যান্ত্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ১ হাজার বছর আগেই বাতাসের চেয়ে ভারী এক যন্ত্র বানিয়ে আকাশে ওড়েছিলেন নবম শতাব্দীর এক মুসলিম দার্শনিক ও ইঞ্জিনিয়ার।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম যান্ত্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করলেও তারও বহু আগে নবম শতাব্দীর ইঞ্জিনিয়ার আব্বাস ইবনে ফিরনাস প্রথম মানুষ যিনি এক জোড়া পাখা নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন। তার পাখাগুলো তৈরি করা হয়েছিল রেশম, কাঠ ও পাখির পালক দিয়ে।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে ফিরনাসের বয়স যখন ৬৫ থেকে ৭০ সে সময় তিনি ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস পর্বতের চূড়া থেকে উড়াল দেন। দশ মিনিটের মতো তিনি আকাশে ভেসে থেকে ছিলেন।
তবে সংক্ষিপ্ত ওই ফ্লাইটে তাকে আহত ও হতাশ দুটোই হতে হয়েছিলেন, কারণ ইবনে ফিরনাস ওড়ার কারিগরি বিষয়গুলো ঠিকভাবে সম্পাদন করলে ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। যে কারণে ওড়ার সময় তিনি ভারসাম্য রাখতে পারেননি। বৈপ্লবিক ওই উড্ডয়নের সমাপ্তি হয়েছিল ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে।
ওই উড্ডয়নের পরও ১২ বছর বেঁচে ছিলেন ইবনে ফিরনাস। সে সময়টাতে তিনি এই বিষয়ে কাজ করেছেন। পাখির ওড়া ও অবতরণের ওপর বিস্তর গবেষণা করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিরাপদ ল্যান্ডিংয়ের জন্য দরকার পাখা ও লেজের সমন্বয়।
এরপর ইবনে ফিরনাস তার কয়েক দশকের গবেষণার উপসংহারে পৌঁছান। তার গবেষণাই পরবর্তীতে অরনিথপটার বানানোর পথ দেখিয়েছে। অরনিথপটার হচ্ছে সেই আকাশ যান, যেটি পাখির মতো ডানা ঝাপটে আকাশে ভেসে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বিমানের ইঞ্জিন তৈরিতেও ইবনের ফিরনাসের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বিমান আবিষ্কারের আগে বহু শতাব্দী ধরেই মানুষের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন ছিল। ডানা নিয়ে মানুষের আকাশে ওড়ার বহু রূপকথা রয়েছে ইতিহাসে। গ্রিক মিথলোজিতে বলা হয়, পিতার নিষেধ সত্ত্বেও ইকারুস উড়তে উড়তে সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন; কিন্তু তাপে তার মোমের পাখনা গলে যাওয়ায় সমুদ্রে পড়ে তলিয়ে যান ইকারুস।
সর্বপ্রথম আকাশে কোনো বস্তু ওড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন দুই চীনা দার্শনিক মোজি ও লু বান। ঘুড়ি আবিষ্কারের নেপথ্যেও তারা দু’জন। পঞ্চম শতাব্দীতে এর মাধ্যমে তারা শত্রু রাষ্ট্রের ওপর নজরদারি করেছিলেন বলে জানা যায়।
আর বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো যন্ত্র নিয়ে আকাশে ওড়া প্রথম মানুষ ইবনে ফিরনাস এবং মানুষের আকাশে ওড়ার পথপ্রদর্শকও এই মুসলিম দার্শনিক।
নবম শতাব্দীতে ইজন-রান্ড-ওনডা আল আন্দালুসে জন্ম তার। যে জায়গাটি আজকের স্পেনের রোন্ডা অঞ্চলের অন্তর্গত। তবে জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন আমিরাত অব কর্ডোভায়, যে জায়গাটি ছিল উমাইয়া খিলাফাহ যুগের জ্ঞান চর্চার প্রসিদ্ধ এক স্থান।
অনেক ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়, ইবনে ফিরনাস তার গবেষণাকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আরমেন ফিরম্যান নামে একজনের দ্বারা। ফিরম্যান বিজ্ঞানী বা দার্শনিক কোনটাই ছিলেন না, তবে প্রকৃতির একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক ছিলেন।
ফিরম্যান সর্বপ্রথম রেশম ও পাখির পালকে মোড়ানো তক্তা দিয়ে পাখা তৈরি করেন। ৮৫০ এর দশকের শুরুর দিকে ফিরম্যান করুতোবার (আজকের কর্ডোভা) সবচেয়ে উচু মসজিদের মিনারে উঠে এই পাখা নিয়ে ঝাপ দেন। যদিও তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি, তবে ভাগ্য ভালো যে মাটিতে পড়লেও খুব বেশি আহত হননি ফিরম্যান। পতিত হওয়ার সময় গতি কম ছিল, যে কারণে তিনি বেঁচে যান।
ইবনে ফিরনাস সেদিন আরো অনেক মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ফিরম্যানের সেই অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করেছেন। এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে, আকাশে ওড়ার জন্য আরো বেশি গবেষণা দরকার।
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তিনি পাখি ও বিভিন্ন উড়ন্ত বস্তুর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর যন্ত্র তৈরি করে ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস থেকে আকাশে ওড়েন।
এর কয়েক শতাব্দী পর ১৬৩০ সালে তুরস্কের বিজ্ঞানী আহমেদ সেলেবি আকাশে উড়ে ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালী পাড়ি দেন।
অন্যান্য উদ্ভাবন:
আকাশে ওড়া ছাড়াও ইবনে ফিরনাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা করতেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পানির শক্তিতে চলা ঘড়ি। বালি ও স্ফটিকের প্রকৃতি জানতে এ দুটি বিষয়েও ছিল তার গবেষণা। অনেক ইতিহাসবিদ স্বচ্ছ কাচ তৈরির কৃতিত্বও দেন তাকে।
বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান কাঁচ তৈরির নেপথ্যেও ইবনে ফিরনাসের নাম বলেন অনেকে। যে কাঁচ এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্ষীণদৃষ্টি শক্তির মানুষদের জন্য যে চশমা ব্যবহৃত হয় সেই কাঁচ আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে তার দীর্ঘ গবেষণা।
ইবনে ফিরনাস ছিলেন উত্তর আফ্রিকার বারবার বংশোদ্ভূত। তার নামের মূল শব্দ আফেরনাস, যে নামটি বর্তমান সময়েও মরক্কো ও আলজেরিয়ায় বহুল প্রচলিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে এই বিখ্যাত দার্শনিকের নামে অনেক বিমানবন্দর, সেতু, পর্বতের চূড়া, পার্ক, সড়ক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে।
ইরাকের বাগদাদ এয়ারপোর্টের কাছে রয়েছে তার একটি বিশাল ভাস্কর্য। স্পেনের কর্ডোভায় গুয়াদেলকুইভার নদীর ওপর ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছে এই দার্শনিকের নামে।
৮৯০ থেকে ৮৯৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আব্বাস ইবনে ফিরনাস ইন্তেকাল করেন। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের সেই আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়।