নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘূর্ণিদুর্গত উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত লবণ সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল বিনাধান-৮ ও ১০ এবং বিনাগম-১ ও বিনাবাদাম চাষ করলে অতিরিক্ত প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে। করোনা ভাইরাস ও আম্ফান পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব শস্যের চাষাবাদ হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। যা দেশের কৃষি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশের ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এর প্রভাবে সাগরের উচ্চতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কাও। দেশের পরিবেশবিষয়ক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল নাগাদ এক মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে। এতে সার্বিক উৎপাদন শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে। সিডর, আইলা, নার্গিস, আম্ফান নামক ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। এর ফলে সৃষ্ট খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় অতীতে চড়া দামে দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিদেশ হতে খাদ্য আমদানি করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক বিনাধান-৮ এবং বিনাধান-১০-এর উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে দেশের ২৬টি জেলায় প্রায় ১১শ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরগুনায় ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নতুন করে অনেক এলাকা প্লাবিত হওয়ায় লবণাক্ত পানি আবাদি জমিতে প্রবেশ করেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে।
উপকূলীয় জেলাগুলোতে লবণাক্ততার কারণে ধান চাষের পরিবর্তে অধিক হারে চিংড়ি ও লবণ চাষ করা হচ্ছে। উপকূলীয় জেলাসমূহের জমিতে লবণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিস্তীর্ণ জমিতে ধান চাষ হয় না বললেই চলে। বিজ্ঞানী ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, দেশের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি এখনও লবণাক্ত। এই বিপুল পরিমাণ জমি ধান চাষের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে, দেশের খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা থাকবে না।
বিনার মহাপরিচালক বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আশার বাণী নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিনার বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে ২০১০ ও ২০১২ সালে বোরো মৌসুমের জন্য লবণ সহিষ্ণু দুটি ধানের জাত ‘বিনাধান-৮’ যা ৮ থেকে ১০ ডেসি সিমেন/মিটার এবং ‘বিনাধান-১০’ যা ১০ থেকে ১২ ডেসি সিমেন/মিটার মাত্রায় লবণ সহনশীল।
উল্লেখ্য, লবণ সহিষ্ণু ধানের এই দুটি নতুন জাত উদ্ভাবনেরও প্রধান গবেষক তিনি। ড. মির্জা আশা ব্যক্ত করে বলেন, লবণ সহনশীল জাত চাষ করা হলে শতকরা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ লবণাক্ত এলাকা ধান চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। উল্লিখিত জাত দুটিতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অনেক কম। বর্তমানে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে ৪ থেকে ২০ ডেসি সিমেন/মিটার লবণাক্ততার কারণে বোরো ধান চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। বিনা ও ব্রি উদ্ভাবিত লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত চাষ করলে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ অর্থাৎ ৩ লাখ হেক্টর জমি ধান চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে এবং লবণাক্ত এলাকায় জাতটির গড় ফলন প্রায় সাড়ে ৫ টন। যা চালে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৩ টন পাওয়া যাবে। এ হিসেবে প্রায় ১০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে।
এ ছাড়াও বর্তমানে মধ্যম লবণ মাত্রায় প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হচ্ছে। এ সব এলাকায় লবণাক্ততার কারণে স্থানীয় বা উফশী জাত হতে গড়ে প্রায় হেক্টর প্রতি দেড় থেকে ২ টন ধান উৎপাদিত হয়। প্রায়শই এসব জমি অনাবাদি বা পতিত থাকে। এতে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার লবণাক্ত এলাকায় অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার লবণাক্ত এলাকায় জাতটির চাষ করলে সার্বিকভাবে অতিরিক্ত প্রায় ৪০ লাখ টন চাল উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বিনার পরিচালক (প্রশাসন) বিনাচিনাবাদাম ও বিনাগমের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় বিনাবাদাম ও বিনাগম চাষ করলে ৫ লাখ টন বাদাম এবং ২০ লাখ টন গমের অতিরিক্ত ফলন হবে। বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, চাষি বা বীজ ব্যবসায়ীরা চাইলে আমাদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন। বিএডিসির কাছেও প্রচুর বীজ রয়েছে। চাষিদের কাছে বীজ রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমেও চষিরা বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন।