বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: এ রকম মহাসপ্তমী আর কবে দেখেছে কলকাতা? এ রকম মহাসপ্তমী কবে দেখেছে পশ্চিমবাংলা? করোনা সংক্রমণ এড়াতে পুজোমণ্ডপের ভেতরে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে ছিল বৃষ্টির আশঙ্কা। সকালে দু–এক পশলা হয়েও গিয়েছে। ফলে সপ্তমীর সন্ধ্যায় কলকাতার রাজপথ ছিল জনস্রোতহীন। এ এক অদ্ভুত শহর কলকাতা। এমন নজির কারও মনে পড়েনি। পড়ার কথাও নয়। বাগবাজারের বিখ্যাত ইতিহাস সমৃদ্ধ পুজোর সামনেও কোনও ভিড় দেখা যায়নি এদিন।
তবে সন্ধ্যায় আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়ে দেয়, বৃষ্টির আর তেমন আশঙ্কা নেই। কারণ, নিম্নচাপ সরে গিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। হয়তো সেইজন্যই সপ্তমীর রাত যত বেড়েছে, কলকাতার কিছু পুজো, বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার কয়েকটি পুজোর সামনে রাস্তায় মানুষকে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে। তবে সেই ভিড়কে কখনও আগের বছরগুলির পুজোর ভিড়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তা ছাড়া দর্শনার্থীদের কাউকেই মণ্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। হাতিবাগান, কলেজ স্কোয়ার, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার থেকে একডালিয়া, সিংহী পার্ক, মুদিয়ালি, সন্তোষপুর লেকপল্লি, ত্রিকোণ পার্ক— সর্বত্রই পুজো মণ্ডপের সামনের ছবিটা মোটের উপর এক। সুরুচি সঙ্ঘ, পার্ক সার্কাস সর্বজনীন বা শ্রীভূমির পুজোমণ্ডপে পুরোহিত থেকে শুরু করে ঢাকি–প্রত্যেকের মুখে মাস্ক দেখা গিয়েছে।
বৃষ্টির শঙ্কা ক্রমশ দূরে সরছে। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বদল হয়নি। বোধনের দিনের ছবি বজায় থাকে সপ্তমীতেও। রাজপথে নেমে পুজো দেখার ঢল কম। তারই মধ্যে নজর কেড়েছে এবার হিন্দুস্তান পার্ক সর্বজনীন। এই পুজোর মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে শিল্পী রিন্টু দাস। দেবী দুর্গার কাছে মানত, আঁধার পেরিয়ে যেন আশার আলো দেখা দেয়। আবার যেন স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে পৃথিবী। পুজো মানেই নতুন ভাবনার যুদ্ধ। করোনাকালেও তার হেরফের হয়নি। বরাবরই কলকাতার সেরা থিমের পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম নাকতলা উদয়ন। এ বার তাদের ভাবনা পরিযায়ী শ্রমিক। বেলেঘাটা ৩৩ পল্লীর এবারের ভাবনা স্বজন। মণ্ডপজুড়ে মেলার আমেজ। করোনা কালে অর্থাভাবে পড়া মানুষগুলোই এই থিমের অংশ। সৃজনে শিল্পী শিবশঙ্কর দাস।
করোনা–আতঙ্কে নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হলেও কেউ সামনে থেকে পুজো দেখতে পাচ্ছেন না, হচ্ছে না অঞ্জলিও। বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিনগুলি আর হেঁটে নয়, এ বছর সকলকে নেটেই কাটাতে হচ্ছে। এবার চালতাবাগানের পুজো ৭৮ বছরে পড়েছে। মণ্ডপ তৈরি হয়েছে হোগলা পাতা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে। এই পুজো বিখ্যাত সান্ধ্য আরতির জন্য। এই আরতি হয় সপ্তমীর সন্ধ্যায়। অবশ্য গত বারের ভিড় এবার নেই। কিন্তু আরতির সেই ঐতিহ্য অক্ষয় হয়ে রয়েছে দর্শকদের মনে। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকীতে বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের নিবেদন পথের পাঁচালি। এই মণ্ডপে দেবী দুর্গারূপে ধরা দিয়েছে পথের পাঁচালির দুর্গাই।
পারিবারিক পুজোগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাহাবাড়ির পুজো। এ বছর পুজোর ২২৬ বছর। অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই পুজো ঘিরে। আছে একই ঐতিহ্য। এই বাড়িতে দেবী পূজিত হন হর–গৌরী রূপে। এখানে স্বামী সোহাগী মা দুর্গা। তাঁর অবস্থান শিবের কোলে। এই বাড়িতে দেবী দুর্গা ছাড়া অন্য কোনও দেবী মূর্তির পুজো হয় না। বেহালার ব্রাহ্মসমাজ রোডের মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয়ও রয়েছে অনেক অজানা কাহিনি। এলাকায় এই বাড়ি পরিচিত দুর্গাবাড়ি নামে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই বংশের আদি পুরুষ জগৎরাম মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে জগত্তারিণী দেবী তাঁর মামার বাড়ির দুর্গাপুজোয় গিয়ে অসম্মানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। বাড়ি ফিরে বাবার কাছে আবদার করেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে পুজো করার জন্য। এক রাতের মধ্যে সেই বাড়িতে পুজোর আয়োজন করেছিলেন জগৎরাম। পরের বছর থেকে সেই পুজোই বড় আকার নেয়। ধীরে ধীরে পরিবারের ঐতিহ্য হয়ে ওঠে।
বারোয়ারি অন্য পুজোগুলির মধ্যে কলকাতার অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের এই বছরের থিম ‘কালচক্র’। গভীর রাতের পরেই ভোর আসবে, সেই বার্তায় তুলে ধরা হয়েছে মণ্ডপে। নিজেদের ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পী সৌমিক ও পিয়ালি। শিল্পী ভবতোষ সুতারের ভাবনায় এবার সেজেছে নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘ। আর লড়াই নয়, শান্তির বার্তা দিচ্ছেন দেবী দুর্গা। বালিগঞ্জ ও হিঙ্গলগঞ্জকে এবার মিলিয়ে দিয়েছে সমাজসেবী সঙ্ঘ। থিমের পোশাকি নাম সেতু। থিম শিল্পী প্রদীপ দাস এবং প্রতিমা শিল্পী পিন্টু শিকদারের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য রূপ পেয়েছে মণ্ডপ।
কলকাতা পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্রে খবর, শেষ রাতে জনস্রোত বলে কিছু ছিল না। ট্র্যাফিক এতটাই কম ছিল যে কাউকে সেভাবে সামলাতে হয়নি। মণ্ডপগুলিতে অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিড় একেবারেই ছিল না। তবে রাতের খবর, এদিন প্রতিমা দর্শনের কিছুটা ভিড় দেখা গিয়েছে সল্টলেকের এফডি ব্লকে। অধিকাংশ পরিবারই গাড়ি নিয়ে প্রতিমা দর্শন করতে এসেছে। তবে দূর থেকেই সকলকে প্রতিমা দেখতে হচ্ছে।