধার করেন ইতিহাসবিদ ব্যারি উইলসন ও যিশু–বিশেষজ্ঞ সিমচা জ্যাকোবোভিচ। ওই পুঁথিতেই লেখা রয়েছে যিশুর বিয়ের কথা। দু’হাজার বছর আগে মেরি ম্যাগডালেনকে বিয়ে করেছিলেন যিশু। তাঁদের দুটি সন্তানও হয়েছিল। ম্যাগডালেন ছিলেন যিশুরই প্রিয় শিষ্যা। চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্টানটাইন ও চার্চ মিলিতভাবে এ বিষয়ে যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করে দেয়।’’
কুশলের চোখে কৌতূহল।
এবার যযাতিদা বললেন আসল কথাটা। বললেন, ‘‘আমরা যাঁকে মেরি বলে জানি, জানি যিশুর মা হিসাবে, তিনি যিশুর মা নন, তিনিই আসলে মেরি ম্যাগডালেন। আসলে যিশুর স্ত্রী।’’
কুশল কিছু বলে না। বলার কিছু নেই। কত বছর আগের ঘটনা! আজ নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। তবু গবেষকরা চেষ্টা করেন সঠিক তথ্য আবিষ্কারের। এই তথ্যও হয়তো তেমনই একটি আবিষ্কার। হয়তো চার্চ বা অনেক খ্রিস্টান আহত বোধ করতে পারেন। কিন্তু, একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। বরং, সত্যকে স্বীকার করে নিলেই প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায়। সত্যের মধ্যে এক ধরনের পবিত্র আনন্দ আছে, যার তুলনা জগৎ–সংসারে নেই!
যযাতিদা অবশ্য কুশলের মনের গভীরে থাকা বিশ্লেষণের দিকে গেলেন না। বললেন, ‘‘পরবর্তী কালে চার্চ নতুন করে বাইবেল লেখে। সেখানে ম্যাগডালেনকে গণিকা হিসেবে দেখানো হয়। কারণ, ম্যাগডালেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ও সন্তান জন্মের খবর চেপে যেতে চেয়েছিল চার্চ।’’
এবার কুশল মুখ খুলল। বলল, ‘‘মধ্যযুগের চার্চ কম অত্যাচার করেনি মানুষের ওপর। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে সাধারণ মানুষের ওপরই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিত। মানুষ যাতে স্বাধীন চিন্তাভাবনা করতে না পারে, কখনও চার্চের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে, তাই নিয়ম–শৃঙ্খলার বেড়াজালে মানুষকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। গ্যালিলিওদের পর্যন্ত মাথা নত করতে হয়েছিল। শেষে ইউরোপে রেনেসাঁস এসে চার্চের ভণ্ডামো এবং নিষ্ঠুরতা থেকে মানুষকে রক্ষা করে। এতদিন পরে এই একুশ শতকে অবশ্য গ্যালিলিও সম্পর্কে মূল্যায়ন ভুল ছিল বলে চার্চ স্বীকার করেছে।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘চার্চ বা খ্রিস্টান ধর্মকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই। মনে রাখবি এ ধরনের ভণ্ডামো পৃথিবীর প্রায় সব ধর্ম বা উপাসনালয়েরই রয়েছে। নিজেদের মহত্ত্ব প্রমাণ করতে যাবতীয় অন্যায় আর অবিচারের বোঝা চাপিয়ে দেয় সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের ওপর। আর নিজেরা অপরাধ থেকে ব্যভিচার, সবই অবলীলায় করে যায়। এ–সব করে থাকে ধর্মগুরুরা।’’
কুশল কিছু বলল না।
সে কিছু না বললেও তার মনের কথা যেন টের পেলেন যযাতিদা। হেসে বললেন, ‘‘যদিও চার্চের রোষ থেকে যিশুর বংশধরদের রক্ষা করতে একটি সংগঠন তখন গড়ে ওঠে। সেই সংগঠনে ছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সান্দ্রো বত্তিচেল্লি, রবার্ট বয়েল, আইজাক নিউটন ও ভিক্টর হুগো।’’
কুশল চুপ করে তাঁর কথা শুনতে থাকে।
তিনি বললেন, ‘‘আধুনিক চার্চ কী মনে করে জানিস? স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক বৈধ। কিন্তু, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক পাপ। কিন্তু, এ কথা শুনে রাখ, মধ্যযুগে অসংখ্য পতিতালয় গড়ে তুলেছিল এই চার্চই। সেখানে নিশ্চয়ই শরীরকে পুজো করা হত না!’’ একটু থেমে তিনি ফের বললেন, ‘‘ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ সম্পর্কেও এমন অনেক কথা শোনা যায়। তবে তা নিয়ে বেশি আলোকপাত করা যায় না ধর্মীয় মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর জন্য। যাঁরা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলেন, এই তথাকথিত ধর্মের ধ্বজাধারীদের সৌজন্যে তাঁদের পরিণাম ভালো হয়নি।’’
কুশল নীরবে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘তা হলে কী বুঝলি? সেক্স–ই সত্য। এর চেয়ে বড় সত্য নারী–পুরুষের জীবনে আর কিছু নেই। শুনে রাখ, প্রতিটি মানুষের জীবনে খাওয়া আর বাথরুম করার মতো সেক্সও অত্যাবশ্যক একটি ক্রিয়া। এটা করা অন্যায় নয়, বরং উচিত। শরীর ও মনের জন্যই করা উচিত।’’
কুশল কিছু বলতে পারে না।
যযাতিদা কিন্তু চুপ করে থাকলেন না। বললেন, ‘‘তাই তোরও উচিত ছিল এর মধ্যে কোনও মেয়েকে খুঁজে নেওয়া।’’ একটু থেমে চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘‘এখনও সময় আছে।’’
এই রে— এখন তাকে নিয়েই পড়লেন যযাতিদা! কী করা যায়? বুঝতে পারে না কুশল। শেষে সব কিছু লঘু করে দিতে হাসিমুখে বলে, ‘‘সেক্স পার্টনার?’’
