বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
কেন্দ্রীয় সরকারের শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ঢাল করলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শো–কজের জবাবি চিঠিতে তিনি পরিষ্কার লিখেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আলাপন চ্যাপ্টার ওভার। তবে রাজ্য সরকার তাঁর পাশেই রয়েছে। কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের মতে, আলাপনবাবুর চিঠির ভাষাই প্রমাণ করে দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করলেও তিনি পরিকল্পিত ভাবেই কেন্দ্রকে অস্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই চলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর স্বার্থরক্ষা করাই ছিল তাঁর কাজ।
১ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মুখ্যসচিব’ হিসেবেই উল্লেখ করে শো–কজ করা হয়। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ (বি) ধারা লঙ্ঘন করেছেন তিনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার কেন শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না? চিঠিটি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি আশিসকুমার সিং। উত্তর দিতে সময়সীমা ছিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা, তাঁর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে আইনের পথে যেতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। সে ক্ষেত্রে তাঁর ১ থেকে ২ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। যদিও সেদিন আলাপনবাবু জানিয়েছিলেন, শো–কজের জবাব তিনি দেবেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার জবাব দেওয়ার সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে তিনি জবাব দেন। যদিও চিঠিতে তিনি ঠিক কী লিখেছেন, প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি প্রকাশ্যে তা জানাননি। তবে সূত্রের খবর, চিঠিতে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ঢাল করেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন কলাইকুণ্ডায় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আমি হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই আমি তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে যাই। আমি তো মুখ্যমন্ত্রীর অধীনেই কাজ করি। তাই তাঁর নির্দেশই আমাকে পালন করতে হয়। এ ব্যাপারে আমার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ।’ এখন দেখার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার সন্তুষ্ট হয় কিনা। তবে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, অনেক ভাবনাচিন্তা করেই এই চিঠি তিনি লিখেছেন। অতি সচেতন ভাবেই তিনি সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ওপর। এ ক্ষেত্রের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও পদক্ষেপ করতে পারে না। তাই আলাপনবাবু নিজেকে রক্ষা করতে এই পথ গ্রহণ করেছেন। তাই কেন্দ্রীয় সরকার এবার কী পদক্ষেপ করে, সে দিকেই এখন তাকিয়ে রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহল।
উল্লেখ্য, ২৯ মে শুক্রবার আকাশপথে ওডিশা এবং পশ্চিমবাংলার ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি দেখেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর পর তিনি কলাইকুণ্ডায় রাজ্যের সঙ্গে একটি পর্যবেক্ষণ বৈঠকে যোগ দেন। সেখানে থাকার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নির্দেশ গিয়েছিল তৎকালীন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বৈঠকে থাকার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। কিন্তু তাঁরা কেউই ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছননি বলে অভিযোগ। তাঁদের জন্য ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তার পর তাঁরা এলে কেন্দ্রীয় আধিকারিকরা মুখ্যসচিবের কাছে জানতে চান, তিনি বৈঠকে যোগ দেবেন কিনা? কিন্তু মুখ্যসচিব মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বাংলার জন্য একটি দাবিপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে যান। বৈঠকে যোগ দেননি।
ঘটনার পরই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে তলব করা হয়। সেই সঙ্গে ৩১ মে দিল্লিতে গিয়ে তাঁকে ডেপুটেশন ভ্যাকেনসিতে কর্মিবর্গ মন্ত্রকের কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতায় থেকে কাজ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ খারিজ করে দেয়। এর পরই ৩১ মে–তে মুখ্যসচিবের পদ থেকে অবসর নেন আলাপনবাবু। তার পর সেদিনই মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন। অনেকে ভেবেছিলেন, আলাপনবাবু হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। এর পরই ১ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো–কজ করা হয়।
এর মধ্যে আরও একটি খবরে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহল। বৃহস্পতিবার আলাপনবাবুর ভ্রাতৃবধূকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় করোনা সংক্রমিত হয়ে প্রয়াত হন। তিনি জি বাংলা ২৪ ঘণ্টা নিউজের এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রয়াত অঞ্জনবাবুর স্ত্রীর অদিতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাকরি দেওয়ার কথা শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন। তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে রাজ্য উন্নয়ন পর্ষদের নতুন উপদেষ্টা হিসেবে। মূল বেতন প্রতি মাসে ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সরকারি যাবতীয় সুযোগ ও সুবিধা তিনি পাবেন। আপাতত তিন বছরের জন্য তাঁকে ওই পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁর পদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে।
এ ছাড়া, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি উপাচার্য হওয়ার পরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ডি লিট’ দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর রাজ্যের ত্রাণ বণ্টনে যে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তার তদন্তে একটি কমিটি নিয়োগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি। স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারের ‘সুসম্পর্ক’ বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভুরু কুঁচকে দেখতে শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, বুধবারই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছিলেন, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। তাই তাঁকে আড়াল করার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার।