…আর্কিমিডিস কী কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তা সেই সৈনিক বুঝতে পারল না। তা বোঝার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। বরং আর্কিমিডিসের জবাব শুনে ভয়ঙ্কর রেগে গেল সে। তরোয়াল দিয়ে আর্কিমিডিসের মাথাটাই কেটে ফেলল। শুধু তাই নয়, আর্কিমিডিসের কষতে থাকা অঙ্কের সমাধান পর্বের লেখাগুলিও মুছে ফেলল। ফলে সেই অঙ্ক যেমন চিরদিনের জন্য অসমাপ্ত থেকে গেল, তেমনই কোন জটিল অঙ্কের সমাধান করছিলেন তিনি, তা–ও কেউ জানতে পারল না।
উপমন্যু রায়
আমার স্কুলজীবনকে আর্কিমিডিস খুবই প্রভাবিত করেছিল। তাঁর সম্পর্কে কোথাও কোনও গল্পের আভাস পেলেই আমি কান পেতে শুনতাম। স্কুলে বা বাড়িতে শিক্ষকরা পড়ানোর ফাঁকে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বললে আমি গোগ্রাসে গিলতাম। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় অবশ্য আরও কিছু নাম এসে ভিড় করে আমার কল্পনার জগতে।
আর্কিমিডিসকে প্রাচীন যুগের সেরা এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা গণিতজ্ঞ হিসেবে মনে করা হয়। তথ্য বলছে, আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদরা তাঁর লেখা পড়তেন। বিভিন্ন জায়গায় সে–সব উল্লেখও করতেন। তবে ৫৩০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক স্থপতি ইসেডোর অফ মিলেতাস সর্বপ্রথম তাঁর সমস্ত লেখা একসঙ্গে লিপিবদ্ধ করেন। আর ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্কিমিডিসের কাজের ওপর একটি বিবরণ প্রকাশ করেন গ্রিক গণিতবিদ ইউতোশিয়াস। সেই বিবরণই প্রথম তাঁকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পরিচিত করে তোলে।
আর্কিমিডিসের জীবনের গল্পগুলি আজও আমার মনে দোলা দেয়। যাই হোক, আর্কিমিডিসের সঙ্গে রাজা হিয়েরোর গভীর বন্ধুত্বের কথা স্কুলের ভৌত বিজ্ঞান শিক্ষকের কাছ থেকেই জেনেছিলাম। আর্কিমিডিস ছিলেন প্রচার বিমুখ। নিজের বাড়িতেই তিনি আপন মনে বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা করতেন।
কিন্তু তা বিশেষ পছন্দ ছিল না হিয়েরোর। তিনি আর্কিমিডিসকে সরাসরিই বলতেন, ‘‘তুমি এত বড় জ্ঞানী মানুষ! আর সেই তুমিই কিনা তোমার জ্ঞানকে বাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছ? মানুষ যদি তোমার জ্ঞানের কথা জানতে না পারে, তা হলে কী লাভ সেই জ্ঞানের চর্চা করে?’’
আর্কিমিডিস রাজা হিয়েরোকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?’’
রাজা হিয়েরো বললেন, ‘‘মানুষের কাজে লাগে এমন যন্ত্র তুমি কি তৈরি করতে পারো না, যা দেখে সবাই তোমার ধন্য ধন্য করবে?’’
