1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  4. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  5. shanto.hasan000@gmail.com : Rakibul Hasan Shanto : Rakibul Hasan Shanto
  6. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  7. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  8. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :

‘আয়না ঘর’ গনতন্ত্রের আড়ালে শেখ হাসিনার এক রাষ্ট্রীয় জাহান্নামের নাম

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪
  • ১০৭ Time View

‘আয়না ঘর’ গনতন্ত্রের আড়ালে শেখ হাসিনার এক রাষ্ট্রীয় জাহান্নামের নাম।

(তৃতীয় পর্ব)

এভাবেই  ২০১৬ সালের ৯ই আগস্ট আহমদ বিন কাসেম (আরমান)কে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েকদিন পর ২৩শে আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয় বলে তাদের পরিবারের অভিযোগ তেমনই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলীকে অনেক আগেই হত্যা করা হয়েছে। যা মাত্র কয়েক দিন আগে মানুষ জানতে পারে।

বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতাকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন র‌্যাবের তৎকালীন কর্মকর্তা, পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রানা। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত র‌্যাব সদর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন।

এক ভিডিও বার্তায় মাসুদ রানা বলেন, ‘আপনারা যারা বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায় আছেন, তাদের জন্য দুঃখজনক সংবাদ। তাকে অনেক আগেই হত্যা করা হয়েছে।’
ইলিয়াস আলীকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে র‌্যাবের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তাকে পতেঙ্গা সৈকত দিয়ে কড়া পাহারায় সাগরে মধ্যে নেওয়া হয় স্পিডবোটের মাধ্যমে। মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করে, তার পেট ছুরি দিয়ে ছিদ্র করে পাথর দিয়ে বেঁধে সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

র‌্যাবের এই সাবেক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘শুধু ইলিয়াস আলী নন, অনেক নেতার তথ্য যারা পাননি, কিছু মানুষ তো আয়নাঘরে থেকে উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু যাদের তথ্য আপনারা পাননি, তাদের এই করুণ পরিণতি হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যায়।

মোঃ সেলিম  বিদেশ ফেরত  একজন মানুষকে গোপালগঞ্জে হাসিনার সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় জড়াতে এবং টাকার জন্য বহুদিন আটকে রাখে সেখানে।

মোবাশ্বের,  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকেও থাকতে হয়েছিল এই জাহান্নামে দীর্ঘ দিন।  চাঁদপুর এর মোঃ ফয়েজ। একজন ছাত্র। তার বর্ননায় বীভৎস ভাবে ফুটে উঠেছে আয়না ঘরের নির্মমতার গল্প।

১১ জানুয়ারি, ২০২০, শনিবার। ঢাকার উদ্দেশ্য বের হচ্ছি, আম্মার চোখে পানি। বাসার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার চোখেও পানি এসে গেলো। আম্মার সামনে শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি, নয়তো হাউমাউ করে কেঁদে দিতো।

কাল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু।সকালবেলা হাজীগঞ্জ বাজার থেকে বাসে উঠলাম।
যাত্রাবাড়ী মোড়ে নেমে হালকা নাস্তা করলাম। যাব মিরপুর, আমার ফুফাতো বোনের বাসায়। কিছুদিন আপাতত  থেকে তারপর দেখেশুনে মেসে উঠবো, এই হলো চিন্তা।

হোটেল থেকে নেমে মাত্র এক দু কদম হাঁটলাম, তখন ভরদুপুর। হুট করে পাঞ্জাবি পরিহিত একজন সামনে এসে আমার নাম ফয়েজ কিনা জিজ্ঞেস করলো। হ্যাঁ বললাম। বলে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে। সাহস করে বললাম আপনারা কারা? বলে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’।

বললাম ‘কোনো পোশাক নেই, আইডি কার্ড নেই। আর এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
বলে ‘গেলেই দেখতে পাবেন’।

আর অমনি শক্ত করে জাপটে ধরে কাছের এক জিপগাড়িতে উঠালো। মুহুর্তেই মধ্যেই দুই হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ালো। চোখ বাঁধলো, তার উপর জমটুপি:গলা অবধি ঢেকে যায় যার, তার উপর আবার চোখ বাঁধলো। সাথে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই এতসব ঘটে গেলো।

অনুরোধ করলাম, আম্মাকে একটু কল দিয়ে বলি অন্তত ঢাকা পৌঁছেছি, নয়তো চিন্তা করবে। অনুরোধ রাখলো না। রাখবে কেন? মায়ের কান্না, মায়ের আকুতি ওরা কী বুঝবে!

