বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : অভাবনীয় ঘটনাই বটে। বেশ কিছু বছর ধরে বিতর্কহীন ছিলেন অভিনেত্রী তথা তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। তবে নিজের সংসদীয় এলাকায় মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যেত তাঁকে। দলের পক্ষে বা বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে কখনও সে ভাবে সরব হতেন না। কর্মসূচিতে নিজের দায়িত্বটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যেতেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে তাঁকে দলের কোনও সভাসমিতিতে দেখা যাচ্ছে না। তবে যেহেতু তিনি বিতর্কহীন, তাই বিষয়টি নিয়ে কেউই তেমন একটা মাথা ঘামাননি। কিন্তু বৃহস্পতিবার অভিনেত্রী–সাংসদের ফেসবুক পেজ থেকে জানা গেল, তাঁর মনে কী পরিমাণ অভিমান জমে রয়েছে! সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তৃণমূলের সভায় আর ডাক পাই না।’
কিন্তু কেন? তার জবাব অবশ্য তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ফলে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে তিনিও কি ধীরে ধীরে বিজেপির দিকে পা বাড়াচ্ছেন? বলা বাহুল্য, উত্তর নেই। তবে দলকে যে তিনি রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর ফেসবুক পেজের নাম ‘শতাব্দী রায় ফ্যান ক্লাব’। সেখানে বৃহস্পতিবার তিনি লেখেন, ‘আমি আগে অভিনেত্রী। অভিনয় দিয়েই মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি। শতাব্দী রায় হিসেবেই এতদিন বাংলার মানুষ আমাকে ভালবেসে এসেছেন। সাংসদ হয়েছি অনেক পরে। তাই আমি আগে অভিনেত্রী, পরে সাংসদ।’ তাঁর এ কথার মধ্যেও যে একটা ইঙ্গিত রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি রাজনৈতিক মহলের। যদিও লেখার সূচনায় তেমন একটা বিতর্ক ছিল না। তিনি নতুন বছর সকলের শুভ কামনা করেই লেখা শুরু করেছিলেন। লিখেছেন, ‘২০২১ সাল সকলের খুব ভালো কাটুক। আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন। সাবধানে থাকুন।’
তার পরই তিনি চলে আসেন রাজনীতির কথায়। লেখেন, ‘এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। অনেকেই আমাকে বলেছেন, দলের বহু কর্মসূচিতে আমাকে দেখা যায় না। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, কেন আমাকে দলের কর্মসূচিতে দেখা যায় না? আমি তাঁদের সকলকে বলেছি, আমি সর্বত্র যেতে চাই। আপনাদের সঙ্গে এবং আপনাদের পাশে থাকতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো সবার পছন্দ নয়। তাঁরা চান না আমি আপনাদের কাছে যাই। সেইজন্য আমাকে দলের বহু কর্মসূচির খবরও দেওয়া হয় না। আমি যদি দলের কর্মসূচির খবর জানতে না পারি, তা হলে আমি যাব কী করে? ব্যাপারটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়? কিন্তু আমি কী করতে পারি?’ এর পরই তিনি পরিষ্কার লেখেন, ‘গত দশ বছরে আমি আমার বাড়িকে যতটা সময় দিয়েছি, তার চেয়ে বেশি সময় আমি কাটিয়েছি আপনাদের প্রতিনিধিত্ব করে। যতটুকু সম্ভব, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আপনাদের জন্য কাজ করতে। আমার এই ভূমিকা শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারবে না। তাই নতুন বছরে কিছু সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই। এমন সিদ্ধান্ত নিতে চাই, যাতে আমি আপনাদের সঙ্গে পুরোপুরি কাটাতে পারি।’
এখানেই সুর কেটে গিয়েছে শতাব্দীর। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, হয়তো দলের বিরুদ্ধেই তিনি কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। হয়তো তিনিও দলের সাংসদ সুনীল মণ্ডলের বিজেপিতে চলে যাওয়ার মতো কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। রাজনৈতিক মহলের জল্পনাকে উস্কে দিয়েই শতাব্দী তার পর লিখেছেন, ‘২০০৯ সাল থেকে যে ভাবে আপনারা আমাকে সমর্থন করে লোকসভায় পাঠিয়েছেন, সেইজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আশা করি, এতদিন যে ভাবে আপনাদের ভালবাসা পেয়েছি, ভবিষ্যতেও তা পাব। আমিও আমার কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করে যাব।’ এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, তিনি রাজনীতি ছাড়ছেন না, এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বরং বর্তমান দলের বদলে অন্য কোনও দলের হয়ে তিনি সাংসদ হতে চান, তেমনই ইঙ্গিতই রয়েছে তাঁর কথায়। এর পরই তিনি সতর্কতার সঙ্গে লিখেছেন, ‘আমি আগে অভিনেত্রী, তার পরে সাংসদ। কারণ, সাংসদ হওয়ার অনেক আগে থেকেই অভিনেত্রী শতাব্দী রায় হিসেবে আপনারা আমাকে ভালবেসে এসেছেন।’
