বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:আর এক সপ্তাহ পরেই বাঙালির সেরা উৎসব শারদীয়া। তার আগেই করোনা পরিস্থিতিতে এই উৎসবকে ঘিরে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন মহলে। বিতর্কের সূচনা হয় যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৭ হাজার পুজো কমিটিকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। গত বছর এই অনুদানের অঙ্ক ছিল ২৫ হাজার করে। করোনা আবহে সেই অনুদান এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। তার পরেও পিছু না হটে ৩৭ হাজারের বাইরে থাকা পুজো কমিটিগুলির অর্থনৈতিক দিক থেকে কমজোরি অন্য কমিটিগুলিকেও মুখ্যমন্ত্রী কিছু কিছু সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, আগামী বছর যেহেতু বিধানসভা নির্বাচন, সে দিকে তাকিয়েই মুখ্যমন্ত্রী এমন সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সিআইটিইউ নেতা সৌরভ দত্ত। হাইকোর্টে তিনি একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার শুনানিতে বৃহস্পতিবার একটি কঠিন প্রশ্নের সামনে রাজ্য সরকারকে দাঁড় করিয়ে দেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘শুধু কি দুর্গাপুজোতেই অনুদান দেয় রাজ্য সরকার? নাকি অন্য উৎসবগুলিতেও এই অনুদান দেওয়া হয়? ইদে কি এই অনুদান দেওয়া হয়েছিল?’ এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। এই প্রশ্নও করেন, ‘দুর্গাপুজো, সন্দেহ নেই, বাঙালির গর্ব। কিন্তু সেইজন্যে কি যেমন খুশি টাকা বিলি করা যায়? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার কি এ ভাবে ধর্মে ধর্মে বিভেদ করতে পারে?’
বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নের কোনও জুৎসই জবাব ছিল না রাজ্যের কাছে। অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত বলেন, ‘মাস্ক, স্যানিটাইজার প্রভৃতি কিনতে এই সাহায্য দেওয়া হয়েছে।’ তখন বিচারপতি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সেইজন্যে টাকা দিতে হবে কেন? সেগুলো তো আরও সস্তায় কিনে সরাসরি পুজো কমিটিগুলিকে সরকার দিতে পারত? পুজো কমিটিগুলি টাকা পাওয়ার পর তা দিয়ে মাস্ক, স্যানিটাইজারই যে কিনছে, তা নিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ করেছে সরকার?’ এর পর তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘করোনার জেরে যখন রাজ্যের সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, তখন কোন যুক্তিতে রাজ্যে সার্বজনীন পুজো আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হল?’ বাস্তবিকই পশ্চিমবাংলায় পুজোর চারদিন সারারাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় জনজোয়ার বয়ে যায়। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবারের মধ্যে তাঁর প্রশ্নের জবাব আদালতে দিতে বলেছেন।
এদিকে, শারদোৎসব নিয়ে আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়েও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত মঙ্গলবার থেকেই তিনি সারা রাজ্যের বিভিন্ন পুজোর ভার্চুয়াল উদ্বোধন করে চলেছেন। কলকাতার কয়েকটি পুজো মণ্ডপে তিনি নিজে গিয়েছেনও। বৃহস্পতিবার সারা রাজ্যের ১১০টি পুজোর ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন নবান্নের সভাঘর থেকে। তার ফাঁকে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘মা দুর্গা জগজ্জননী। তাই মা দুর্গার পুজো আমরা বন্ধ করিনি। পুজো বন্ধ করা ঠিক নয়। তা ছাড়া কোনও কিছুই তো বন্ধ করা হয়নি! রমজান, ইদ, গণেশপুজো এগুলো ঘরে বসেই করা যায়। কিন্তু দুর্গাপুজো বারোয়ারি। পুজো করে ক্লাব আর কমিটিগুলি। বাড়ির পুজো তো তুলনায় অনেক কম হয়।’ নিন্দুকেরা বলছেন, বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির হাত থেকে হিন্দুত্বের তাস কেড়ে নিতে চাইছেন মমতা। তাই পুজো বন্ধ করার পক্ষে তিনি নেই।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে সিপিএম। বিধানসভায় বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী কলকাতা হাইকোর্টের বক্তব্যকে সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী পুজোগুলির ভার্চুয়াল উদ্বোধন করছেন। আসলে তিনি নিজে নিরাপদে থেকে পুজোর উদ্বোধন করে চলেছেন। আর, যে পুজোগুলির উদ্বোধন হচ্ছে, সেখানে মানুষের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘প্রকৃত সত্য হল, পুজোর মঞ্চকে ব্যবহার করে তিনি নিজের রাজনৈতিক প্রচার সেরে নিচ্ছেন। আর এ ভাবে তিনি শারদীয়ার কৌলিন্য নষ্ট করছেন।’