হাই বিটের গান ছেড়ে দিলো গাড়িতে, যেন আশেপাশের আওয়াজ কানে না যায়। একই রাস্তায় কয়েকবার যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে, গোলকধাঁধার মতো। এভাবে ঘন্টাখানেক পর গাড়ি থামলো।

কিছুক্ষন পরে নিয়ে গেল ইন্টারোগেশন রুমে। এয়ার ফ্রেশনারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। মাথার ঠিক উপরে দেয়াল ঘড়ি, চারপাশ নিস্তব্ধ, ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ মগজে গিয়ে ঠেকছে।

দুর্বিষহ দিনের শুরু, পালা করে জিজ্ঞাসাবাদ আর নির্মম মাইর। এত নির্মমভাবে মানুষকে মারে? শরীরের হাড্ডি-মাংস যেন এক হয়ে যায়।

সেদিনের মতো ইন্টারোগেশন শেষ!
হ্যান্ডকাফ খুললো, পোশাক পালটে নতুন পোশাক দিল, চোখ তখনও বাঁধা।

নিস্তেজ শরীর দুজন মিলে ধরে দিয়ে আসলো এক সেলে। সারাদিনে ঐ প্রথম চোখের বাঁধন খুললো। কিন্তু বুঝার উপায় নেই কোথায় আছি।

ছোট্ট রুম, লম্বাটে শেইপ, একপাশে একটা খাট পাতা। পুরো রুমে ছাদের সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট জানালা, দেখার উপায় নেই বাইরে কী হচ্ছে। দরজায় ডাবল লেয়ার। একটা জেলখানার মতো শিক, সাথেই লাগোয়া আরেকটা কাঠের দরজা, মাঝখানে একটু ছিদ্র, সেটাও বন্ধ থাকে, ভেতর থেকে খোলার উপায় নেই। দরজার নিচের দিকে ছোট্ট একটা জায়গা, খাবার এদিক দিয়ে দেয়। খুজছিলাম কোথাও কোনো ক্লু পাই কি না, দেয়াল এবড়োখেবড়ো, লেখার সুযোগ নেই কোনো। রুমের এক কোনায় অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা।

বিশাল বড় এগজস্ট ফ্যান, বাইরের শব্দ যেন কানে না এসে, যেন অনুমানও না করা যায় কোথায় আছি। এত জোরে আওয়াজ করে ঘুরতো যেন জেট বিমান যাচ্ছে, তখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছিলো, মাইকিং হতো, তাই প্রায় সারাদিনই চলতো।

মনে হতো একটা কবরের মধ্যে আছি। আমি একা, আর কেউ নেই। বাইরের মানুষের কাছে হয়তো আমি মৃত, কিন্তু আমি জানি আমি জীবিত, জীবন্মৃত। মুনকার নাকির(!) প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে, সন্তোষজনক উত্তর না দিলে নির্মম অত্যাচার।

বাড়ির কথা খুব মনে পড়তো। আম্মার সাথে কবে রাগ দেখিয়েছি, আব্বার কোন কোন কথা শুনিনি, ভাইয়ার সাথে কবে মারামারি করেছি, পিচ্ছি ৩টা ভাগ্নে-ভাগ্নি ছিলো। আল্লাহ…..।

আম্মা খুব কান্না করছে এটা মনে হতো। বড় মামা মারা গিয়েছে একমাসও হয়নি, এর উপর আমার হারিয়ে যাওয়া…..

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। রাতে একটু আরাম করে ঘুমাবো, সেই সুযোগ নেই। সারা শরীর ব্যাথা। খাবার যা দেয় গলা দিয়ে নামে না। বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া, টিকে থাকার জন্য খাওয়া।

পাশের সেলে মানুষের উপস্থিতি টের পেতাম, কিন্তু কথা বলার সুযোগ নেই। গার্ড থাকে সবসময়। এক ভাই প্রায় সারাদিনই কান্নাকাটি করতো, চিৎকার করতো, আল্লাহ জানেন উনার উপর দিয়ে কি গিয়েছে।

