পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট প্রসঙ্গে!
— নাইম ইসলাম নিবির
হঠাৎ করে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পাকিস্তানে তোলপাড় চলছে। বিরোধী দল ও জোটগুলো এক হয়ে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। ‘লেটারগেট কেলেঙ্কারির’ পথ ধরে আনা অনাস্থা প্রস্তাব ডেপুটি স্পিকার বাতিল ঘোষণা করার পর এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্বয়ংক্রিয় হস্তক্ষেপ ঘটে। আর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংসদ পুনর্বহাল হওয়ার পর অনাস্থা পাসের মধ্য দিয়ে ইমরান সরকারের বিদায় ঘটে। ইমরানের পিটিআই নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ সরকারকে বিদেশী ষড়যন্ত্রের আমদানিকৃত সরকার আখ্যা দিয়ে এ সরকারকে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে গণপদত্যাগ করে জনগণের কাছে যাওয়ার।
এই ঘটনা পরম্পরায় স্পষ্ট যে, জটিল রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে গেছে পাকিস্তান। এর পেছনে স্বাভাবিকতার চেয়েও বাইরের পরিকল্পনা বেশি কাজ করেছে বলে মনে হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে পাকিস্তানের অকল্যাণকামী হিসেবে পরিচিত বহিঃশক্তির হাত কিছু নমুনা পাওয়া যায়। ফলে দেশটির কৌশলগত ডকট্রিনের ওপরও এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলতে পারে।
ইমরান খানের পিটিআই যদি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে তাহলে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় ইমরানের জনপ্রিয়তা একেবারে তুঙ্গে। রাজধানীসহ দেশটির প্রধান প্রধান শহরে আয়োজিত প্রতিবাদ বিক্ষোভে লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করছে। ৮০ লাখ টুইটকারী ইমরান খানকে সমর্থন করেছেন। অন্য দিকে শাহবাজের সরকার ঘোষণা করেছে পিটিআই এমএনএ ও এমপিএরা পদত্যাগ করলে শূন্য আসনে তারা উপনির্বাচন করে নেবেন। পিটিআইয়ের বাইরে সব রাজনৈতিক শক্তি এক হয়ে তা ঠেকাতে চাইলে বড় ধরনের সঙ্ঘাত পাকিস্তানে অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
এই ধরনের রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের পথ ধরে পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানও কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই পরিস্থিতি দেশটির নিরাপত্তাব্যবস্থায়ও আঘাত হানতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র্র ও তার মিত্রশক্তি যে কলকাঠি নাড়িয়েছে সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম। ওয়াশিংটন মনে করতে পারে ইমরান খানের সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা নেই। বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর ইমরানের সাথে সরাসরি কোনো সাক্ষাৎ হয়নি।
সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ করতে চায় তবে সেটি হবে অন্য পক্ষের সাথে সম্পর্ককে ক্ষতি না করে। এশিয়াজুড়ে যেখানে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থগত দ্ব›দ্ব রয়েছে সেখানে স্নায়ুযুদ্ধকালের মতো সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখা কতটা পাকিস্তানের জন্য সম্ভব হবে সেই প্রশ্ন দেখা দেবে। পাকিস্তান সিপিইসি বাস্তবায়ন করবে যার সাথে সংযোগ হলো আফগানিস্তান, ইরান ও মধ্যএশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর। কিন্তু রাশিয়ার বিপক্ষে গিয়ে এটি বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব হবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেবে। পাকিস্তানে আমেরিকান ঘাঁটির প্রস্তাব ইমরান খান নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনায় ‘সূচিত’ সংসদীয় অভ্যুত্থানে জন্ম নেয়া শাহবাজ সরকার আমেরিকান ঘাঁটি করার চাপ সামলাতে পারবে কি না সে সংশয় থাকতে পারে।
