মোদি–মমতার বৈঠক ঘিরে জল্পনা তুঙ্গে
বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
নারদ মামলায় নাটকীয় মোড়। এবার এই মামলায় খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক এবং সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেই পক্ষ করে নিল সিবিআই। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে এ বিষয়ে তাঁদের কাছে নোটিশও পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার নারদ–মামলায় অভিযুক্ত চার হেভিওয়েট নেতা ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে। সেই মামলারই শুনানি অন্য রাজ্যে সরাতে চেয়ে সিবিআই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে।
কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দলের ডিভিশন বেঞ্চে মামলাটির শুনানি চলছে। কোর্টে অভিযুক্তদের হয়ে সওয়াল করবেন অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, সিদ্ধার্থ লুথরা। রাজ্যের তরফে আদালতে ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত। অন্যদিকে, সিবিআইয়ের হয়ে সওয়াল করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। কিন্তু এদিন মামলার কোনও সুরাহা হয়নি। তাই পরবর্তী শুনানি হবে বৃহস্পতিবার। তাই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলেই থাকতে হবে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে।
এরই মধ্যে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনার জন্য বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভারচুয়াল বৈঠকে বসতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ছাড়াও আরও নটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ওই বৈঠকে অংশ নেবেন। এ ছাড়া বাংলার নটি জেলার জেলাশাসকরাও ওই বৈঠকে থাকবেন। আপাত দৃষ্টিতে এই বৈঠক স্বাভাবিক হলেও বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী অনেকবার সমস্ত রাজ্যেরই মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ বৈঠকই মমতা হয় এড়িয়ে গিয়েছেন, নতুবা সরাসরি যোগ দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর বৈঠকে যোগ দেওয়ার মধ্যে অন্য কোনও রহস্য রয়েছে কিনা, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
এদিনও সিবিআই বনাম রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব নিয়ে সরগরম ছিল গোটা রাজ্য। হাইকোর্টে দুই পক্ষে আইনি লড়াইও শুরু হয়ে গিয়েছে। শুনানিতে হাইকোর্টে সিবিআইয়ের আইনজীবী তুষার মেহতা পরিষ্কার জানান, এই রাজ্যে নারদ মামলার শুনানির পরিবেশ একেবারেই নেই। নানা ভাবে মামলা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হচ্ছে। ধৃত চার হেভিওয়েট নেতাকে গ্রেফতার করার পর নিজাম প্যালেসে হাজির হন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি হুমকি দেন, তাঁদের গ্রেফতার করা হলে তাঁকেও গ্রেফতার করতে হবে। এমনকী, ভারচুয়াল শুনানির সময় স্বয়ং তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিজাম প্যালেসের বাইরে অসংখ্য তৃণমূল কর্মী ধর্না দিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। ইট–পাটকেল ছুড়ছিলেন। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, শুনানি চলার সময় নিম্ন আদালতে একটানা বসেছিলেন আইনমন্ত্রী–সহ একাধিক মন্ত্রী। সিবিআইয়ের আইনজীবীর দাবি, এই ঘটনা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। সে কথা জোর গলায় কলকাতা হাইকোর্টে তিনি জানান। তিনি জানান, সেইজন্য তাঁরা মামলা অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যেতে চান।
সিবিআইয়ের অভিযোগের পাল্টা ধৃত চার নেতার আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে লোক রাস্তায় নেমেই প্রতিবাদ করে। আইনকে নিজের পথেই চলতে দেওয়া উচিত।’ তখন প্রধান বিচারপতি স্বয়ং তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘ঘটনাটিকে প্রশাসককের নজর দিয়ে দেখা উচিত নয় কি? মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই দফতরে, আইনমন্ত্রী সিবিআই আদালতে, তা হলে বিচার হবে কোথায়? রাস্তায়?’ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিকে বিচারপতি আরও প্রশ্ন করেন, ‘আপনার মতে একজন রাজনৈতিক নেতার কর্তব্য কী? অনুগামীদের প্ররোচিত করা?’ জবাবে কিছুটা বিব্রত অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, ‘আইনজীবী হিসাবে বলব, কোনও নেতারই বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া উচিত নয়।’ তাঁকে বিচারপতি জিজ্ঞাসা করেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী তো অল্প সময়ের জন্য নিজাম প্যালেসে যাননি। ৫–৬ ঘণ্টা ছিলেন সেখানে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? কেন শুনানি চলাকালীন নিম্ন আদালতে ছিলেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী? আপনি কী বলতে চান? এটা গুরুতর নয়? আমাদের পর্যবেক্ষণে পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক থাকত, তা হলে অভিযুক্তদের আদালতে নিয়ে আসা যেত। কিন্তু তা হয়নি।’