১০/১২ দিন পর অন্য আরেকটা রুমে পাঠায়। একটু পুরনো ধাচের। কিছুটা মসৃণ দেয়াল।
দেয়ালের এখানে সেখানে আলতো করে খোদাই করা অনেক লেখা। একেক রকম হাতের লেখা। কত শত মজলুমের স্মৃতি। কেউ আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছেন, কেউ মুক্তির দু’আ করছেন। এক জায়গায় অনেকগুলো দাগ কাটা, কতদিন এখানে ছিলেন তার হিসাব, এক দেয়াল ভরে গিয়ে পরের লাইনে এসেছে, দাগ কাটা শেষ হয়না।

সবরকম নির্যাতনের ব্যবস্থাই ছিলো। একেক জনের সাথে একেক রকম নির্যাতন। ওয়াটার বোর্ডিং, ইলেকট্রিক শক, বাঁশ ডলা, ছাদের সাথে ঝুলিয়ে পেটানো….নক উপরে ফেলা, আরো কতো কি!

এভাবে ৪২ দিন পার হয়। অতঃপর আমাকে বলা হলো আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারব। তবে….. আমাকে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।

প্রসঙ্গিত, আয়নাঘর থেকে কাউকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া হয়না। হয় ক্রসফায়ার দেয়া হয়, নয়তো মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরে, যেন বের হয়ে মুখ খোলার সাহস না করে। তারা নিজেরা কখনও মামলা দেয় না, সাধারণত র‍্যাবের মাধ্যমে দেয়।

আমাকে হাত চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়, শুরু হয় আরেক আয়নাঘরের জীবন। এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সবমিলিয়ে ২দিন। জিজ্ঞেস না করে পশুর মতো পেটানো যার উদ্দেশ্য।

এখানে যেই রুমে ছিলাম সেটা বেশ বড়োসড়ো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুরনো বিল্ডিং, জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গা, মেঝে-দেয়ালে-ছাদে।
মাঝে করিডোর, সেখানে কিছু লাইট জ্বলে, দুপাশে ৫টা করে মোট ১০টা রুম। পালাকরে ওয়াশরুমে নিতো, কাছাকাছি রুম হওয়ায় অনুমান করেছিলাম, মোট ১০ বার তালা খুলতো আর লাগাতো।

সবচেয়ে নির্মম ব্যাপার কি জানেন?
২৪ ঘন্টা চোখ বেঁধে রাখতো, এমনকি রুমের মধ্যেও। সূর্যের আলো দূরে থাক, আলো দেখারই সুযোগ নেই। গার্ড না থাকলে মাঝে মাঝে চোখের নিচ দিয়ে আশেপাশে দেখতে চাইতাম। আমার চশমার পাওয়ার -3.50, একটু দূরেই ঝাপসা দেখি, তাই খুব একটা লাভ হয়নি।

২৪ ঘন্টা হাতে হ্যান্ডকাফ পরা থাকতো। রাত ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দুহাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ দিতো। রাতে যে একটু ঘুমাবো সেই সুযোগ নেই। কিচ্ছুক্ষণ বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে, কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে…। কত জঘন্য।
ওয়াশরুমে গেলে শুধু একহাতেরটা খুলতো।
হাতে দাগ পড়ে গিয়েছিলো এভাবে।

মেঝেতে একটা কম্বল বিছানো ছিল। এত নোংরা, এর উপর উঠলেই শরীরে চুল্কানি হয়। বাধ্য হয়ে মেঝেতে ঘুমাতাম। উপুড় হয়ে দুই হাত পেছনে রেখে মেঝেতে ঘুমাতে কেমন লাগতো!?

এক গার্ড ছিলো একটু ভালো, অনেক অনুরোধ করলাম অন্তত এটা বলুক জায়গাটা কোথায়। বললো র‍্যাব ১।

টানা ৩০দিন এভাবে ছিলাম।

অতঃপর আমাকে নতুন আরেক জায়গায় নিয়ে গেলো। আয়নাঘর নং ৩। সেখানে এক রাত ছিলাম। একদম ছোট একটা রুম, রুমের মধ্যেই কমোড, ঠিকমতো ঘুমালে কমোডে পা চলে যায়, পাশে সর্বোচ্চ ২ হাত প্রশস্ত।

সে রাতেই এসে পাঞ্জাবির মাপ জানতে চাইলো।
চিন্তায় ঘুম হয়নি আর।

(চলবে..)
লেখক ঃ লতিফুর রহমান, আইনজীবী ও লেখক।

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..