‘আয়না ঘর’ গনতন্ত্রের আড়ালে শেখ হাসিনার এক রাষ্ট্রীয় জাহান্নামের নাম
(শেষ পর্ব)
পরদিন সন্ধ্যার দিকে রঙচঙে এক পাঞ্জাবি নিয়ে আসলো, সাথে একটা ট্রাউজার। দ্রুত পরে নিতে বললো।
অতঃপর চোখ বাঁধলো, পেছনে দুই হাত দিয়ে হ্যান্ডকাফ, মাথায় হ্যালমেট। একটা গাড়িতে উঠালে, অনুভব করলাম আমার মতো আরো দুইজনকে উঠালো।
একজন গাড়ি থামিয়ে তারা নিজেরা নামলো।
– ঐ গাড়ি চেক কর, সাবধান ভেতরে অস্ত থাকতে পারে।
– স্যার অস্ত্র নাই, উগ্রবাদী বই পাইসি।
কিছুক্ষণ হট্টগোল, তারপর আবার গাড়ি চললো।
নিয়ে এলো র্যাব ৩ এ, প্রথমবারের মতো চোখের বাঁধন খুললো। গারদে আমার সাথে আরো ২জন ঢুকলো। মোট ৩জন। নাটকের উদ্দেশ্য মিথ্যা মামলা সাজাবে, এখন বুঝলাম সব। ডেকে নিয়ে ছবি তুললো, সামনে কিছু বই-মোবাইল এসব সাজানো, এগুলো নাকি আমাদের কাছে পাওয়া গিয়েছে, অথচ এসবের নামও কখনো শুনিনি।
আর আমার কাছে এসব থাকবে কেনো। পরদিন ওরিয়েন্টেশন, ব্যাগে জামা কাপড় আর একাডেমিক কাগজপত্র ছিলো। মিথ্যার তো একটা সীমা থাকা উচিত।
এজহারে যা লিখলো…. তার সারমর্ম হলো: “আমরা ২৩মার্চ ২০২০, রাত ৮টার দিকে মতিঝিল মডেল হাইস্কুলের মেইন গেইটের পূর্বপাশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিলাম। সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করাকালে তারা আমাদের ধাওয়া করে, ৩জনকে আটক করতে সক্ষম হয়, বাকি ৮/১০ পালিয়ে যায়। নিষিদ্ধ বইগুলো আমাদের সাথে থাকা ব্যাগে ছিলো”
পরদিন মতিঝিল থানায় নিলো, মামলা দায়ের করলো, এমন কোনো ধারা নেই যে দেয়নি, যেন ১/২ বছরেও বের না হতে পারি।
বাড়িতে কল করতে দিলো। আব্বা আম্মা আর ভাইয়া আসলো। থানার গারদে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম উনাদের জড়িয়ে ধরে…..
সবমিলিয়ে প্রায় ৭৭০ দিন পর আমার জামিন হয়।
(গুম ৭২ দিন, জেলে ৭৭০ দিন, সবমিলিয়ে ৮৪২ দিন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে…
“আপনাকে কেন ধরবে?”
“কিছু তো অবশ্যই ছিলো…”
আমি নটরডেমে কলেজে পড়া অবস্থায় আরামবাগে থাকতাম। সেখানে আরামবাগ মোড়ের বাইতুল আমান মসজিদে এক ভাই আরবী পড়াতেন। সব বয়সের স্টুডেন্ট ছিলো উনার, স্কুল কলেজ পড়ুয়া থেকে অবসরপ্রাপ্ত চাকুরীজীবি পর্যন্ত। মসজিদের লাইব্রেরিতে পড়াতেন বেশিরভাগ, নয়তো বারান্দায়। প্রকাশ্যে, সবার সামনে, সবাই জানতো। লুকোচুরি কিছু না। মসজিদের ইমাম থেকে মসজিদ কমিটি সবাই জানতো। কমিটির অনেকে উনার কাছে পড়েছে।
আমি উনার কাছে কিছুদিন পড়েছিলাম।
আমাকে গুম করার প্রায় ২মাস আগে উনাকেও গুম করে। পরবর্তীতে উনাকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে ছেড়ে দেয়। জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দেখে ধারণা করছি এই সূত্র ধরেই হয়তো আমাকেও গুম করে। পরবর্তীতে শোনা যায়, উনি গুম হওয়ার কিছুদিন পূর্বে মসজিদ কমিটির সাথে উনার কী একটা ঝামেলা হয়েছিলো।
মামলার এজহারেও আরবী শেখার কথা তারা লিখেছিলো। তবে লিখেছে আরবী শেখার নামে জ-ঙ্গিবাদের ট্রেইনিং নিত। আজ সমস্ত কিছুই পরিস্কার। সরকার শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত আর দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এবং আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসার জন্য মাঝে মাঝে এসব জংগী ঘটনা সাজাতো আর ইসলাম প্রিয় ছাত্র যুবক দের ধরে নিয়ে গিয়ে এসব আয়না ঘরে রেখে জংগী ধরার সফলতা দেখিয়ে দেশের মানুষ তথা সারা দুনিয়ায় বাহবা নিত।
পিয়াস জঙ্গি নন। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না কোনও দিন, আজও নেই। খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন একটি গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে পিয়াস ছিলেন সাধারণ এক জন বিএনপি কর্মী। শহরে পড়াশোনা করতে এসে বিএনপির শাখা সংগঠন ছাত্রদলের কর্মী হয়ে যান। ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে বিরোধী দল করা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশের কাছে ভয়ানক অপরাধ। ২০১০-এ একবার ঢাকার রাস্তা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়। পিয়াস তখন দলের কর্মসূচির হ্যান্ডবিল বিলচ্ছিলেন। অজ্ঞাত এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে, আজ যার পরিচিতি ‘আয়নাঘর’ হিসাবে।
২০১১ সালে খুলনা থেকে পুলিশ আবার তুলে নিয়ে যায় পিয়াসকে। তার দাবি, দেশের সব বড় শহরে এমন ‘আয়নাঘর’ আছে। আমাকে এ বার আটক করা হয় খুলনার আয়নাঘরে। সেটা কোথায় আমার কোনও ধারণা ছিল না, আজও নেই।
তবে খুলনার ‘আয়নাঘর’-এ যে অনেককে রাখা হয়েছিল, তাদের কান্না ও চিৎকারে টের পেতেন পিয়াস। নিয়মিত নির্যাতন করা হত তাদের। পিয়াসের অভিযোগ, যখন ইচ্ছা হত আমাকে ঘর থেকে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হত। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। জ্ঞান ফিরলে দেখতাম পুরনো ঘরে পড়ে আছি। বাড়ির লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজত। হদিস পেত না।
এর পরে এক পুলিশ কর্তা হঠাৎ ‘সদাশয়’ হয়ে উঠে পিয়াসের বাড়িতে খবর পাঠান। তাকে আদালতে তোলা হলে জামিনও পেয়ে যান। পুলিশ কর্তার মুখোশ এ বার খুলে যায়। বাড়ির লোককে তিনি জানান, আর তো গুম করা হবে না, এ বার ‘এনকাউন্টার’। তার চেয়ে তাকে মোটা টাকা দিলে পিয়াসকে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি।
পিয়াসের কথায়, ঢাকা-খুলনার বাইরে কোথাও যাইনি, আমাকে বসিরহাটের কাছে সীমান্ত পার করে দেওয়া হল। কোনও কাগজপত্র নেই, চেনা কেউ নেই।
ছোটখাটো কাজ করে আর ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে থেকে এক সময়ে টাকার বিনিময়ে ভারতীয় কিছু পরিচয়পত্রও করিয়ে নেন পিয়াস। বেঙ্গালুরু ও দিল্লিতে কাজ করে কয়েক মাস করে কাটান। কিন্তু পেট ভরে না, সঙ্গে ধরা পড়ার আতঙ্ক।
বাড়ির লোক ফের সেই প্রভাবশালী পুলিশ কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আরও মোটা টাকার বিনিময়ে পিয়াসের বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়ে তাকে আরবের কোনও দেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেন তিনি। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে অনেকটা জমিজমা বিক্রি করে বিপুল টাকা সেই পুলিশ কর্তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিএনপি না-করলে ‘এনকাউন্টার’ করা হবে না আশ্বাস পেয়ে দেশে ফেরেন পিয়াস। কয়েক মাস পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে অবশেষে এখন কুয়েতে।
বি এন পি নেতা সালাউদ্দীন আহম্মেদের অপহরণ ও গুমের ইতিহাস আমরা জানি। একটানা ৬১ দিন কবরের মতো ঘরে রেখে নির্মম নির্যাতনের পরে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনার জবাব কি দিতে পারবে আওয়ামী লীগের সেই সরকার?
এসব লোমহর্ষক ঘটনার কথা পিনপতন নীরবতায় আজ জাতীকে শুনতে হচ্ছে। যে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গল্প হাছিনার রাজনীতির প্রধান উপজীব্য ছিল, তার সমস্ত কিছু ছিলো মানুষ কে বেকুব বানিয়ে, মিথ্যা গনতন্ত্রের গল্প শুনিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নেশা মাত্র। সমাজের প্রতিটি স্তরে পদলেহন কারী কর্মকর্তা কর্মচারী বসিয়ে একনায়কতন্ত্র শাসন আর শোষণ এ দম বন্ধ হয়ে যাওয়া জনগণের সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না। আমরা এখনো জানিনা এই আয়না ঘরের মতো কত অজ্ঞাত কারাগার আছে দেশে। নির্মমতার এই গল্প কুখ্যাত আমেরিকার গুয়েন্তামো বে এর চেয়ে কম নয়। রাজনীতির অবাধ ক্ষেত্র রেখে না দিলে দুনিয়ার কোন অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ক্ষমতা হয়তো দীর্ঘ হয়েছে কিন্তু চিরস্থায়ী হয় নি। সরকারের পতনের পরে আমরা সারা বাংলাদেশ এ আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘরের উপর হামলার চিত্র দেখেছি যা কখনো কল্পনায় ছিলো না। এটা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত ছাড়া কিছুই নয়। যা আওয়ামী লীগের সেই সরকার ক্ষেত্র গড়ে উদাহরণ হিসেবে রেখে দিলো সকলের জন্য। বিশেষ করে স্বাধীনতার পরে অনেক সরকার বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, স্বৈরশাসক এরশাদ কিংবা সামরিক শাসন কয়েক বার এলেও আয়না ঘরের মতো গোপন নির্যাতন সেল কোন সরকারের আমলে অতীতে ছিলো না। জানিনা কত নারী হারিয়েছে তার স্বামী, কত সন্তান তার বাবাকে, তাদের চোখের জল কখনো মুছে দিতে পারবে কেউ? এমন রাস্ট্রীয় খুন কিংবা গুমের বিচার না হলে বাংলাদেশ বিচারহীনতার এক নির্মম উদাহরণ হিসেবে স্থান পাবে ইতিহাসের পাতায়। সেই বিচারের অপেক্ষায় আগামীর বাংলাদেশ।
সমাপ্ত।
তথ্যসূত্র ঃ ইন্টারনেট, কলাম, পত্রিকা, সাক্ষাৎকার।
লেখক ঃ লতিফুর রহমান, লেখক ও আইনজীবী।