চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙামাটি:দখলদারদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম জলাধারা রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের পারজুওে গত কয়েক দশক ধরে চলছে দখলের মহোৎসব। এসব দখলদারদেও মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী মহল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা। সম্প্রতি একাধিক ভবন স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে খোদ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে। শুধু দখল নয় যত্র তত্র কাপ্তাই হ্রদে পানির ওপর বন্দোবস্তি দেওয়ার অভিযোগ আছে। হ্রদের ওপর নির্মাণাধীন এই ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম। এমনকি সম্প্রতি জেলা প্রশাসন নির্মাণ কাজ বন্ধে নির্দেশনা দিলে তাতেও কর্ণপাত করা হয়নি। সরকারি নিয়ম-নীতি অমান্য করে হ্রদের ওপরেই এই স্থাপনা নির্মিত হলে ওই এলাকায় বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে । এসব জটিতা সৃষ্ট্রির মুল কারণে রয়েছে বাজার প্রশাসন।
তবে জেলা পরিষদেও অর্থায়নে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে ফ্রেন্ডস ক্লাব নির্মানের বিষয়টি এখন আলোচনার শীর্ষে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামের এই অভিজাত ক্লাবটির স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব কাম কমিউনিটি সেন্টার’ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৫কোটি টাকা দরপত্র আহ্বান হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণ করে কাজের কার্যাদেশ পায় মেসার্স এসএস ট্রেডার্স নামের স্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে ক্লাবটির ভিত নির্মাণে ২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ২৫ লাখ বিলবাবদ অর্থ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে আরো বরাদ্দের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জোর তদ্বির চলছে। সাততলা বিশিষ্ট এই স্থাপনার প্রতি তলার প্রতিটি ফ্লোর হবে সাড়ে ৪ হাজার স্কয়ার ফুট।
সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, জেলা শহরের তবলছড়ি টেক্সটাইল মার্কেটের পিছনে অবস্থিত ক্লাবটির নিজস্ব জায়গা ফেলে সম্পূর্ণ কাপ্তাই হ্রদের ওপর সাততলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা অমান্য করে দ্রুত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
রাঙামাটি শহরে কাপ্তাই হ্রদে নির্মানা ফেন্ডস কøাব কাম কমিউনিটি সেন্টার স্থাপনার ১৫দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে রাঙামাটি ভুমি অফিস । ইতিমধ্যে সহকারী কমিশনার রাঙামাটি ভুমি অফিস নোটিশ প্রেরণ করেছে । জেলা প্রশাসকের কার্য্যলয়ের সহকারী কমিশনার ভুমি ফাতিমা সুলতানার স্বাক্ষরে রাঙামাটি ফ্রেন্ড ক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের বরাবরে পাঠানো ও নোটিশে বলা হয়েছে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন লোকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে তদন্ত কালিন সময়ে দেখা যায়,বিনা অনুমতিতে তবলছড়ি বেইন টেক্সটাইল এলাকায় ১নং খতিয়ানের কাপ্তাই হ্রদের জ্বলে ভাসা খাস জমিতে পাকা ইবারত নিমার্ণ করেছেন যা ফৌজদারি কার্যবিধির অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধ । রাঙামাটি সদর ভুমি অফিসের নোটিশে বলা হয়“ নোটিশ প্রাপ্তির ১৫(পনর) দিনের মধ্যে নির্মাধীন সকল প্রকার কাজ বন্ধসহ অবৈধভাবে নির্মিত পাকা ইমারত ও অবকাঠামো সরিয়ে নেয়ার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো । অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, এই দখলের কারণে একদিকে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে পর্যাটন শহর রাঙামাটি অপরদিকে কাপ্তাই হ্রদেও পরিবেশ ধ্বংস হয়ে দিন দিন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। তাদের মতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় কাপ্তাই হ্রদ দখলে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উৎসাহিত হয়ে উঠছে ।