শাহবাজ শরিফের সরকারের সাথে এমন সব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক শক্তি সামনের কাতারে রয়েছেন যাদের ভূমিকা সরাসরি পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী হিসেবে দেখা যায়। খায়বার পাখতুন খোয়ার মোহসিন ডাবর নামে এক পাখতুন নেতা শাহবাজের মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন বলে অনুমান করা হচ্ছে, যিনি মন্তব্য করেছিলেন খায়বার পাখতুন খোয়া পাকিস্তানের অংশ নয়। বেলুচিস্তানের কিছু রাজনৈতিক শক্তি শাহবাজ সরকারের সাথে রয়েছে যারা গোয়াদর বন্দর ও চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের বিরোধী। মুহাজির কওমি মুভমেন্ট শাহবাজ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে, যাদের নেতারা যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থেকে ভারতের গোয়েন্দা পরিষেবার সাথে গভীর সম্পর্ক রাখেন বলে মনে করা হয়।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দেশটিকে ইমরান সরকারের সময় গ্রে তালিকায় রাখা হয়। এর পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে আর আইএমএফ সহযোগিতা না করায় জটিল অর্থনৈতিক অবস্থা পার করেছে ইসলামাবাদ। শাহবাজ শরিফ নির্বাচিত হওয়ার প্রথম দিনই সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২৫ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এই সরকারের সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক আইএমএফ আবার সহযোগিতার দ্বার খুলে দিতে পারে; কিন্তু নতুন সরকারে এমন সব রাজনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসছেন যাদের বিরুদ্ধে অতীতে সরকারি সম্পদ চুরি ও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
কৌশলগত ডকট্রিন বিবেচনায় ক্ষমতার পরিবর্তনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যার ইঙ্গিত বাজওয়া ছাড়াও শাহবাজ শরিফ নিজেও দিয়েছেন। ইমরান খান বলেছেন, তিনি একটি মুসলিম ব্লক ও কৌশলগত স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইমরানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। সঙ্গত কারণেই আশা করা যায় শাহবাজের পাঁচ মিশালি সরকার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অনুসরণ আর শক্তিধর মুসলিম দেশগুলো নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বলয় তৈরির প্রচেষ্টা থেকে সরে আসতে পারে।
ইমরান খানের পতনের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘটনার পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পাবেন। বলা হতে পারে, ইমরান ক্ষমতায় আসার সময় নয়া পাকিস্তানের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা পূরণ করতে পারেননি। ইউক্রেনে হামলার দিন পুতিনের সাথে তিনি বৈঠকে মিলিত হয়ে ভুল করেছেন। তার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় জোটের মেরুকরণ চলাকালে তিনি কিছুই করতে পারেননি। গভীর ক্ষমতা বলয়ের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এমন আরো নানা কিছু। ইমরান খানের নিজের বক্তব্য হলো, আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটা উদ্যোগে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ইমরান খানের অপরাধ ছিল মূলত দু’টি- প্রথমত. তিনি বৈশ্বিকভাবে একটি ‘মুসলিম ব্লক’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পররাষ্ট্র কৌশল অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। ইমরান খানের বক্তব্য অত্যন্ত গভীরভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত।
সাধারণভাবে মনে করা হয় পাকিস্তানের গভীর ক্ষমতা বলয়ের মূল ভিত্তি হলো সামরিক প্রতিষ্ঠান। যতদূর জানা যায়, বর্তমান পরিবর্তন ঘটানোর সাথে সামরিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তবে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীতে এক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের ইচ্ছানুযায়ী এ পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক হানাহানির পরিস্থিতিতে গভীর ক্ষমতা বলয়ে যেকোনো বিভাজন অনেকসময় বিপদের কারণ ঘটাতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকান বলয়ে থাকার কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মার্কিন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইমরান খান কৌশলগত স্বাধীনতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে চাইলে সামরিক স্বার্থের সাথে সরকারের টানাপড়েন তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে ইমরানের ক্ষমতার মূল ভিত্তির ওপর। এ ছাড়া তিনি সামরিক বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে নিয়োগ-পদোন্নতি ও অন্য কিছু নীতিগত বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেও ধারণা করা হয়। সব মিলিয়ে