সোমবার রাত থেকেই প্রেসিডেন্সি জেলে রয়েছেন চার নেতা–মন্ত্রী। তবে তাঁদের মধ্যে তিনজন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। জ্বর রয়েছে ফিরহাদ হাকিমের। সূত্রের খবর, এই চার নেতার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মেডিক্যাল টিম তৈরি করতে পারে সিবিআই। সেখানে এইমসের চিকিৎসকরা থাকবেন। এই চার নেতাকে গ্রেফতারের পরই মুখ্যমন্ত্রী নিজাম প্যালেসে যান। তখন নিজাম প্যালেসের সামনে তুমুল বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল কর্মীরা। ইটবৃষ্টিও হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিশানা করে ইট ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ।
এদিকে, সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে গড়িয়াহাট থানায় এফআইআর দায়ের করল তৃণমূলের। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় ৫১ (বি) ও ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৬৬, ১৬৬এ, ১৮৮, ৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেছেন তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ১৭ মে তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি অবৈধ, দাবি করে অভিযোগ দায়ের করেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। সেই অভিযোগটিকেই এফআইআরে পরিণত করেছে কলকাতা পুলিশ।
অভিযোগে জানানো হয়েছিল, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমকে অবৈধভাবে গ্রেফতারের জন্য সংশ্লিষ্ট সিবিআই আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে তৃণমূলের মন্ত্রীদের।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, কোনও অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়নি। বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকেও কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের অভিযোগ, বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায় বা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কেন কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না? নারদা মামলায় তো তাঁরাও সমানভাবে জড়িত।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার ভেড়ার পাল নিয়ে রাজভবনের সামনে এক ব্যক্তির বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। এ ছাড়া সোমবারও নিজাম প্যালেসের সামনে তৃণমূল কর্মীরা যে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, তার রেশ গিয়ে পড়েছিল রাজভবনেও। সেখানেও নর্থ গেটের সামনে বহু তৃণমূল কর্মী বিক্ষোভ দেখান। পুলিশ বাহিনীর সামনেই ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলে এই বিক্ষোভ। এইসব ঘটনায় রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় টুইট করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়াও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে রিপোর্টও তলব করেছেন।
রাজ্যপাল বেশি ক্ষুব্ধ মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে। ওইদিন ভেড়ার পাল নিয়ে সিটিজেন্স এগেইনস্ট ডার্টি পলিটিক্স অ্যান্ড কোরাপশন সংগঠনের তরফে এক যুবক রাজভবনের সামনে প্রতিবাদ দেখাতে গেলে পুলিশ তাকে সরিয়ে দেয়। রাজ্যপাল জানিয়েছেন, সোমবারের ঘটনা থেকেও শিক্ষা নেয়নি পুলিশ। মঙ্গলবার হাফ ডজন ভেড়া নিয়ে এক ব্যক্তি নর্থ গেটের সামনেটা আটকে দেন। সংবাদ মাধ্যমের সামনে তিনি ছবির জন্য পোজ দিতে শুরু করেন। পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে সেই নাটক দেখে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে দুটি ঘটনারই বিস্তারিত রিপোর্ট ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন রাজ্যপাল।
রাজ্যপাল এবং বিভিন্ন মহলের তরফে অসন্তোষের খবর আসার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশও। ওই ঘটনায় তারা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। হিংসা ছড়ানো, অবৈধ জমায়েত–সহ একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছে। করোনা সতর্কতা বিধি লাগু হওয়ায় কোথাও জমায়েতের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা রয়েছে। কিন্তু সেই বিধি সেদিন মানা হয়নি বলেও অভিযোগ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯ ধারায় শেক্সপিয়র সরণি থানায় মামলা করা হয়েছে। তবে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম মামলায় আপাতত নেই। ফলে সেই মামলার ফল কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে আইনি মহলেও।