উপমন্যু রায়
করোনা ছড়ানোর সন্দেহ বা অভিযোগ থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি চিন। যতই তারা নিজেদের কাঁধ থেকে কোভিড–১৯ ভাইরাস নিয়ে সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলতে চাক না কেন, অধিকাংশ দেশেরই সন্দেহ, পৃথিবী জুড়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে চিনেরই কোনও না–কোনও ভূমিকা রয়েছে। সেটা উহানের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হতে পারে, অথবা প্রকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া, যে ভাবেই হোক না কেন!চিনের পাশে অবশ্য রয়েছে ‘হু’। মানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু এই সংস্থা করোনা সময়ে এই ভাইরাস প্রসঙ্গে যে ভাবে নানা ধরনের কথা বলে গিয়েছে, তাতে তাদের তাৎপর্য আন্তর্জাতিক স্তরে অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। কেউ আর তাদের বক্তব্যকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না।
ঠিক সেই সময়েই, মানে গোটা পৃথিবী যখন এই ভাইরাসকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তখন গালোয়ান উপত্যকায় চিনা বাহিনীর তৎপরতা এবং ভারতীয় সেনার সঙ্গে সঙ্ঘর্ষের ঘটনা চিনের করোনা–ভাইরাস ছড়ানো নিয়ে সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করেছে। মার্কিন সেনটরদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, পৃথিবীকে করোনায় কাবু করে চিন এখন চারদিকে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। মার্কিন বিদেশ সচিব মাইক পম্পিও তো সরাসরি চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘দুর্বৃত্ত’ বলেও অভিহিত করেছেন।
এ কথা ঠিক, চিন যে পাড়ার মস্তানদের মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় ‘দাদাগিরি’ করতে চায়, তার প্রমাণ হরবখত পেয়ে থাকে তাইওয়ান, ফিলিপিনস থেকে ভিয়েতনামও। কিন্তু ভারত বিশাল অর্থনীতি এবং পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ। তাই ভারতের সঙ্গে সেই দাদাগিরিটা তারা ভালো করে দেখিয়ে উঠতে পারে না। সেটাই হয়তো তাদের রাগের একটি কারণ।
তা না হলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা জাপানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে তারা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ে কেন? সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের উপত্যকায় ভারত যদি কোনও নির্মাণকাজ করে, তাতে তাদের মাথাব্যথা এত বেড়ে যায় কেন? সীমান্তে তারা তো নিজেদের উপত্যকায় কোনও নির্মাণকাজ বন্ধ করেনি? ব্যাপারটা কি এক ধরনের মস্তানি নয়?
এই মস্তানিই চিন দেখাতে গিয়েছিল ১৫ জুন। সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, চিনের সেনারা গালওয়ানে পয়েন্ট ১৪–য় ভারতের অঞ্চলে ঢুকে বেশ কয়েকটি তাঁবু খাটিয়েছিল। ভারতীয় সেনারা পাহারা দেওয়ার সময় দেখতে পেয়ে সেই তাঁবুগুলি সরিয়ে দেয়। তখন পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে ছিল চিনের সেনারা। ওপর থেকে প্রথমে তারা পাথর ছোঁড়ে। তার পর লোহার কাঁটা লাগানো রড নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারতীয় সেনার ওপর। শুরু হয় হাতাহাতি। ছুটে আসে ভারতীয় সেনারাও। চলতে তুমুল সঙ্ঘর্ষ।
সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, এই সঙ্ঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং ৪৩ জন চিনা সেনা নিহত হয়েছে। চিনের রেডিও ইন্টারসেপ্ট করে চিনা সেনার মৃত্যুর খবর ভারতীয় সেনা জানতে পেরেছে। ২০ জন সেনার মৃত্যুর কথা ভারত অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে, দুই পক্ষের সঙ্ঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি ভাবে চিন কিন্তু আশ্চর্য নীরব।
চিনের অবশ্য সেটা স্বভাবসিদ্ধ কাজ। সে দেশের ভেতরে কী হয়, তা যেমন বাইরে বের হয় না, তেমনই বাইরের খবরও ভেতরে চেপে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত সে দেশে। তবে বেজিং প্রশাসনের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসের প্রধান সম্পাদক বলেছেন, ‘বেশ কয়েকজন চিনা সেনাও মারা গিয়েছেন।’
সে যাই হোক, এই সঙ্ঘর্ষের পর ইতিউতি অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। তা হল, ভারত–চিন সীমান্তে দুই পক্ষের সেনার মধ্যে মারামারি হয়েছে। কিন্তু গোলাগুলি চলেনি! ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে তো গুলি বিনিময় স্বাভাবিক ঘটনা। চিন সীমান্তে এই ব্যাপারটা রহস্যজনক নয় কি? ভারতেও বিস্ময়কর ভাবে রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তুলেছেন, চিনা সেনার সামনে ভারতীয় সেনা নিরস্ত্র ছিল কেন?