ইমরানের রাজনৈতিক সততা আর হেলথ কার্ড, গরিবের জন্য আবাসন, বিলিয়ন গাছে সবুজ পাকিস্তান প্রকল্প জনসমর্থনের ভিত্তি বাড়ালেও গভীর ক্ষমতা বলয়ে তার সমর্থনের শিকড় কেটে যেতে থাকে। এর সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকার সর্বব্যাপী পদক্ষেপ ক্ষমতা থেকে ইমরানকে ছিটকে দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বলা হচ্ছে, ইমরান খানের পদক্ষেপগুলো অতি বেশি চীন-রাশিয়ামুখী এবং ওয়াশিংটনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টিকারী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সংসদীয় অভ্যুত্থানের ঘুঁটি সাজানো হয়েছে। কিন্তু চীন ইমরান খানের সরকারকে রক্ষার জন্য কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছে এমনটি চোখে পড়েনি। পড়ে যাওয়া শক্তির সাথে চীন যে থাকে না সেটি সবসময় দেখা যায়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে বলে মনে হয়। বেইজিংয়ের কর্তারা মনে করেছেন রাজনৈতিক শক্তি আসবে আর যাবে; কিন্তু পাকিস্তানে স্থায়ী হলো সামরিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক প্রভাব। তাদের সাথে বোঝাপড়া করে চীন সম্ভবত তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাইছে।
তবে বেইজিংয়ের একই কৌশলে কাঠমান্ডুর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। শ্রীলঙ্কার ওপর প্রভাব হারানো কেবলই সময়ের ব্যাপার, মালদ্বীপের ওপর চীনা প্রভাবও এখন আর নেই। বাংলাদেশও চীনা প্রভাব থেকে বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। এখন সর্ব আবহাওয়ার বন্ধুদেশ পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কের অবস্থা কী দাঁড়ায় সেটি দেখার বিষয়। তবে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির অনিবার্য পরিণতি হবে চীনের সাথে বন্ধুত্বে কিছুটা হলেও ভাটা পড়া।
পাকিস্তানের জন্য এই পরিস্থিতি স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সাথে তুলনীয় হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আমেরিকান বলয়ে যাবে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠান হয়তোবা উপলব্ধি করতে পেরেছে ইমরান খানের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কৌশলগত এই পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এর ফলে সংসদীয় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে কলকাঠি নাড়ার এই প্রক্রিয়ায় সামরিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় নিষ্ক্রিয় সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়। আর এই কারণে ইমরান খান সংসদ ভেঙে দেয়া, জরুরি অবস্থা জারির চিন্তা বাস্তবায়িত করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। ইমরানের চূড়ান্ত বিদায়ের আগে একাধিকবার সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের সাথে তার বৈঠকের কথা জানা যায়। এই ধরনের সঙ্কট সময়ে ইমরান খান জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের সহায়তা পেতে পারতেন; কিন্তু এসব দলকে সংসদের যথাসম্ভব বাইরে রাখতে বিগত নির্বাচনে গভীর ক্ষমতা বলয়ের প্রভাবশালীদের সাথে তিনি একসাথে কাজ করেন। এর ফলে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা সিরাজুল হকসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা সংসদ থেকে ছিটকে পড়েন। আর মাওলানা ফজলুর রহমান ইমরানের পতন ঘটানোর জন্য শুরু থেকে অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক মঞ্চে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। জামায়াত সর্বশেষ রাজনৈতিক সঙ্কটে কোনো পক্ষে না গিয়ে নীরব ভূমিকা রেখেছে। অথচ জামায়াতের সাথে কোয়ালিশন করে খায়বার পাখতুন খোয়ায় সফল সরকার পরিচালনার ওপর ভিত্তি করে ইমরান খান পরেরবার ব্যাপক বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। এসব কারণে শেষ দিকে ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে অনেকটা একা হয়ে পড়েন।
পাকিস্তানে সাড়ে তিন বছরের ইমরান খানের শাসনে নানা সাফল্য ব্যর্থতার পরও তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা এখনো রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি ভালো সাফল্য পেয়েছেন; কিন্তু জনসমর্থন পাকিস্তানের মতো দেশে সাফল্যের একমাত্র নির্ণায়ক হয় না। জনসমর্থন থাকলেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট না চাইলে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি না সংশয় রয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবের আগে দেয়া ভাষণে অতীতে রাজনৈতিক তিক্ততা ভুলে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন। প্রতিহিংসার রাস্তায়ও তিনি অগ্রসর হবেন না বলে জানিয়েছেন। এসব বক্তব্য আগের বলা কথাবার্তার সাথে মেলে না।
এতে ধারণা করা হয় যে, সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণভাবে দেশটির জন্য জটিল সময় পার করার আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। ইমরান খানের প্রতিও প্রভাবশালী পক্ষ থেকে এই বার্তা দেয়ার কথাই জানা যাচ্ছে যে, তিনি দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার মতো প্রচার প্রচারণায় না গিয়ে যেন দলকে শক্তিশালী করে পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন। ২০২২ সালের শেষ দিকে এই নির্বাচন হতে পারে মর্মে আশ্বাস দেয়ার কথা জানা যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী বহু দলের যে কোয়ালিশন এখন সরকার গঠন করছে তাতে ডিপ স্টেট চাইলে যেকোনো সময় সরকার ভেঙে পড়তে পারে। ফলে নতুন সরকারের আয়ু এক বছরের কম সময় হওয়া স্বাভাবিকই হতে পারে।
পাকিস্তানের পরিবর্তন মুসলিম বিশ্বকে কতটা প্রভাবিত করবে সেই প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন আমেরিকান স্বার্থের অনুক‚লে বলে বিবেচনা করা হয়। ইন্দোনেশীয় সরকার ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করলেও অর্থনৈতিক কারণে পাশ্চাত্যের সাথে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এর মধ্যে এখনো আমেরিকার সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রক প্রভাব ফিরে পাওয়ার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় প্রয়োজন। এটি ঘটলে এক দিকে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের উদ্যোগ গতি হারাবে। অন্য দিকে আমেরিকান প্রভাব যে চীন-রুশ বলয়ের কারণে চ্যালেঞ্জে পড়ছে সেটি ভিন্ন মুখ নিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী মনযোগের কেন্দ্র। পাকিস্তানের ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক হতে পারে। আগামী বছর তুরস্কে নির্বাচন। ন্যাটো সদস্য দেশ হলেও তুরস্কের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক খুব একটা স্বস্তিকর নয়। ফলে অনেকের ধারণা বাইডেনের রেজিম চেঞ্জের তালিকায় সৌদি আরব, আমিরাতের সাথে তুরস্কও রয়েছে। এ বিষয়ে সচেতন থাকায় তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তিক্ততা কমিয়ে এনে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করছে। আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর, ইসরাইল এমনকি গ্রিস, আর্মেনিয়ার সাথেও দূরত্ব কমিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে আঙ্কারা।
ইউক্রেন সঙ্কটে তুরস্কের ভূমিকা ছিল বেশ সতর্ক। এই যুদ্ধ সামনে আরো গড়ালে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আঙ্কারার অবস্থান কতটা টিকে থাকবে বলা কঠিন। এই যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক। পাকিস্তানের ইমরান খানের সাথে এরদোগানের বোঝাপড়া বেশ গভীর বলে মনে করা হতো। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্কের সমীকরণ কী দাঁড়ায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী হবার পর এরদোগান তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন বিলওয়াল জারদারি। তাদের পারিবারিক মিত্র হলো এমবিজেড-এর নাহিয়ান পরিবার। অন্য দিকে শরিফ পরিবারের পৃষ্ঠপোষক মনে করা হয় সৌদি আরবকে। তবে পাকিস্তানের নতুন পর্বে সরকারের ওপর আমেরিকান প্রভাব থাকবে অনেক বেশি। শরিফ পরিবারের সাথে মোদির সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ। পাকিস্তানের পরবর্তী পররাষ্ট্র সম্পর্কে এর প্রভাব কমবেশি পড়বে। তবে রাজনীতিবিদরা ইচ্ছা করলেই দেশটিতে সবকিছু করতে পারেন না। জটিল নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র কৌশলের নিয়ন্ত্রণ থাকে সামরিক প্রতিষ্ঠানের ওপর।
নাইম ইসলাম নিবির : প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য রাজনীতিক ও কলাম লেখক
nayemulislamnayem148@gmail.com