বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : রীতিমতো চমকপ্রদ ঘটনা পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে। আর সেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে কলকাতার বিখ্যাত সেই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। আরও সহজ ভাবে বললে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার। সেই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তথা মমতার নিজের ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য ঘিরে রীতিমতো জল্পনা তৈরি হয়েছে বাংলায়। কালীঘাটে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত একটি মেলার উদ্বোধনে গিয়ে মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে কী করব, তা আমি এখনও ঠিক করিনি। তাই বলতে পারব না।’ শুধু এখানেই থেমে যাননি তিনি, ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি এদিন সরবও হন। ফলে বাংলার রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে চর্চাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
একমাসও হয়নি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। তার পরই এক জনসভায় জানিয়েছিলেন, কালীঘাটে তিনি পদ্ম ফোটাবেন। এটা তাঁর চ্যালেঞ্জ। তার পরই প্রশ্ন উঠেছে, এদিন কার্তিকবাবুর মন্তব্য কি শুভেন্দুর দাবিকেই সত্যে পরিণত করতে চলেছে? এদিন কার্তিকবাবু নাম না করে নিজেদের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বিরুদ্ধেই তোপ দাগেন। বলেন, ‘মুখে দেশের কথা বলব, কিন্তু কাজের বেলা দেখাব অন্য ভূমিকা, এটাই এখন হয়ে গিয়েছে ভারতের রাজনীতি। দেশপ্রেমের কথা বলে এ দেশের রাজনীতিকরা নিজের পরিবারকেই সমস্ত সুযোগ–সুবিধা পাইয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন।’ যদিও তিনি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের নাম উচ্চারণ করেননি। আবার তাঁর কথার নিশানা হতে পারে দিল্লির নেহরু পরিবারের বিরুদ্ধেও। তবে নেহরু পরিবারকে কলকাতা থেকে নিশানা করে কার্তিকবাবুর কোনও লাভ নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাই তিনি নিজের পরিবারকেই এদিন আক্রমণ করেন বলে ধারণা তাঁদের।
উল্লেখ্য, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তিনি বিজেপিতে গেলেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা যাননি কেন?’ অন্য একটি সভায় তিনি এ কথাও বলেছিলেন, ‘তোমার বাড়িতে জোড়াফুল রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে থাকতে তোমার লজ্জা হবে না?’ এর জবাবে শুভেন্দুও চুপ করে যাননি। তিনি খড়দহের এক জনসভায় পাল্টা বলেছিলেন, ‘সবে পদ্মের কুঁড়ি এসেছে। এখনও বাসন্তী পুজো, রামনবমী আসতে কিছুদিন বাকি। বাবুশোনা, একটু অপেক্ষা করো। তুমি জেনে রাখো, শুধু আমার বাড়ি নয়, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেও পদ্ম ফুটিয়ে দিয়ে আসব।’ তখন অবশ্য শুভেন্দুর সেই দাবিকে রাজনৈতিক মহল তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এদিন কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে শুভেন্দুর বলা সেই কথাটিই ফের রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় চলে এসেছে। অনেকেই মনে করছেন, এবার হয়তো বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারেও ভাঙন শুরু হতে চলেছে।
এদিন বিবেকানন্দ জয়ন্তীর সন্ধ্যায় কার্তিকবাবু আরও বলেন, ‘আগামিদিনে কী হবে, তা কেউ বলতে পারে না। কাল আমি কী করব, তা আজ আমি নিজেও জানি না।’ এর পর অবশ্য আর কোনও মন্তব্য করেননি। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও কোনও কথা বলতে চাননি তিনি। তবে, তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে কাকা (কার্তিকবাবু) এবং ভাইপোর (অভিষেক) মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। তবে মমতার সঙ্গে কার্তিকবাবু এবং অভিষেক, দু’জনেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অভিষেক যে ভাবে তৃণমূলে গুরুত্ব পাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে দলে মমতার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়ে উঠছেন, তা মেনে নিতে পারছেন না কার্তিকবাবু। হয়তো তাই ভিন্ন পথের অনুসন্ধান করছেন। সূত্রের খবর, শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কই ছিল। গত বছর কালীঘাটে বিবেক মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেন্দু অধিকারীকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। এদিন কার্তিকবাবু যে মন্তব্য করেছেন, সে ক্ষেত্রে সেই শুভেন্দুই অনুঘটকের কাজ করেছে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
এদিকে, বাংলার রাজনৈতিক মহলে একটি ভিন্ন মতও শোনা গিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, পুরোটাই নাকি তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) গেম প্ল্যান। কার্তিকবাবুকে বিজেপিতে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু নেতিবাচক কাজ করিয়ে নিতে চান তিনি। আর তা যদি সম্ভব হয়, বিজেপির ক্ষতি হবে। তাতে লাভ হবে তৃণমূলের। এমন ভাবনা থেকে বিজেপি নেতাদের একাংশ অবশ্য চান না কার্তিকবাবুকে নিয়ে দল উৎসাহিত হোক। এমন ভাবনার পিছনে অবশ্য যুক্তিও রয়েছে তাঁদের। তৃণমূল নেতাদের দিয়ে মাঝেমধ্যেই বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে। যেমন, মঙ্গলবারই বিবেকান্দের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেন, ‘শুভেন্দু বিজেপিতে গিয়ে ভালো নেই। সেখানে তাঁর মন টিকছে না। তিনি–সহ বিজেপির কমপক্ষে ৭ জন সাংসদ তৃণমূলে আসবেন। এ ছাড়া তৃণমূলে ফিরে আসবেন চলে যাওয়া সব বিধায়কই।’ যদিও জ্যোতিপ্রিয়র এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপি নেতারা।
এখন দেখার কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি বা তৃণমূল!