কিন্তু পেজের শেষে যে ভাবে লিখেছেন আগামিদিনের কথা, তাতে কিন্তু অন্য গন্ধ পাচ্ছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তিনি লিখেছেন, ‘যদি কোনও সিদ্ধান্ত নিই, তা হলে ১৬ জানুয়ারি দুপুর দুটোয় আপনাদের সে কথা জানাব।’ এখানেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, কোন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন তিনি? রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে পুরোপুরি অভিনয় জগতে ফিরে আসতে চাইছেন কি? নাকি, অন্য কোনও দলে (বিশেষ করে বিজেপি) যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করবেন? ব্যাপারাটা নিয়ে সংশয় ও দোলাচলে দুলছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল। আপাতত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তারা। প্রথমত, শত্রু বলতে কাদের বুঝিয়েছেন তিনি? দলের কারা তাঁকে কর্মসূচির কথা জানান না? তাঁরাই কি তাঁর শত্রুপক্ষের? শনিবার কী সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করতে পারেন? অভিনয় করে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায়। তিনি কি সেই পথে যেতে চাইছেন? কিন্তু মানুষের পাশে থাকা মানে তো রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরা! কেন না, রাজনৈতিক দলের নেতারাই মানুষের পাশে থাকার কথা বলে থাকেন। তা হলে তিনি রাজনীতিতে ফের স্বভূমিকায় নামতে চাইছেন? আর, সেই ভূমিকা কি বিজেপির হয়েই দেখা যাবে?
শতাব্দী রায়ের এই বক্তব্য যে দলের অস্বস্তি বাড়াবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের তরফে প্রকাশ্যে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। কিন্তু সাংসদ সুনীল মণ্ডলের পর সাংসদ শিশির অধিকারী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু অধিকারী থেকে বেশ কয়েকজন সাংসদ নাকি বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন। সেই দিক থেকে দলের ওপর একটা চাপ রয়েছে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করে নিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের বেশ কয়েকজন শীর্ষসারির নেতাই। এরই মধ্যে বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা পশ্চিমবাংলায় দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় এদিন রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের তালিকা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন তৃণমূলের ৪১ জন বিধায়ক আমাদের দলে আসার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে অনুগামী নেতা ও কর্মীরাও বিজেপিতে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁদের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।’
তবে এই ৪১ জন কারা, তাঁদের কারও নামই এদিন তিনি উচ্চারণ করেননি। তবে অনেকেই মনে করছেন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মীরতন শুক্লা ছাড়াও হাওড়া, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান থেকে বেশ কয়েকজন বিধায়ক ইতিমধ্যেই বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও কৈলাস এ কথাও বলেছেন, ‘আগে আমরা যাচাই করে দেখব। আসতে চাইছেন বলেই দলে তাঁদের সবাইকে নিয়ে নেব না। যাঁদের ভাবমূর্তি ভালো, যাঁরা সত্যিই মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাঁদেরই বিজেপিতে নেব।’ পাশাপাশি তৃণমূলকে আক্রমণ করতেও এদিন তিনি ছাড়েননি। বলেছেন, ‘আমরা চাই না একসঙ্গে এত বিধায়ক তৃণমূল ছাড়ুক। কারণ, তা হলে এই সরকারই পড়ে যাবে। কিন্তু আমরা তা চাই না। আমরা চাই মানুষের ভোটে তাদের হারিয়ে ক্ষমতা থেকে সরাতে।’
এদিকে, রাজ্যে এখন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, যে কোনও দিন কমিশন নির্বাচনের দিনক্ষণ জানিয়ে দিতে পারে। তাই নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, এই দলবদলের ঘটনা তৃণমূলকে ভয়ঙ্কর স্নায়ুর চাপে ফেলে দিচ্ছে বলে ধারণা ওয়াকিবহাল মহলের।