রাজা হিয়েরোর কথাতেই আর্কিমিডিস তখন থেকে নানা ধরনের জিনিস তৈরি করেন। সেই জিনিসগুলি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে কাজে লাগত। সেইসব আবিষ্কারের দৌলতেই তিনি সত্যি সত্যিই সাইরাকিউসের মানুষের ‘প্রিয় মানুষ’ হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই নয়, সাইরাকিউসকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আর্কিমিডিস নানা ধরনের বিজ্ঞানসম্মত অস্ত্রশস্ত্রও তৈরি করেছিলেন। ওই অস্ত্রশস্ত্রের জোরেই রাজা হিয়েরো সাইরাকিউসকে শত্রুদের হাত থেকে অনেকদিন রক্ষা করেছিলেন।
যখন কোনও যুদ্ধ জাহাজ নগরের কাছাকাছি আসত, তখন নগরের প্রাচীরের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াত বড় বড় থামের মতো চুড়ো। সেখান থেকে পাথরের বর্ষণ শুরু হত শত্রুপক্ষের যুদ্ধ জাহাজের ওপর। তার পর দ্রুত সেই চুড়ো ফের প্রাচীরের পিছনে নীচে নেমে লুকিয়ে পড়ত। জাহাজের সেনারা যখন বিষয়টি বোঝার জন্য সেদিকে দৃষ্টি দিত, তখন কিছুই দেখতে পেত না।
আরও একটি অস্ত্র বিখ্যাত ছিল। বড় বড় কলের ধাক্কায় কড়ি বড়গা ছুটে গিয়ে শত্রুপক্ষের জাহাজের ওপর পড়ত। তার পর দূর থেকে বিশাল নখাল সাঁড়াশি চালিয়ে শত্রুপক্ষের জাহাজ উপড়িয়ে আনত। এর ফলে শত্রুপক্ষের জাহাজ সাইরাকিউস নগর ছেড়ে দূরে পালিয়ে যেত।
শোনা যায়, সেই সময়ই রোমানদের নজরে আসে সাইরাকিউস। তারা ওই নগর জয় করার জন্য উদ্যোগী হয়। সেনাপতি মার্সেলাস সৈন্য–সামন্ত নিয়ে সাইরাকিউস আক্রমণ করেন। কিন্তু আক্রমণ করাই তাঁর সার হয়। আর্কিমিডিসের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে রাজা হিয়েরো রোমান সেনাদের পিছু হঠতে বাধ্য করেন। তার মধ্যে আর্কিমিডিসের আবিষ্কার একটি পন্থা বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপে।
অনেকগুলি আয়নার সাহায্যে আক্রমণকারী জাহাজের ওপর সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত করে সেগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিত সাইরাকিউসের সৈন্যরা। ফলে রোমান যুদ্ধ জাহাজগুলি পিছু হঠে শেষে পালিয়ে যেত। যদিও রেনেসাঁসের সময় থেকেই আর্কিমিডিসের এই পন্থা সম্বন্ধে যে জনশ্রুতি রয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। রেনে দেকার্ত তো পুরো বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত বলে উড়িয়েই দিয়েছিলেন।
তবে এখন বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সহজ ভাবে উড়িয়ে দিতে রাজি নন। ১৯৭৩ সালে গ্রিক বিজ্ঞানী ইওয়ান্নিস সাক্কাস আর্কিমিডিসের সূর্যরশ্মি নিয়ে একটি পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষায় তিনি ৭০টি আয়না ব্যবহার করেন। একটি জাহাজে আয়নাগুলো ঠিকমতো ফোকাস করার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাতে আগুন ধরে যায়।
সাইরাকিউসের এমন সব অস্ত্রের কথা রোমান সৈন্যদের মারফতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেইসব অস্ত্র নিয়ে রোমান সেনাদের ভীতির কথাও কারও কাছে তখন গোপন থাকেনি। ব্যাপারটা নিয়ে রোমান সেনাপতি মার্সেলাস চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।
শেষে অনেক ভেবে তিনি একটি পরিকল্পনা করেন। সেই অনুযায়ী সেনাদের নির্দেশ দেন, ‘‘আমি বুঝতে পেরেছি, যুদ্ধ করে সাইরাকিউস দখল করতে পারব না। তাই আমাদের অন্য উপায় ভাবতে হবে। তোমরা সবাই সাইরাকিউস ঘিরে চুপ করে বসে থাকো। বাইরে থেকে খাবারদাবার যাতে ওই নগরে ঢুকতে না পারে, সে দিকে কড়া নজর রাখো। এ ভাবে যতদিন সম্ভব আমাদের থাকতে হবে। নগরের খাদ্য যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন সাইরাকিউস নিজে থেকেই হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে।’’
যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। এ ভাবে প্রায় তিন বছর যুদ্ধ না করেও সাইরাকিউস অবরোধ করে রেখেছিল রোমান সেনারা। তার পর সত্যি সত্যিই এক সময় অবরুদ্ধ সাইরাকিউসে খাদ্যাভাব দেখা দিল। রাজা হিয়েরো হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। সেনা নিয়ে রোমান সেনাপতি মার্সেলাস সাইরাকিউসে ঢুকে পড়লেন।
আর্কিমিডিসের কথা ভালো করেই জানতেন মার্সেলাস। তাই সৈন্যদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘‘নগর লুঠ করো। তবে খেয়াল রেখো আর্কিমিডিসের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। তাঁর গায়ে যেন কারও আঁচড় পর্যন্ত না লাগে।’’
মার্সেলাসের কথা শুনেছিল সৈন্যরা। কিন্তু সাইরাকিউস জয়ে তারা এতটাই উৎফুল্ল ছিল যে, আর্কিমিডিস কে, বা তাঁর ক্ষতি না করার কারণ জানার কোনও প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। তাই মার্সেলাসের কাছ থেকে ভালো করে সে–সব তথ্য জেনেও নিল না। ভেবেছিল, আর্কিমিডিস বোধ হয় রাজ পরিবারেরই কেউ হবেন। হয়তো বড় কোনও প্রাসাদের বাসিন্দা হবেন। তেমন প্রাসাদে লুঠতরাজ চালানোর আগে জেনে নিলেই হবে।
ফলে নগরে ঢোকার পর সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি লুঠতরাজ শুরু করে। সেই সময় কিছু সৈন্য চলে যায় আর্কিমিডিসের বাড়ি। গিয়ে দেখে, তিনি তখন জটিল কোনও অঙ্কের সমাধানে ব্যস্ত। তাঁর নগরে কী চলছে, তার কোনও খবরও তিনি রাখেননি। হুঁশও নেই সে–সব নিয়ে।
মার্সেলাসের সৈন্যরা তাঁকে চিনত না। কিন্তু তাঁকে গভীর চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে দেখে এক সৈন্য জিজ্ঞাসা করল, ‘‘তোমার নাম কী? তুমি কী করছ?’’
