বিশেষ প্রতিবেদন:শুভেন্দু অধিকারী কি তৃণমূল ছাড়ছেন? পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে প্রায়ই এমন প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গোটা রাজ্যে যখন প্রতিদিন শয়ে শয়ে বিজেপি নেতা, কর্মী–সমর্থক তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন, তখন এমন প্রশ্নে অনেকেই নড়েচড়ে বসছেন। তবু জল্পনাকে এড়ানো যাচ্ছে না। কারণ, সরকার এবং শাসক দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁর অনুপস্থিতিই সেই চর্চায় ইন্ধন জোগায়। সেই চর্চা গতি পায়, যখন দেখা যায়, শুভেন্দু একক উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। তবে, যত প্রশ্ন উঠুক বা জল্পনা চলুক না কেন, শুভেন্দু অধিকারী কিন্তু ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। অথবা এমন বিতর্কিত প্রশ্নের সামনে পড়লে সমস্ত বিষয়টিই বারবার এড়িয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু এবার তাঁকে দেখা গেল রীতিমতো অন্য ভূমিকায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের সামনে অস্বস্তিতে না পড়ে বরং স্পষ্ট জবাব দিলেন, ‘আমাদের দলে একজনই নেত্রী। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতো নেত্রী বাংলায় আর একজনও কি আছেন? তাই তিনি থাকলে অন্য কোনও নেতার প্রয়োজন নেই।’ এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কারণ, সমস্ত জল্পনায় জল ঢেলে দেওয়ার পক্ষে এই মন্তব্যই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তার পরই তিনি একটি ইঙ্গিতবহ কথা বলেছেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন তৃণমূলের কর্মসূচিগুলিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না? শুভেন্দু একটু রসিকতা করে বলেন, ‘হয়তো শারীরিক ভাবে না–ই পেলেন, অথবা চারমাস পর পেলেন, তা কী এসে গেল?’ তার পরই তিনি নিজের বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করে দেন, ‘সেইজন্য তো কোনও কাজ আটকে নেই! সমস্ত কাজই তো যথারীতি চলছে।’
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, শুভেন্দুর এই কথাতেই রয়েছে প্রচ্ছন্ন অভিমান। তাই এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সেই আলোচনার আরও কারণ ছিল। কারণ, ওই কথা বলেই শুভেন্দু থেমে যাননি। সেদিন আরও বলেছেন, ‘এখানে একজন ব্যক্তির ওপর কিছু নির্ভর করে না। একা শুভেন্দু না থাকলেও ক্ষতি নেই। কারণ, আরও অনেক নেতা রয়েছেন! তাঁরাই সব সামলে নিতে পারবেন।’ এর পরই শুভেন্দুকে নিয়ে ইতি–উতি ফের জল্পনা শুরু হয়েছে। তা হলে তৃণমূলে যে তিনি অবহেলিত, সে কথাই কি তিনি বোঝাতে চাইছেন? এর জবাব অবশ্য পাওয়া যায়নি। কারণ, শুভেন্দু তা নিয়ে আর মুখ খোলেননি।
এমনিতেই শুভেন্দু সাংবাদিকদের সামনে খুব বেশি মুখ খোলেন না। দলের সংগঠনকে মজবুত করা আর কর্মসূচিগুলিতে কর্মী–সমর্থকদের নিজের কথা বলা ছাড়া সাংবাদিকদের সামনে তৃণমূলের অন্য নেতাদের তুলনায় কমই আসেন। তবু শুভেন্দুর সাংগঠনিক শক্তির জোরেই বামেদের উড়িয়ে দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূল নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এক সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু তৃণমূলে দলনেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যত উঠে এসেছেন, নেত্রীর কাছ থেকে ততই যেন দূরে সরে গিয়েছেন শুভেন্দু। গত লোকসভা নির্বাচনের পরই নিজের দল তৃণমূলের থেকে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে তাঁর। তার পরই তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
এমনকী, দল পরিচালনায় ২১ সদস্যের কমিটির সদস্য হয়েও তার প্রথম বৈঠকেই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত ছিলেন শুভেন্দু। এ ছাড়াও দলের বেশির ভাগ কর্মসূচিতে তাঁকে আর দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, সরকারি অনুষ্ঠানগুলিতেও তিনি যান না। বরং, নিজের উদ্যোগে কিছু কর্মসূচি নেন বা অনুষ্ঠানে যান। তাই দলের তরফে তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সরকারি কর্মচারী সংগঠনের মেন্টর পদ থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পর শুধু শুভেন্দুই নন, তাঁর পরিবারের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীকেও হলদিয়ার ঠিকাদারদের সংগঠনের শীর্ষপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতির পদ থেকে শুভেন্দুর অনুগামী এক নেতাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে দলে যেন ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন শুভেন্দু। সেইজন্যই রাজ্য রাজনীতির আলোচনায় এক বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছেন তিনি। পাশাপাশি বিজেপিতে তিনি যোগ দিতে পারেন বলে যে রটনা রাজ্যে ছড়িয়েছে, তার পক্ষে শুভেন্দু যেমন কিছু বলেননি, তার বিরোধিতাও করেননি। ফলে জল্পনা এখনই থেমে যাচ্ছে না বলেই মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।