উপমন্যু রায়,
ব্যারাকপুরে ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে! সত্যিই চমকে ওঠার মতো খবরই বটে। বেশ কয়েকদিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম, এন্টালিতে বনবিড়াল, গঙ্গায় ডলফিন —আরও কত কী!
আমার অফিস সেক্টর ফাইভে। সেখানে তো কত ধরনের পাখি দেখছি রোজ। অফিস ব্যালকনির পাশেই রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা কেন্দ্র। তার ক্যাম্পাসে বিশাল একটি মাঠ রয়েছে। শহুরে দূষণে সেই মাঠের গাছপালা, ঘাসপাতা কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগত। এখন দেখি বেশ সতেজ। সেই মাঠেই যে অচেনা কত পাখি দেখি তার ইয়ত্তা নেই। বক, শালিখ, কোকিল ছেড়ে দিন, অচেনা লম্বা লেজ–সহ রং–বেরঙের কত পাখি আর তাদের ডাক। মন উদাস করে দেয়।
তা বলে ময়ূর! হ্যাঁ, সত্যিই তাই। ব্যারাকপুরে ফাঁকা স্কুলবাড়ির জানালায়, গাছে এখন ময়ূরের আনাগোনা। স্বভাবতই শহুরে মানুষের কৌতূহল তুঙ্গে। বাঁচোয়া লকডাউন চলছে। না হলে ময়ূরগুলির যে কী হাল হত, কে জানে! বন দফতর হয়তো ভালোই বোঝে ব্যাপারটা। তাই তারাও সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ওদের মতো করেই ওদের থাকতে দিন। বিরক্ত করবেন না।
আসলে যে কথাটা বলতে চাইছিলাম। টানা লকডাউনে প্রকৃতি কত বদলে গিয়েছে! রাস্তাঘাটে মানুষ তেমন নেই। কলকারখানা বন্ধ, গাড়িঘোড়া চলছে না। আকাশে বিমান নেই, রেললাইনে ট্রেন নেই। সত্যিই যেন অদ্ভুত সুন্দর হয়ে গিয়েছে আমাদের এই সভ্যতা।
একটু ভেবে দেখুন না, এক বছর আগেও এই সময় কত গরম পড়ে যেত। আমি তো বেশ মনে করতে পারি, পয়লা বৈশাখে যখন অফিস যেতাম, তখন ঘামে ভেজা জামা সারা শরীরে লেপ্টে থাকত। অফিসে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়তাম, যাতে এসি–র ঠান্ডায় শরীরটা শান্ত হয়! আর এখন—?
গরম যে পড়েনি, তা নয়। ব্যারোমিটারের পারাও বেশ উঠছে। কিন্তু এই গরম তো অসহ্য হয়ে ওঠেনি এখনও। মে পড়ে গেলেও রাতের দিকে আবার কখনও কখনও ঠান্ডাও লাগছে। ভাবা যায়! খোলা জানালা দিয়ে আসা বাতাস তো এখনও রাতের দিতে শিহরণ জাগাচ্ছে শরীরে। কবে ছিল এমন মে মাস?
রবীন্দ্রনাথের লেখায় পড়েছি, ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে।’ শরৎ কালে এখন কি আর হিম পড়ে? দুর্গাপুজোর সময় তো বেশ গরমই লাগে এখন। তবে কি রবীন্দ্রনাথ ভুল লিখেছিলেন? —না। ছেলেবেলায় তো শরতের ইঙ্গিত পেয়ে যেতাম হালকা ঠান্ডা বাতাসেই। রবীন্দ্র–সময়েও তাই বাতাসে হিমের পরশ লাগত শরতেই। আজ লাগে না। কিন্তু এখন?
আর এ–সব তো হয়েছে আমাদেরই জন্য। মানে লকডাউনের জন্য। তবে তা নির্দিষ্ট কোনও একটি জায়গায় লকডাউন নয়। গোটা পৃথিবী জুড়েই আজ লকডাউন। স্তব্ধ হয়ে রয়েছে জনজীবন। আর তাই যেন জেগে উঠেছে প্রকৃতি। আপন খেয়ালে সে যেন সেজে উঠতে শুরু করেছে।
তা হলে ভেবে দেখুন, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামে আমরা পৃথিবীটার কত ক্ষতি করে চলেছি! যখন আমরা থেমে যাচ্ছি, তখনই প্রকৃতি আবার সজীব ও সতেজ হয়ে উঠছে। তার মানে— লকডাউন করে আমরা প্রকৃতির উপকারই করেছি!
