‘আয়না ঘর’ গনতন্ত্রের আড়ালে শেখ হাসিনার এক রাষ্ট্রীয় জাহান্নামের নাম।
(দ্বিতীয় পর্ব)
এরপর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে সরকার চালাকি করে আরও সমস্যা ঝুলে রাখে বিষয় টা। পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে ভোট বিহীন নির্বাচনের নাটক দেখার দুর্ভাগ্য হয় জনগণের। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের পুর্বে বি এন পি সহ বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ নাশকতা ও জংগী তকমা লাগিয়ে আন্দোলন ভূলন্ঠিত করে সরকারের সাজানো গোছানো প্রশাসনের সহায়তায় ভাগ বাটোয়ারার নিউ ভার্সন নির্বাচন এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও চেপে বসে বাংলাদেশের জনগণের বুকের উপর।
এরপর অনেকটা আকস্মিক ভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির দূত হয়ে যেন ফিরে আসে আবারও কোটা আন্দোলন। হাইকোর্টের দেয়া মুক্তিযোদ্ধার নাতি নাতনি দের পক্ষে কোটার রায়ের প্রতিবাদে এক অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়, দূর্বার আন্দোলনের স্বাক্ষী হলো বাংলাদেশ। রংপুরের পীরগঞ্জ এর বীর শহীদ আবু সাঈদ এর হত্যার পরে আন্দোলনের আগুনের স্ফুলিঙ্গ পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের সাথে সমাজের প্রতিটি মানুষ (আওয়ামী লীগ ব্যতীত) রাজপথে নেমে এলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। শত শত ছাত্র জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় বাংলাদেশ। সরকারের বুলেট ও থামাতে পারেনি আর। এরপর ঘটনা প্রবাহ এখনো দগদগে মানুষের হৃদয়ে। ৫ আগষ্ট ২০২৪ এ শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে গেলে, দেশ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে । সেই ঘটনা এখনো মুখে মুখে মানুষের। শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে গেলে সেনাবাহিনী, ছাত্র জনতা খুঁজে বেড়ায় সরকারের গোপন কারাগারে জীবন্ত কিংবা মৃত মানুষের লাশ।
মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান, গোলাম আজমের ছেলে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আজমী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা আয়না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেই রোজ রোজ বিভৎস নির্যাতনের কাহিনি বের হতে শুরু করেছে এক টার পর একটা। তথ্য মতে,
হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, হাসিনা দ্বিতীয় বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। অর্থাৎ, তাঁর শাসনকালেই ‘আয়নাঘর’-এর শুরু। তথ্য বলছে, ওই বন্দিদের মধ্যে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে এত দিন ১৫১ জন বন্দি ছিলেন বলে সূত্রের খবর। তাঁদের মধ্যেই তিন জনের মুক্তি হয়েছে। ওয়াকিবহাল লোকজনের বক্তব্য, ‘‘আয়নাঘর হল এক গোপন গুমখানা।’’ ওই ‘গুমখানা’র দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স’ (ডিজিএফআই)। কিন্তু বছরের পর বছর এই আয়না ঘর নিয়ে মানুষের কল্পনার বাহিরে ছিলো।
আয়নাঘর’ ছিল ঢাকা শহরে ডিজিএফআই সদর দফতরের ঠিক পিছনে। সেখান থেকে ছাড়া-পাওয়া এক প্রাক্তন বন্দির কথায়, ‘‘উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং। দক্ষিণে মেস বি। পূর্ব পাশে কয়েকটি সরকারি দফতর। পশ্চিম পাশে ডিজিএফআইয়ের ফাঁকা ছাউনি। উত্তর-পূর্বে ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। আর মাঝখানে একটা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানেই (ওই গুমঘর)। ওই গুমঘরের ছদ্মনাম ‘আয়নাঘর’।’’ সুইডেন ভিত্তিক পত্রিকা নেত্রনিউজ এর রিপোর্টে সর্বপ্রথম ২০২২ সালে এই গুপ্ত কারাগার নিয়ে রিপোর্ট হলে আমরা প্রথম জানতে পারি। কিন্তু সরকার সেদিন সব কিছু অগ্রাহ্য করে অস্বীকার করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলো এই নিয়ে সোচ্ছার হলেও ফ্যাসিস্ট, এক নায়ক সরকার সেই পথ পরিহার না করে একটার পর একটা অপহরণের নাটক সাজিয়ে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস ধরে এসব নির্জন টর্চার সেলে আটকে রাখে সরকারের বিরুদ্ধে কন্ঠস্বর গুলো কে। সেখানে আটক থাকা এবং পরবর্তীতে মুক্তি পাওয়া মানুষের মুখে সেখানকার নির্মমতার গল্প শুনে শিউরে ওঠে শরীরের লোম।
বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান। তিনি দু’বার ‘গুম’ হয়েছিলেন আয়নাঘরে। হাসিনুর জানিয়েছেন, আয়নাঘরের অবস্থান তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শৌচাগারের কমোডের উপরে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে লাগানে এগজ়স্ট ফ্যানের গর্তের একচিলতে ফাঁক দিয়ে। হাসিনুরের কথায়, ‘‘কর্মসূত্রে ওই জায়গায় এসেছি। জায়গাটা আমি চিনে ফেলি।’’ তাঁর বিবরণেই চোখের সামনে ফুটে উঠেছে আয়নাঘরের অন্দরমহল। আয়নাঘরের দু’টি বিভাগ। একটি ১৬টি কুঠুরির পুরনো বিভাগ। অন্যটি ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগ। প্রতিটি ঘর ‘শব্দরহিত’। ভিতরের আওয়াজ যাতে বাইরে না যায়, তার জন্য প্রতি পাঁচটি ঘরপিছু দু’টি করে বড় এগজ়স্ট ফ্যান লাগানো। ১০টি কুঠুরির নতুন বিভাগটিতে চারটি এগজ়স্ট ফ্যান ছিল বলে জানিয়েছেন হাসিনুর।
এগজ়স্ট ফ্যানের কথা শোনা গিয়েছে দ্বিতীয় প্রাক্তন বন্দি শেখ মোহাম্মদ সেলিম হোসেনের দেওয়া বিবরণেও। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্যানগুলো দিনে এক বার বন্ধ হত। বন্ধ হলেই শুনতে পেতাম কান্নার শব্দ। কত লোক কাঁদছে! কোনও কোনও জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আওয়াজটা হঠাৎ বেড়ে যেত!’’
(চলবে)
লেখক: লতিফুর রহমান, আইনজীবী ও লেখক।