উপমন্যু রায়
মুখোশে ঢাকা মানুষের পথেঘাটে চলাফেরা করাটা এখন অতিস্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে মুখোশের পরও আরও একটি নতুন ব্যাপার এই মুহূর্তে রাস্তায় চোখে পড়ছে। তা হল, মাথায় ব্যান লাগানো হেলমেট। মুখোশের ওপর দিয়ে সারা মুখ ঢেকে রেখেছে প্লাস্টিক কাচের একটি আবরণ। মানে করোনা যাতে আমাদের চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করতে না পারে।
এখানেই তো শেষ নয়। এর পর পিপিই পোশাকের কথা বলা যেতে পারে। পিপিই মানে পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট। বাংলায় সুরক্ষা বর্ম বলা যেতে পারে। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, শুধু চিকিৎসক ও হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা ওই পোশাক পরে থাকবেন। পরে পাড়াগুলিতে দেখা গেল ওই পোশাক পরা পুরকর্মীদেরও। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও আচমকাই সাধারণ মানুষ ওই পোশাক পরে সকলের নজর কেড়ে নিয়েছেন। তা খবরেও এসেছে।
হয়তো আগামিদিনে অধিকাংশ মানুষকেই ওই পোশাক পরে পথে চলাফেরা করতে হবে। আর— তা হলে তো ষোলো কলা একেবারেই পূর্ণ হয়ে যাবে! তখন দেখতে কেমন অদ্ভুত হয়ে যাব আমরা, একবার ভেবে দেখুন তো! আমাদের আসল চোখ–মুখ চলে যাবে সকলের দৃষ্টির আড়ালে। কেউ কারও প্রকৃত চেহারা দেখতে পাব না। জানি না তখন কবিরা সুন্দর মুখশ্রী দেখে আপ্লুত হওয়ার কবিতা কী করে লিখবেন! শিল্পীরাই যে কী করে তখন মোহময়ী নারীর ছবি আঁকবেন, কে জানে!
তার চেয়েও বড় কথা, তখন আমাদের শরীরের ছবি বাইরে থেকে কেমন দেখতে হবে, ভেবে দেখেছেন একবারও? মহাকাশযানে চরে যখন অভিযাত্রীরা পৃথিবীর বাইরে যান, অনেকটা যেন সেই মহাকাশচারীদের মতোই লাগবে আমাদের। চাঁদের বুকে যখন নীল আর্মস্ট্রং বা বাজ অলড্রিনরা হেঁটে বেড়িয়েছিলেন, তখন তাঁদের শরীরে যেন এই রকমই পোশাক থাকত। অবশ্যই মহাকাশচারীদের সেইসব পোশাক থাকে পুরোপুরি আলাদা। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কী, সেই পোশাক যেন দেখতে পুরো আমাদের মতোই।
এবার আর একটু এগিয়ে ভাবি চলুন। প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগবে, তা ওই পোশাক পরে আমরা পৃথিবীতে কেন? সহজ উত্তর, করোনা–আতঙ্ক। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। কিন্তু তেমন অভিনব পোশাক পরে যখন আমরা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব, তখন যদি কিছুক্ষণের জন্য মন থেকে করোনা–ভাবনা মুছে দিতে পারি, কী মনে হবে আমাদের দেখে? মনে হবে, পৃথিবীতে বুঝি ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসেছে! তারাই ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে!
তবে সেই ভিনগ্রহীরা অন্য কেউ নয়, খোদ আমরাই। আর আমরা হেঁটে–চলে বেড়াচ্ছি আমাদেরই পৃথিবীতে, অন্য কোনও গ্রহে নয়। —আমাদের সেই গ্রহ, সেই পৃথিবী, আমাদেরই জীবনের উপযোগী বাতাস, মাধ্যাকর্ষণ —সবই আছে যেখানে। তবু আমরা আজ নিজেদের গ্রহেই ক্রমশ হয়ে যাচ্ছি যেন ভিনগ্রহী। যেন নিজগৃহে পরবাসী!