যযাতিদাও হেসে ফেললেন। বললেন, ‘‘অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট।’’
কুশল গম্ভীর গলায় বলল, ‘‘যযাতিদা, আমি তোমার মতো এখনও আধুনিক মনের হতে পারিনি। এখনও আমার মধ্যে এ–ব্যাপারে সাহসী আচরণ করার ক্ষমতা আসেনি।’’
যযাতিদা একটু ক্ষুব্ধ হলেন যেন। বললেন, ‘‘কুশল, তোর বয়স কিন্তু কম হয়নি। এই ধরনের কথা বলতে তোর লজ্জা হওয়া উচিত।’’
কুশল গম্ভীর গলায়ই বলে, ‘‘বলতাম না। তুমি বললে বলে বললাম। আসলে—।’’
যযাতিদা তাকালেন কুশলের দিকে। জানতে চাইলেন, ‘‘আসলে কী?’’
কুশল বলে, ‘‘আসলে এই সময়ের ক্ষেত্রে আমার নিজেকে কেমন যেন বড় বেমানান মনে হয়।’’
যযাতিদা কুশলের মাথায় হাত রাখেন। চুলে হাত বুলিয়ে দেন। বলেন, ‘‘না রে, ব্যাপারটা তেমন নয়। তোর এ কথা মনে হচ্ছে শুধুই আর্থিক কারণে। তুই যে–দিন ভালো চাকরি পেয়ে যাবি, ভালো মাইনে পাবি, দেখবি তোর মনে অনেক জোর চলে আসবে। তোর জীবনযাত্রাও বদলে যাবে। আর সে–দিনই—।’’ যযাতিদা চুপ করে গেলেন।
কিন্তু, কুশল কিছু বলল না।
যযাতিদা বললেন, ‘‘সে–দিনই দেখবি, তোর নিজেকে এই সময়ের কাছে আর বেমানান মনে হচ্ছে না।’’ থেমে গেলেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত বাদে ফের বললেন, ‘‘আসল কথা হল পেশা। আমাদের দেশে পুরুষ পেশাহীন থাকতে পারে না। পেশাহীন হলেই তার পৌরুষ প্রতি মুহূর্তে ধাক্কা খায়।’’
কুশল প্রশ্ন করে, ‘‘আর অন্য দেশে?’’
যযাতিদা কুশলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘‘অন্য দেশ মানে পশ্চিমি দেশগুলিতে আবার অন্য ছবি দেখা যায়। সেখানে পুরুষের মতো মহিলারাও পেশাহীন থাকতে চায় না। তারাও নিজেদের জীবন স্বাধীন ভাবে নিজের মতো করে চালাতে চায়। চালিয়েও থাকে।’’
কুশল কিছু বলে না।
যযাতিদা বললেন, ‘‘তবে আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের ধারণারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন সেদিন এক মরাঠি অভিনেত্রীর একটি সাহসী সাক্ষাৎকার দেখলাম একটি ম্যাগাজিনে। তিনি বলেছেন, উই আর লিভিং অ্যাট আ টাইম হোয়েন উওম্যান আর নট এক্সপেকটেট টু বি সতী–সাবিত্রীজ। আই ডোন্ট নো এনি ফ্রেন্ড অফ মাইন হু হ্যাজ নট হ্যাড সেক্স বিফোর ম্যারেজ।’’
কুশল চুপ করে থাকে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘এটা যদিও একুশ শতক। তবু, হ্যাঁ— এই সময়েও বলতে সাহস দরকার হয়। এখনও এমন সাহসী কথা বলা কঠিন। অন্তত কোনও ভারতীয় মহিলার পক্ষে। তাঁর সাহসকে কুর্নিশ করি।’’
কুশল কিছু বলে না।
যযাতিদা আবারও বললেন, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে, ওই ম্যাগাজিনেই পড়েছি, তিনি একজন ব্রিটিশ মিউজিসিয়ানকে বিয়ে করেছেন। হয়তো তাই পশ্চিমি প্রভাব তাঁর ওপর বেশি পড়েছে। তবু, এ কথা ভুললে চলবে না, তিনি একজন ভারতীয় অভিনেত্রী। শুনেছি তিনি নাট্যজগৎ থেকে উঠে এসেছেন। সুতরাং সিনেমার অভিনেত্রী বলে তাঁকে ফেলনা ভাবিস না!’’
কুশল জিজ্ঞাসা করে, ‘‘ফেলনা ভাবব কেন?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘সাধারণত সিনেমার অভিনেত্রীদের সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। হয়তো তার সবটাই গুজব নয়। তবে এইসব ঘটনা শুধু সিনেমার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই রয়েছে। কিন্তু, সিনেমা যেহেতু আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় একটি মাধ্যম, তাই সিনেমার ব্যাপার নিয়ে সকলের এত কৌতূহল। আর, যিনি এ–সব কথা বলেছেন, তাঁর কথা পড়ে কখনও মনে হয়নি, তিনি অন্তঃসারশূন্য কোনও মহিলা। জীবন নিয়ে তাঁর নিজস্ব একটা বোধ আছে। যথেষ্ট গভীর ভাবনাচিন্তার মহিলা তিনি। আমার তাই মনে হয়।’’
কুশল মাথা নাড়ে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘তাঁর আরও কয়েকটা কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে। তিনি বলেছেন, আই হ্যাভ ডান আ ন্যুড সিন ফর অ্যান ইংলিশ ফিল্ম। ইন ফ্যাক্ট, আই রোট অ্যান আর্টিকেল অ্যাবাউট হাউ স্ট্রংলি আই ফেল্ট অন দ্য সাবজেক্ট অফ ন্যুডিটি। অ্যাট দ্য সেম টাইম, আই উড নট অ্যালাউ মাই পারসোনাল স্পেস টু বি ভায়োলেট বাই এনি ইন্ট্রুসিভ অ্যাটেনশন। সাম টাইম এগো, সামবডি হ্যাড পোস্টেড আ ন্যুড সেলফি অন দ্য ইন্টারনেট ক্লেইমিং ইট ওয়াজ মি। দ্য গার্ল ডিড নট ইভেন লুক লাইক মি। অ্যান্ড দ্য কন্ট্রোভার্সি ডাইড আ ন্যাচারাল ডেথ।’’
হাসিমুখে যযাতিদা তাকালেন কুশলের দিকে। কুশল হাসল।যযাতিদা জানতে চাইলেন, ‘‘কী? সাহসী কথা নয়?’’
হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দেয় কুশল।
যযাতিদা বললেন, ‘‘বড় স্পষ্ট কথা বলেন তিনি। বলেছেন, আই ক্যান নট সি মাইসেল্ফ জাস্ট লুকিং প্রেটি অ্যান্ড ডান্সিং। তা হলে বুঝতে পারছিস ভারতীয় মেয়েদের দর্শন–বোধ কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে!’’
কুশল বলে, ‘‘শুধু একটা ব্যাপার ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে। এটা কেমন দর্শন, যা শুধু সেক্সকেই গুরুত্ব দেয়?’’
যযাতিদা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কুশল বলে, ‘‘আসলে আমি বলতে চাইছি, জীবনটা কি শুধুই সেক্স ওরিয়েন্টেড? আর কিছু কি নেই জীবন–দর্শনে? অন্তত যে মহিলাদের দর্শনের প্রশংসা করছ তুমি, আমি তাঁদের কথা বলছি।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘তা কেন? এটা অবশ্যই দর্শন। তবে টোটাল ফিলজফি নয়। একটা অংশ মাত্র। অন্য অংশে জীবনের অন্য দিকগুলি নিশ্চয়ই রয়েছে।’’
মাথা নেড়ে হাসিমুখে কুশল বলে, ‘‘হ্যাঁ, একটা অংশ। তা হলে তাঁদের অন্য অংশটা নিশ্চয়ই যথেষ্ট মজবুত। তাই তাঁরা ওই অংশে এত সাহসী হতে পারছেন। কিন্তু, আমাদের মতো যাদের অন্য অংশগুলির অবস্থা বেশ শোচনীয়, তাদের কাছে ওই অংশে সাহসী হওয়া দূরের কথা, সেই অংশের কথা ভাবাটাই বিলাসিতা নয় কি?’’
যযাতিদা হেসে বললেন, ‘‘বুঝেছি। —ভেঙে পড়িস না। মিলিয়ে নিস, সব বদলে যাবে। তুইও খুব তাড়াতাড়ি চাকরি পাবি। পাবিই। সে দিন আমার কথা মিলিয়ে নিস।’’
কুশল হাসে। যযাতিদার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ভালোও লাগে তাঁর কথা শুনতে। (ক্রমশ)