দৈনিক প্রত্যয় ডেস্ক:কিশোরগঞ্জে সোমবার পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হওয়া ১৪১ জনের মধ্যে ৯৩ জনই স্বাস্থ্য বিভাগের লোক। যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৬৬ শতাংশ।
এরমধ্যে ৪১ জন ডাক্তার, ১০ জন নার্স ও ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। ১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনা উপসর্গ গোপন রেখে চিকিৎসা নিতে আসায় এবং চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর পর কিশোরগঞ্জ জেলাকে করোনা ঝুঁকি প্রবণ জেলা হিসাবে ‘হট স্পট’ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে এ জেলায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা।
শনিবার কিশোরগঞ্জ জেলাকে ‘হট স্পট’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আর এ ঘোষণার পর জনমনে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। আলোচনায় উঠে আসছে পরিস্থিতি ক্রমাবনতির নানা কারণ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হওয়ায় এমন অবাঞ্ছিত অবস্থার শিকার হতে হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে প্রথম ২৬ মার্চ ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা কিশোরগঞ্জ জেলার লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করে।
ওইসব স্থানে কার্যকর লকডাউন পালন না হওয়ায় পরবর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা সরকারি ছুটি বর্ধিত করার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন কিশোরগঞ্জে।
প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ সেভাবে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগেই বাইরে থেকে মানুষ আসে। মানুষের চাপ স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থায় বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
আর বাইরে থেকে আসা এ বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। হাট-বাজার, অফিস-আদালত দাপিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি নানা অসুখ নিয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ছুটে বেড়ায়। উপসর্গ গোপন রেখে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নেয়।
বহিরাগতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের মুসলিম পাড়ার ঢাকা প্রবাসী সেলিম মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী বাড়িতে এসে করোনার উপসর্গ নিয়ে ৬ এপ্রিল মারা যান। তার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হলে পরীক্ষার ফলাফলে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে।
পরবর্তীতে তার স্ত্রী, মা ও ভাইয়ের শরীর থেকেও নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হলে তাদের শরীরেও করোনা সংক্রমণ সনাক্ত হলে নড়ে-চড়ে বসে স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন।
আর এ পরিবারের সদস্যদের নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়েও সংক্রমণের শিকার হন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীগণ। করিমগঞ্জ উপজেলার ওই মারা যাওয়া ব্যবসায়ী পরিবারের তিন সদস্য, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীসহ ১৬ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
আর তখন থেকেই একই কায়দায় এ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় করোনা সংক্রমণের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে বলে স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কিশোরগঞ্জের করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারণে এ জেলায় করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঘটেছে।
এ ছাড়া তিনি চিকিৎসক, নার্স- স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ জেলায় মোট ১৪১ জন করোনা সংক্রমণের শিকার হওয়ার কথাও নিশ্চিত করেছেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবাসী লোকজন স্থান ত্যাগ করে চলে আসায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এদের মধ্যে নানা অসুখে আক্রান্তরা উপসর্গ গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসায় এদের সংস্পর্শে যাওয়া চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা করোনা সংক্রমণের শিকার হচ্ছে।
একই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কিশোরগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা. বাদল ওয়াহাব বলেন, করোনা সংক্রমণ আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিশোরগঞ্জ জেলায় ফিরে আসা লোকজন প্রকৃত উপসর্গ গোপন করে হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসকদের সংস্পর্শে যাওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি পরিস্থিতি উত্তরণে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উপযুক্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি লোকজনের স্থান পরিবর্তনের প্রবণতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
ডা. বাদল ওয়াহাব মনে করেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এক সময় সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।