রাহুল গান্ধী সম্ভবত কিছু তথ্য যেমন জানেন না, তেমনই কিছু তথ্য আড়াল করতে চান। যেমন, তিনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বাধীনতার পরের দশকে একজন নেতা বলেছিলেন, ভারত তো কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে না। তা হলে সেনাবাহিনী গড়ার কী দরকার? পুলিশ থাকলেই তো যথেষ্ট। কে বলেছিলেন এ কথা? রাহুল বলবেন কি? ১৯৬২ সালে সেই ভাবনা চূর্ণ করে দিয়েছিল চিনা সেনা।
আকসাই অঞ্চল কী করে চিনের দখলে চলে গেল, তা–ও নিশ্চয় তাঁর অজানা নয়। আর রাজধানীর আড়ালে আবডালে শোনা যাচ্ছে, ২০০৮ সালে ভারতের কংগ্রেস দল এবং চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একটি রহস্যময় মউ চুক্তি হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে মউ চুক্তির কথা শোনা যায়, কিন্তু দুই দেশের দুটি দলের মধ্যে এমন চুক্তি সম্পাদন সত্যিই অদ্ভুত শোনায়। এই চুক্তি নিয়ে রহস্যটা ভাঙার প্রয়োজন রয়েছে। কেন যে ভারতের অন্য দলগুলি বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসকে চেপে ধরে না, কে জানে!
সবই অবশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়। এবার আসল কথায় আসা যাক। ভারত ও চিন সীমান্তে যতই উত্তেজনা দেখা যাক না কেন, গোলাগুলি কিন্তু চলে না। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে শেষবার গোলাগুলি চলার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে। অরুণাচল প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গিরিপথে তখন চিনা সেনার গুলিতে চার ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়। তখন দেশের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। তৎকালীন কূটনীতিকরা এই ঘটনাকে আকস্মিক এবং দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের আমলে মেন্টেন্যান্স অফ পিস অ্যান্ড ট্র্যাঙ্কুয়ালিটি চুক্তি হয়। ১৯৯৬ সালে আস্থা বর্ধক ব্যবস্থাপত্রে সই করে দুই দেশ। ১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনও গোলাগুলি চলবে না বা কোনও বিস্ফোরক ব্যবহার করা যাবে না। সীমান্তে দুই দেশের যে সব সেনা মোতায়েন থাকবে, তাদের কাছে কোনও অস্ত্র থাকবে না। যদি কোনও সেনা অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, তা হলে তার নল মাটির দিকে নামানো থাকবে।
তাই দুই দেশের সেনার মধ্যে হাতাহাতি বা কুস্তির ঘটনা ঘটলেও গুলি বিনিময়ের মতো ঘটনা ঘটে না। তা হলে আমরা বলতে পারি, এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা যুদ্ধ বলেই ধরে নেওয়া যাবে। গালোয়ান সীমান্তেও তাই গোলাগুলি বর্ষণের কোনও ঘটনা ঘটেনি।
এখন প্রশ্ন হল, ভারতের ওপর চিনের এত রাগ কেন? ১৯৮৭ সালে অরুণাচল প্রদেশকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেয় ভারত। যদিও এই ঘটনা ভারতে নতুন কোনও বিষয় নয়। ভারতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে পূর্ণ রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, দুই–ই রয়েছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির কোনও কোনওটিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে থাকে ভারত সরকার। অরুণাচল প্রদেশের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে।