তবে আমরা কিন্তু প্রকৃতির কল্যাণের জন্য এই লকডাউন করিনি। আমরা এই লকডাউন করেছি নিজেদের স্বার্থে। কেন না, লকডাউন না করলে আমরা মরব। গণ হারে মরব। অর্থাৎ, বাঁচার জন্য এই লকডাউন করতে বাধ্য হয়েছে সারা পৃথিবী। আর আমাদের এই বাধ্য হওয়াটাই প্রকৃতির উপকার করে দিয়েছে।
তাই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই হবে আমাদের। হয়তো অনেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছেনও। এই যে ধীরে ধীরে পৃথিবীর তপ্ত হয়ে ওঠা, তা যে আমাদের সাধের এই সভ্যতার অভিশাপেই হচ্ছে, তা আমরা জানি। ভালো ভাবেই জানি। কিন্তু লোভ ও লালসা সেই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে দিচ্ছে না আমাদের। কিন্তু এই লকডাউন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের এই স্বার্থপরতা থেকে।
প্রকৃতির এই বদলে যাওয়াটা এখন অনেকেরই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সে দিন অফিসে কাজের ফাঁকে বন্ধ কাফে–তে আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছিল এই প্রসঙ্গ। ছিলাম আমরা তিনজন। পারস্পরিক দূরত্ব রেখেই। দেখলাম, একটা ব্যাপারে আমরা সকলেই সহমত। তা হল, শুধু আমাদের বাঁচার জন্য নয়, প্রকৃতির স্বার্থেও এই লকডাউন জরুরি ছিল।
শুধু তাই নয়, বছরে একবার করে লকডাউন করা গেলে মন্দ হত না। একজন বলল, সপ্তাহে একদিন করে লকডাউন করা যেতে পারে। আরেকজন বললেন, সপ্তাহে একদিন নয়। বছরে টানা একমাস। কিছুক্ষণ তর্কের পর আমরা সকলেই একমাসের লকডাউনে সহমত হলাম।
সত্যিই তাই। যদি বছরে একবার একমাসের জন্য পৃথিবী এমন লকডাউন মেনে নেয়, তা হলে প্রকৃতি কিন্তু অনেকটাই বিশ্রাম পায়। তবে গোটা পৃথিবীকে একই সময়ে ওই একমাস টানা লকডাউনে শামিল হতে হবে। জানি অনেক দেশই সহমত হবে না। অর্থের লোভ তাদের এই প্রস্তাবে রাজি হতে দেবে না। তবে আমার বিশ্বাস, সাধারণ মানুষ কিন্তু মেনে নেবে।
কেন না, এখন যে লকডাউন চলছে, তা করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য। আমরা তো মরতে চাই না। তাই আমাদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। তখন কিন্তু তা থাকবে না। লকডাউনের পিছনে উঁকি দেবে মৃত্যুভয়। খুচরো দোকানপাট, যেগুলি বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করে না, সে–সব খুলবে। মানুষ রাস্তায় বের হতে পারবে। তবে দূরে যেতে হলে, তাকে হেঁটেই যেতে হবে।
কারণ, সমস্ত ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকবে। মানে বাস–ট্রাম বা ট্রেন চলবে না। বিমান উড়বে না। কলকারাখানা বন্ধ থাকবে। অফিস–কাছারিও বন্ধ থাকবে। ফলে সেগুলিতে অনাবশ্যক এসি মেশিন বা জেনারেটর চলবে না। তবে পুলিশ–প্রশাসন কড়া থাকবে। রাস্তাঘাটে প্রাইভেট চারচাকা বা দু’চাকা নিয়ে বাঁদরামো করা চলবে না। তেমন ব্যক্তিদের ধরে ধরে লকআপে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে একমাসের জন্য। অবশ্য জরুরি সমস্ত পরিষেবাই চালু থাকবে এই সময়।
উৎসবের মতো হয়ে উঠুক এই লকডাউন পিরিয়ড। প্রতি বছর এই সময়টায় পৃথিবীর সব ধর্মের, ভাষার, জাতির মানুষ ছুটি কাটান উৎসবের মেজাজে। খাওয়াদাওয়া, ঘুম, বইপড়া, সিনেমা দেখা, প্রেম করা— মননের গভীরতায় সকলেই ডুবে যান আপন খেয়ালে।
যদি পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে এই লকডাউনে রাজি করানো যায়, সত্যি বলছি, পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। তার আয়ুও বেড়ে যেতে পারে।