বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের মাটি মজবুত রয়েছে বলে যে দাবি করে থাকেন শাসক দলের নেতারা, বীরভূমের একটি ঘটনা সেই দাবি ঘিরে প্রশ্ন তুলে দিল। যেহেতু বিধানসভা নির্বাচন ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তাই এখন বীরভূমের ব্লকে ব্লকে প্রায়ই কর্মিসভা করে চলেছেন জেলার সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তেমনই একটি সভায় ফের অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল তাঁকে। আর সেই প্রশ্নের সামনে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ নন, খোদ তৃণমূল কর্মীরাই।
বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলের প্রতাপের কথা জেলার সকলেই জানেন। এমনকী, রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মানুষেরও তা অজানা নয়। কিন্তু সেই প্রতাপশালী অনুব্রতকে কাছে পেয়ে কর্মীরা যে ভাবে নিজেদের ক্ষোভ জানালেন, তাতে বিস্মিত হয়ে গেলেন তিনি নিজেও। তাঁর কাছে বহু কর্মীই যে সব অভিযোগ জানিয়েছেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— তাঁদের অনেকের জব কার্ড বাতিল হয়ে গিয়েছে, সরকারি আবাস প্রকল্পে বাড়ি তৈরির অনুদান আটকে গিয়েছে, কর্মীদের সমস্যায় স্থানীয় নেতারা কোনও রকম সাহায্য করেন না প্রভৃতি। তবে এত অভিযোগ শোনার পরও অনুব্রত মেজাজ হারাননি। বরং সকলের অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছেন। কিন্তু মনে মনে তিনি কী ভেবেছেন, সে বিষয়ে কারও কাছে কোনও আলোকপাত করেননি।
ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, ঠিক কয়েকদিন আগেই তিনি একই ভাবে আর এক কর্মিসভায় দলের কর্মীদের ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই সময় কর্মীরা তাঁর কাছে গ্রামের রাস্তাঘাটের ভাঙাচোরা অবস্থা নিয়ে হাজার এক অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, রাস্তা ঠিক করার দিকে কারও নজর নেই। আর যদি বা কখনও ঠিক করা হয়, কয়েকদিনেই তা ফের ভেঙে যায়। সেদিন কিন্তু কর্মীদের ক্ষোভের কথা জেনে রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন অনুব্রত। তবে দলেরই কর্মীদের ক্ষোভ তাঁকে সে দিনই কিছুটা চিন্তায় ফেলে থাকতে পারে। সূত্রের খবর, তিনি গোপনে চারদিকে কর্মীদের অবস্থা নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন তার পরই। তাই এদিন কর্মীদের নানা অভিযোগের মুখোমুখি যে তাঁকে হতে হবে, তা হয়তো কিছুটা অনুমান করেছিলেন। তাই মেজাজ সংযত রেখে তিনি সকলের অভিযোগই শুনেছেন।
এদিন আউশগ্রামের ১ নম্বর ব্লকের কর্মিসভায় অংশ নেন আউশগ্রাম, বেরেণ্ডা ও উক্তার তৃণমূল নেতা ও কর্মীরা। সভায় নেতারা নানা ভাবে দলের সাফল্যের কথা তুলে ধরলেও কর্মীরা রীতিমতো চড়া সুরেই সমালোচনা করেন। অনুব্রত মণ্ডল ছাড়াও এদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা, বোলপুরের সাংসদ অসিত মাল, বিধায়ক অভেদানন্দ থান্ডার এবং ব্লক সভাপতি শেখ সালেক রহমানও। কিন্তু কর্মীদের ক্ষোভের সামনে সকলকেই অসহায় দেখায়। সভার শেষে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা এবং সাংসদ অসিত মাল রীতিমতো গম্ভীর মুখে সেখান থেকে চলে যান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনও জবাবই কেউ দেননি।
তবে, কর্মীদের সমস্ত অভিযোগ শোনার পরও ঠান্ডা মাথায় সকলকে তিনি নির্দেশ দেন, রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উন্নয়নের কথা জেলার সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে সকলকে। এ ব্যাপারে কোনও রকম শিথিলতা বরদাস্ত করা হবে না। জেলার প্রতিটি বিধানসভায় যাতে বিপুল ভোটে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে কর্মীদেরই। সভায় কর্মীদের কেউ কেউ পুলিশের অতিসক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সে বিষয়ে অনুব্রত জানান, তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে তাঁকে যেন খবর দেওয়া হয়। তিনিই এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।
এদিকে, এই ঘটনা নিয়ে জেলার বিজেপি নেতারা টিপ্পনি কাটতে দ্বিধা করেননি। তাঁদের বক্তব্য, দলের কর্মীদেরই যদি এত ক্ষোভ থেকে থাকে, তা হলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ যে কী পরিমাণে জমে রয়েছে, তা তৃণমূল নেতারা জানেন না। দলের কর্মীদের ক্ষোভের বিষয়েই যাঁরা খোঁজ রাখেন না, তাঁরা কী করে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বুঝতে পারবেন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে উপযুক্ত জবাবই পাবে তৃণমূল।