কিন্তু ওই ঘটনায় বেজায় ক্ষিপ্ত হয় চিন। ভারতের অভ্যন্তরে কোনও অঞ্চলকে সরকার কেন্দ্রশাসিত রাখবে, না পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেবে, তা তাদের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়। অথচ সে–সব নিয়েই বেজিংয়ের যত মাথাব্যথা! অনাবশ্যক হলেও। তখনই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে হেলিপ্যাড তৈরির চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু ভারতীয় সেনা চিনের সমস্ত মালপত্র হেলিকপ্টারে চাপিয়ে ফের চিনের ভূখণ্ডেই ফেলে দিয়ে আসে।
লাদাখের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে দুই ভাগে ভাগ করে ভারত সরকার। লাদাখ হয়েছে ভারতের কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল। এই ঘটনাও চিনকে ক্ষুব্ধ করেছে। অদ্ভুত এক নীতিতে চলে চিন। প্রতিবেশী দেশগুলির উন্নতি, শক্তিবৃদ্ধিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে তারা। সেই দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়েও নাক গলানো তাদের একটি অভ্যাস হয়ে উঠেছে। গালোয়ান উপত্যকায় চিনা সেনার তৎপরতা তারও একটি অঙ্গ হতে পারে।
কথা হল, এত সবের পরে ভারত ও চিনের মধ্যে কি যুদ্ধ হতে পারে? মনে হয় না চিন সেই ঝুঁকি নেবে। কারণ, করোনার সৌজন্যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেরই বিষদৃষ্টিতে রয়েছে তারা। আর যুদ্ধের প্রসঙ্গে আমেরিকা, ইজরায়েল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া তো ভারতের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দিয়েই রেখেছে। এমনকী, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও ভারতকে সমর্থন করছে। শুধু পাকিস্তান এবং নেপালের সমর্থনের ওপর ভরসা করে যুদ্ধে যাওয়াটা চিনের পক্ষে বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারে।
এখন অবশ্য বাংলাদেশকে নানা ভাবে সাহায্য করে ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চাইছে। তবে মনে হয় না সে কাজে তারা সফল হবে। কারণ, ভাষা, ইতিহাস এবং ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ভারতের যতটা ঘনিষ্ঠ, চিনের ততটা নয়। তাই চিনের জন্য তারা খুব বেশি ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
শ্রীলঙ্কাকেও উসকে দেওয়ার কাজটা করে যাচ্ছে চিন। কিন্তু তাতে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ভারত বিদ্বেষী শক্তির রমরমা বাড়লেও বাংলাদেশের পথ অনুসরণ করেই শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে চরম বৈরিতার পথে তারা যাবে বলে মনে হয় না। সুতরাং চিন দক্ষিণ এশিয়া থেকে খুব বেশি সাহায্য পাবে বলে মনে হয় না। আর দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় তাইওয়ান এবং কমিউনিস্ট ভিয়েতনামও চরম ক্ষুব্ধ চিনের ওপর।
অন্যদিকে, হংকংয়ের মানুষ মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে টানা অভিযোগ করে চলেছে। তিব্বতকে জোর করে দখল করে রাখলেও সেখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষ চিনের বিরুদ্ধে এখনও একবগ্গা। সুতরাং অভ্যন্তরীণ দিক থেকেও চিন যে সুখী দেশ, সে কথা বলা যায় না। তাই যুদ্ধে গেলে চিনের সর্বনাশের আশঙ্কাও কম নেই।
তবে অদ্ভুত এবং যুক্তিহীন দুর্বোধ্য কিছু ভাবনা যে কোনও দিকে নিয়ে যেতে পারে তাদের। তা হলে বলতে হবে, অপরিণামদর্শিতার পরিণাম তাদের একদিন ভুগতেই হবে। জার্মানির হিটলারের মতো।