বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:পশ্চিমবাংলার জেলার নেতাদের আর নামেই ‘কমরেড’ থাকলে চলবে না। তাঁরা যে কমিউনিস্ট, অর্থাৎ সত্যিকারের কমরেড, সেই প্রমাণ এবার দিতে হবে। আর সেই নির্দেশই জেলা নেতাদের পাঠিয়ে দিয়েছে আলিমুদ্দিন। রাজ্যে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর কমরেডরা যেন একটু সুখেই থাকতে শুরু করেছিলেন। ফলে মানুষের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াকু মনোভাবকে গ্রহণ করেছিল রাজ্যবাসী। তাই বাংলার রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে যায়। মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা চলে যায় তৃণমূল অধীনে।
তার পরও ১০ বছর কেটে যেতে আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। কিন্তু ৩৪ বছরের অভ্যেস কাটিয়ে উঠতে পারেননি কমরেডরা। তাই হাতের তালুর মতো চেনা বাংলার জমিজায়গা আজ অনেকটাই অচেনা হয়ে গিয়েছে তাঁদের কাছে। ফলে সিপিএমের পক্ষেও সম্ভব হয়নি হারানো জমি ফিরে পাওয়া। আজকের সিপিএম নেতারা শুধু যেন তাত্ত্বিক নেতাই হয়ে গিয়েছেন। মিটিং–মিছিলে বড় বড় কথা বলতে তাঁরা ভালো বাসেন। সংবাদ মাধ্যমের কাছে মহৎ কথা বলতে পছন্দ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ আজ অধিকাংশ নেতারই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। অবস্থা এমনই যে, অনেক জায়গার বাসিন্দারা সেই অঞ্চলের কমিউনিস্ট নেতাদের নামই মনে করতে পারেন না এখন।
এইসব ঘটনার ছাপ পড়েছে দলের সদস্য সংখ্যায়ও। হু–হু করে কমছে রাজ্যে সিপিএমের সদস্য। অবস্থা এখন এমনই যে, কোনও মিটিং–মিছিলে সাধারণ মানুষকে সে ভাবে অংশ নিতে আর দেখা যাচ্ছে না। সিপিএমের কর্মসূচি নিয়েও তাঁদের তেমন একটা আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে না। স্বভাবতই ক্ষোভ গোপন রাখতে পারেননি রাজ্যে শীর্ষস্তরের সিপিএম নেতারা। তাই এবার জেলাগুলিতে শীর্ষসারির নেতা থেকে নীচুতলার নেতা ও কর্মীদের পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের যেতে হবে মানুষের কাছে। তাঁদের সুবিধে ও অসুবিধে, অভাব ও অভিযোগ জানতে হবে। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের অভাব ও অভিযোগ জেনে দাবি আদায়ে পথে নেমে আন্দোলন করতে হবে।
জানা গিয়েছে, সিপিএমের প্রধান কার্যালয়ের নেতারা জেলাস্তরে উপর তলার নেতাদের জানিয়েছেন, ‘পার্টি অফিসে সকলেরই সম্মান আছে। অনেকেই অনেক পদে রয়েছেন। তাই সুযোগ মতো মার্কস ও লেনিনের তত্ত্ব নিয়ে অনেক বক্তব্য তারা পেশ করেন। আর ঘরে বসে থাকেন করোনা মহামারীর সময়। এই সময় পথে নেমে সাধারণ মানুষের পাশে থাকা উচিত ছিল। তা না থেকে তাঁরা শুধুই ফেসবুক–সহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলিতে কেবল জ্ঞান বিতরণ করে গিয়েছেন। তাতে সাধারণ মানুষের মন গলেনি। তাই এবার পথে নেমে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। পথে নেমে তাঁদের জন্য লড়াই করতে হবে। না হলে পদ ছেড়ে দিতে হবে।’
সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের তরফে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেক পদাধিকারী সিপিএম নেতার কাজের মূল্যায়ন করা হবে। তাতে যদি সেই নেতাদের কাজ যথাযথ মনে না হয়, তা হলে তাঁকে সিপিএম নেতা বলে আর মনে করা হবে না। মনে মনে সিপিএম করি, এ কথা ভেবেই তাঁদের কাটাতে হবে। বলা বাহুল্য, এই নির্দেশের কথা জেনে গিয়েছেন জেলাস্তরের সিপিএম নেতারাও। আর সেই নির্দেশ যে তাঁদের খুব একটা সুখী করতে পারেনি, সে কথা বলাই বাহুল্য। সিপিএম নেতার পরিচয় আদৌ আর থাকবে কিনা, তা নিয়ে অনেকে রীতিমতো আশঙ্কায় রয়েছেন।
তবে সেইজন্য আলিমুদ্দিন মোটেও নমনীয় হচ্ছে না। পুরসভা ও বিধানসভা —দুটো নির্বাচন রয়েছে সামনে। সেই দুটো নির্বাচনে খুব ভালো ফল করার আশা করছে না তারা। তবে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার দিকে কড়া নজর থাকবে তাদের। যতটা সম্ভব সেই ভোট বাড়িয়ে নেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেই এখন সচেষ্ট হয়েছে সিপিএম। লোকসভায় এখন সিপিএমের কোনও প্রতিনিধি নেই। রাজ্যসভায় রয়েছেন কেবল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। বিধানসভায় প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ২৬। সেই সংখ্যাও একজন কমে ২৫–এ নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় সামনের দুটো নির্বাচনেও যদি ভরাডুবি হয় দলের, তা হলে বাংলায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হবে তাদের। তাই এখন থেকেই সিপিএম জনসংযোগে জোর কদমে নেমে পড়তে চাইছে।