এ কথা ঠিক, ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব বিষয়টা আজ আর অলীক কোনও কল্পনা নয়। অসীম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত লক্ষ–কোটি গ্রহ, নক্ষত্র বা ছায়াজগৎ আছে, তার নির্দিষ্ট হিসেব আমরা করে উঠতে পারিনি। কোনও দিনই পারব না। কারণ, বিশ্বসংসারের যে শেষ নেই! যদি শেষ থাকেও, তার পরেও তো কিছু থাকবে। এ কথা তো আমরা বলতে পারব না যে, ওই সীমার পর মহাবিশ্বের শেষ! যদি পারি, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, তা হলে তার পর কী আছে? উত্তর তো একটাই, আর কিছু না থাক, শূন্য তো থাকবে। তার মানে অসীম শূন্যের মাঝেই পৃথিবী নামক একটি গ্রহের বাসিন্দা এখন আমরা।
এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে শুধু আমরাই একমাত্র প্রাণী, এমন অহঙ্কার করাটা বোকামিই হবে। অন্য অনেক গ্রহে বহু বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখনও উন্নতির সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি, যার জোরে আমরা পৌঁছে যেতে পারি সেই প্রাণীদের কাছে! তাই আমরা না পারলেও এ কথা বলা কিন্তু অযৌক্তিক হবে না যে, অনেক–অনেক দূরের কোনও জগতের কোনও গ্রহে রয়েছে আমাদের মতন অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী। রয়েছে তাদের যথেষ্ট উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
কিন্তু আমরা? আমরা কি সত্যিই এই পৃথিবীর প্রাণী বা জীব? ভিনগ্রহে প্রাণ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন এবং এখনও করছেন, তাঁদের মধ্যে একটি ভাগ তো বিশ্বাসই করেন যে, মানুষ নাকি পৃথিবীর প্রাণী নয়। অতীতে কোনও এক সময় অন্য কোনও গ্রহ থেকে কোনও ভাবে নাকি এই পৃথিবীতে চলে এসেছিল সে। সূচনা করেছিল নতুন সভ্যতার। তার পর গড়িয়েছে অনেক সময়। একটি সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু তার পর ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে আরও একটি নতুন সভ্যতা।
যদি তাই হয়, তা হলে আমরা এলাম কোত্থেকে? যাঁরা মানুষকে পৃথিবীর প্রাণী বলে স্বীকার করেন না, তাঁদের মতে, মানুষ হয়তো এমন কোনও গ্রহের বাসিন্দা ছিল, যে গ্রহে হয়তো বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই সে মহাকাশে বসবাসের উপযুক্ত নতুন কোনও উপযুক্ত গ্রহ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। যেমন এখন মাঝে মাঝেই শোনা যায়, পৃথিবীতেও নাকি ক্রমে ফুরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে আমাদের বেঁচে থাকতে এবং এই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নতুন আর একটি বসবাসের উপযোগী গ্রহ দরকার।
আর সেটা যে দরকার, তার প্রমাণ তো এখন যেন দিয়ে দিতে শুরু করেছে কোভিড–১৯, মানে ওই নভেল করোনা ভাইরাস। যে কারণে এখন আমাদের দরকার হয়ে পড়ছে মাস্ক বা মুখোশ, গ্লাভস, পিপিই। হয়তো সে–সব আমাদের স্থায়ী সঙ্গী হতে শুরু করেছে। কারণ করোনা আমাদের ছেড়ে না যাওয়ারই জন্য যেন ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে প্রতি মুহূর্তে। গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডেভিড বিসাই তো ইতিমধ্যে তাঁর বিস্তারিত গবেষণা পত্রে বলেই দিয়েছেন, আগামী ২ বছরে নাকি গোটা পৃথিবীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষই করোনায় আক্রান্ত হতে চলেছেন। ভাবা যায়!
যদিও এই মারণ ভাইরাসের ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বলা বাহুল্য, এখনও সে বিষয়ে সফল হতে পারেননি কেউই। যদি তাঁরা সফল হনও, সেই ওষুধ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে নাকি দু’বছর গড়িয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, তার মধ্যে যদি পৃথিবীর ৫০ শতাংশ মানুষও করোনা সংক্রমণের কবলে পড়েন, সেই সংখ্যাটা হবে ৩৫০ কোটির বেশি।
শুধুই কি বিসাই? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ কী বলছে? ইতিমধ্যে চিনের পাশাপাশি তাদের আচরণ নিয়েও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছে। জার্মানির একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক তো অভিযোগ করেছে, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নাকি ফোনে কথা বলেছিলেন হু–র প্রধান ট্রেডস অ্যাডানম গেব্রেসাসের সঙ্গে। করোনাকে মহামারী ঘোষণা করতে প্রথমে নাকি হু–কে বারণ করে দেন জিনপিং। তাঁর কথামতোই চলেছে হু। যদিও এই অভিযোগ ‘হু’ অস্বীকার করেছে।
তবে, সেই হু–রই আপৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগের ডিরেক্টর মাইকেল রায়ানের একটি মন্তব্য চমকে দিয়েছে আমাদের। বলেছেন, আমাদের নাকি করোনাকে সঙ্গী করেই আজীবন বেঁচে থাকতে হবে। তাই তার প্রস্তুতি নেওয়াটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার মানে আমাদের অঙ্গে স্থায়ী হতে চলেছে মাস্ক, কাচে ঢাকা মুখ এবং পিপিই! মানে সেই ভিনগ্রহীদের মতোই।
আর সেই বেশেই আমাদের হেঁটে চলে বেড়াতে হবে এই পৃথিবীর পথে পথে! কোনও ভাবে যদি এই আবরণ খসে যায় শরীর থেকে, নিশ্চিত হয়ে যাবে করোনা সংক্রমণ, এবং হয়তো মৃত্যু। তাই বেঁচে থাকার জন্য আমাদের ঢেকে ফেলতে হবে নিজেদের সারা শরীর। অতএব, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, সেই পোশাকই আমাদের ভরসা।
কিন্তু এমন পৃথিবী তো আমরা চাইনি! সেই স্বাভাবিক পৃথিবী, যার পথঘাটে অবিরাম পদচারণা ছিল আমাদের, যার প্রান্তরে গাছের ছায়ায় বসে নিবিড় আড্ডায় মেতে উঠতাম আমরা, যার শহুরে পথে গতির সঙ্গে তাল মেলাতে ছুটতে হত অদম্য, সেই পৃথিবীকে কি আর ফিরে পাব না আমরা?
আজ এই পৃথিবীটা আমাদের কাছে বড়ই অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।