নিজের কাজে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, তাদের প্রশ্ন শুনতেও পেলেন না আর্কিমিডিস। তাই জবাবও দিলেন না। ক্ষুব্ধ সেই সৈন্য ফের চিৎকার করে সেই একই প্রশ্ন করে তাঁকে। বিরক্ত আর্কিমিডিস তখন বলেছিলেন, ‘‘কেন আমায় বিরক্ত করছ? আমি এখন ব্যস্ত। আমাকে কাজ করতে দাও।’’
আর্কিমিডিস কী কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তা সেই সৈনিক বুঝতে পারল না। সেই কাজের গুরুত্ব বোঝার মতো ক্ষমতাও তার ছিল না। বরং আর্কিমিডিসের জবাব শুনে ভয়ঙ্কর রেগে গেল সে। তাই আর দেরি না করে তরোয়াল দিয়ে আর্কিমিডিসের মাথাটাই কেটে ফেলল।
শুধু তাই নয়, এতটাই রেগেছিল সে যে, সেই সঙ্গে আর্কিমিডিসের কষতে থাকা অঙ্কের সমাধান পর্বের লেখাগুলিও মুছে ফেলল। ফলে আর্কিমিডিসের কষতে থাকা সেই অঙ্ক যেমন চিরদিনের জন্য অসমাপ্ত থেকে গেল, ঠিক তেমনই কোন জটিল অঙ্কের সমাধান তিনি করছিলেন, সে কথাও আর কেউ জানতে পারল না।
তবে এই ঘটনা ঘটিয়ে সেই সৈন্য আর তার কয়েকজন সঙ্গী খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। নগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুঠতরাজ চালাতে থাকা অন্য সৈন্যদের কাছে গর্বের সঙ্গে একজন ‘বেয়াদপকে’ খুন করার কথা তারা ফলাও করে জানায়। ক্রমে সেই খবর পৌঁছে যায় মার্সেলাসের কাছে।
আর্কিমিডিসের মৃত্যুর খবর পেয়ে সৈন্যদের ওপর ভয়ানক রেগে গিয়েছিলেন মার্সেলাস। কিন্তু রাগ করে যে লাভ নেই, তাও জানতেন তিনি। তিনি ভেবেছিলেন, আর্কিমিডিসের বুদ্ধি এবং মেধাকে সাম্রাজ্য পরিচালনায় ব্যবহার করবেন। সেই সম্ভাবনা চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন। পাশাপাশি আর্কিমিডিসকে তিনি কম শ্রদ্ধা করতেন না। তাই তাঁর মৃত্যু তাঁকে শোকাহতও কম করেনি।
তাই তাঁর শেষকৃত্য যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁর কবরের ওপর দৃষ্টিনন্দন সমাধি সৌধ তৈরি করেছিলেন। পরম শ্রদ্ধায় তিনি সেখানে রেখেছিলেন একটি গোলাপ ফুল।
আর্কিমিডিসের এইসব কাহিনি স্কুলে পড়ার সময় আমাকে বুঁদ করে রেখেছিল। তবে কেন জানি না এই কাহিনিগুলি আমাকে পরবর্তী কালে বিজ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত করতে পারেননি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক স্তরে থেলিস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকের কথা শুনে আমি এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যে, পরে দর্শনকে আমার পড়াশোনার বিষয় করে নিই। তার পর সেই পথেই ক্রমে গিয়ে পৌঁছই এম এ–তে। যেখানে তুমি এসেছিলে আমার জীবনে। সেটা ছিল আবার অন্য দর্শন। (ক্রমশ)