সম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটি ফ্রেন্ডস ক্লাব, পৌরসভা ভবন, জেলা আওয়ামীলীগের কার্য্যলয়ের পার্শ্বে বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরী ও পাঠাগার, ট্রাক টার্মিনাল, বাস টার্মিনাল, রাঙামাটি অপউজাতীয় (বাঙ্গালী) ঠিকাদার সমিতির ভবন, পৌর মার্কেট, রাঙামাটি পলওয়েল পার্কে কটেজ ও সুমিংপুল এবং সামনে গাড়ী রাখার পারকিং নির্মাধীন পুরাতন বাস ষ্টেশন ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়সহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বহুতল ভবন গড়ে উঠছে কাপ্তাই হ্রদের ওপর।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলাগুলোর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর সরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ। তবে হ্রদ দখল করে অভিজাত ক্লাবের স্থাপনা নির্মাণে প্রশাসনেরও বাধা মানছে না এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। কৃত্রিম হ্রদ দখল করে জেলা পরিষদের স্থাপনা নির্মাণে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ বলছেন স্থানীয়রা। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে জেলা পরিষদেরই অর্থায়নে কাপ্তাই হ্রদ দখল করে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পর্যটন মোটেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়–য়া প্রতিবেদককে জানান, রাঙামাটিতে অধিকাংশ ভবন পানির ওপর নির্মিত যেমন পৌরসভার ভবন ১২০ ফুট নীচে বন্দোবস্তি দিয়েছে বাজার ফান্ড। পৌরসভার নতুন ভবনটি প্রশাসন কর্তৃক নিষেধজ্ঞা করেছিল,কিন্ত বাজার প্রশাসন নতুন ভবনের পরে আরো ১শ ফুট পানির ওপর বন্দোবস্তি দিয়েছেন। সেটি খাস কিংবা বন্দোবস্তি জায়গা কিনা সে বিষয়টি আমরা দেখেনি। এখন উর্ধ্বতনরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
রাঙামাটি বহু সমালোচিত বাজার ফান্ড প্রশাসনের কানুনগো নির্মল চাকমা প্রতিবেদককে বলেন,ফ্রেন্ড ক্লাবে এত জায়গা বন্দোবস্তি ছিল না । জনৈক নেপাল দে থেকে ক্রয়কৃত বন্দো.২৮২/৮২-৮৩ জায়গার পরিমান ৩২৭৯ বর্গফুট এখনো রেজিষ্ট্রেশন.হয় নাই । ট্রাক টার্মিনাল বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরী জায়গার বন্দোবস্তির করা হয়নি। পলওয়েল বন্দোবস্তি হয় ১/১১ এক একর । রাঙামাটি বাস টার্মিনাল বন্দো-২৩৩/৮২-৮৩ সালে পৌনে নয় একর যারা বসতি স্থাপন করেছে সম্পুর্ণ অবৈধ বলে তিনি দাবী করেন। পৌরসভার স্থাপনা পরিমাপ না করলে বুঝা যাবে না । তিনি বলেন ,আমি আসার আগে নৈশ্য কলেজ/পৌর মহাবিদ্যালয়/বর্তমানে মহিলা কলেজের নামে সর্ম্পুণ জলের মধ্যে দুই দফায় বন্দো.১৪৩/৮৪-৮৫ সালে ২৪ হাজার ৮শ বর্গফুট । বাস টার্মিনালের পাশে বিসিএস আই ল্যাবটারী নামে ৭৯/৮০ সালে ৫৭ হাজার ২০ বর্গফুট বন্দোবস্তি নিয়েছেন বাজার ফান্ড প্রশাসন থেকে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেন, হ্রদ দখল করে সরকারি অর্থায়নে-সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা নির্মাণের প্রসঙ্গে বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে ।
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মিত হয় দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বাঁধের কারণেই তলিয়ে যায় পুরাতন রাঙামাটি শহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। সৃষ্টি হয় প্রায় ১ হাজার ৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই হ্রদের। তৈরি হয় রাঙামাটির সাত উপজেলার সঙ্গে নৌ-পথে যোগাযোগ। এরমধ্যে বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় নৌপথ ছাড়া যোগাযোগের বিকল্প পথ নেই। শুধু তাই নয়, শহর ও দূর পাহাড়ের হ্রদবর্তী মানুষের পানীয় ও ব্যবহার্য পানির প্রধান উৎসও এই কাপ্তাই হ্রদ।