আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধি।
‘আত্মহত্যা’ সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ‘শব্দ’ এবং ‘কাজ’। আত্মহত্যার চেয়ে ভয়ংকর বিব্রতকর এবং কষ্টকর কোনো প্রেক্ষাপট সমাজে আর একটিও নেই। কিন্তু তার পরও ঘটনাটি ঘটে এবং বলা যায় হরহামেশাই ঘটে। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার কারণে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত তথাপি আত্মহননের মতো নিকৃষ্ট কাজ থেকে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।
সাম্প্রতিক কিছু দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনা পৃথিবীর উচ্চ আত্মহত্যা প্রবণতার দেশগুলোর তালিকায় নিয়ে এসেছে বাংলাদেশকে। ব্যাধিটা যখন মনের তখন স্বাভাবিকভাবেই তা সবার অলক্ষ্যে থেকে যায়। শারীরিক রোগ-বালাইয়ের মত তেমন গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় না নিরাশা অথবা ভয়ের মত মানসিক অবস্থাগুলোকে। কিন্তু আত্মহত্যার মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কমাতে হলে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর ২০১৯ সালের তথ্যমতে বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কেউ না কেউ আত্মহত্যা করে। একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায় পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিবছর এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি এবং এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালে প্রায়ই ৬০০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়েছে এদের মধ্যে ৩৪০ জন বিভিন্ন স্কুলের, ১০৬ জন দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। অবশিষ্টদের মধ্যে ৮৫ জন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪ জন ছিলেন বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায় বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়েই মানুষ মৃত্যুর সহজতম পথ হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক ও মানসিক কারণেও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মাদকাসক্তি, জয়-পরাজয়, ইভটিজিং ও যৌন হয়রানির শিকার, অবহেলা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি, নিঃসঙ্গতা বা দীর্ঘ মেয়াদী বিষন্নতা, অবসেশন, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে অসঙ্গতি বিধান ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে থাকে।
তবে একটি আত্মহত্যা সংঘটিত হতে হলে একাধিক কারণ সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয় বা কাজ করে। একক কোনো কারণ হঠাৎ করে কোনো আত্মহত্যা ঘটায় না। অধিকাংশ আত্মহত্যার পেছনেই কোনো না কোনো মানসিক কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে।
আত্মহত্যার প্রতিকার হিসেবে প্রথমত ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অর্থাৎ যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বা চিন্তা আছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত প্রত্যেকের Psychological Assessment এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া সন্তানের প্রতি পরিবারের সদস্যদের বেশি যত্নশীল হতে হবে এবং সন্তানের আচার-আচরণ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সমাজে এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে কেউ নিজেকে কখনও নিঃসঙ্গ বা ছোট মনে না করে। এছাড়া মাঝেমধ্যে আত্মহত্যা বিরোধী সভাসমাবেশ এবং কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। মিডিয়ায় আত্মহত্যা বিষয়ক সংবাদ যথাসম্ভব কম প্রচারও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আত্মহত্যা নিঃসন্দেহে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামি শরিয়তে আত্মহত্যা করা হারাম। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন-
‘আর (হে মুমিনগণ!) তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)।
পরিশেষে বলতে চাই জীবনে যত খারাপ সময়, দুঃখ-কষ্ট, ডিপ্রেশনই আসুক না কেন এদের মোকাবেলা করার মানষিকতা তৈরি করতে হবে এবং বেঁচে থাকতে হবে। কারণ বেঁচে থাকার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি বিদ্যমান। কথায় আছে যে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় উপহার দ্বিতীয়টি নেই।
লেখক: শাকিল আহমেদ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।