বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : পশ্চিমবাংলা থেকে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। এই দাবি নিয়ে এবার সরাসরি রাইসিনা হিলের দ্বারস্থ হল রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। ভারতীয় সংবিধানের ১৫৬–র ১ উপধারা প্রয়োগ করে জগদীপ ধনখড়কে রাজ্যপাল পদ থেকে সরানোর দাবি জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে ৬ পাতার স্মারকলিপি জমা দিয়েছে তারা। স্মারকলিপিতে তৃণমূলের দাবি, সাংবিধানিক সীমারেখা লাগাতার লঙ্ঘন করে চলেছেন রাজ্যপাল ধনখড়। আর সে ভাবেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকাকেও কার্যত অস্বীকার করে যাচ্ছেন। তৃণমূলের দাবি, সেই আবেদনপত্র রাষ্ট্রপতি ভবন নাকি গ্রহণও করেছে।
স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন লোকসভায় তৃণমূল দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্য সচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি নেত্রী কাকলি ঘোষ দস্তিদার, রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং মুখ্য সচেতক সুখেন্দুশেখর রায়। এদিকে, বুধবারও শিক্ষার রাজনীতিকরণ নিয়ে নতুন করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন রাজ্যপাল। তবে তৃণমূল সাংসদদের এই পদক্ষেপ নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করার প্রয়োজন বোধ করেননি এদিন। উল্লেখ্য, ভোটের আগে রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করে সরকার ভেঙে দেওয়ার দাবি টানা জানিয়ে চলেছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপির সেই দাবি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি কোনও মত না দিলেও উড়িয়েও দেয়নি। ফলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হতে পারে কিনা, তা নিয়ে জল্পনা অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে সংবিধানের ১৫৬–র ১ উপধারা প্রয়োগ করে জগদীপ ধনখড়কে রাজ্যপাল পদ থেকে সরানোর দাবি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে তৃণমূলের হাজির হওয়ার ঘটনাকে রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অর্থাৎ, এবার আর সংযত হওয়ার বার্তা নয়, বরং রাজ্যপালের বিরুদ্ধে সরাসরি সঙ্ঘাতেই গেল রাজ্যের শাসক দল। তবে রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ভাবে পদ থেকে কোনও রাজ্যপালকে সরানো প্রায় অসম্ভব।
বুধবার কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে রাজ্য থেকে রাজ্যপালকে সরানোর দাবি নিয়ে তৃণমূল সাংসদদের রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার খবরটি জানান সুখেন্দুশেখর রায়। তঁার সঙ্গে ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে কোন অধিকারে প্রশাসনিক কাজে রাজ্যপাল ‘নাক গলান’, তা নিয়েও এদিন প্রশ্ন তোলেন সুখেন্দুশেখর। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে নির্দিষ্ট ভাবে বলা রয়েছে যে রাজ্যপাল নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। শুধুমাত্র কিছু ঔপাচারিক ক্ষমতা রয়েছে তাঁর হাতে। কোনও বিষয়ে তিনি শুধু জানতে চাইতে পারেন, কিন্তু রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজ করতে পারেন না। কিন্তু সেই সাংবিধানিক লক্ষণরেখা বারংবার অতিক্রম করে যাচ্ছেন রাজ্যপাল। কখনও বিবৃতি জারি করে, কখনও সাংবাদিক বৈঠক করে, কখনও আবার কোনও টিভি চ্যানেলের প্যানেলিস্ট হিসেবে রাজ্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে গিয়েছেন তিনি। তিনি যা করেছেন, স্বাধীন ভারতের কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল আজ পর্যন্ত তা করেননি।’
বিষয়টি নিয়ে পাল্টা মুখ খুলেছেন বাংলায় বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। এই ইস্যুতে তিনি রাজ্যপালের পক্ষেই নিজের সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ‘এই রাজ্যের সরকার নিজেই তো সংবিধান মানে না। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তারা সংবিধান বিরুদ্ধ কাজ করে চলেছে। রাজ্যে তারা এখন একনায়কতান্ত্রিক সরকার চালাচ্ছে। প্রতিদিন বিরুদ্ধমতের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। তারাই আজ আবার অন্যের সাংবিধানিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করছে? কী করে এই বিশ্লেষণ করছে তারা? আমার মনে হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে তৃণমূলের এইসব ভিত্তিহীন অভিযোগ ধোপেও টিকবে না।’ এর পরই রাজ্যপালের কাজের প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় মোটেও সাংবিধানিক সীমারেখা লঙ্ঘন করে কাজ করছেন না। বরং রাজ্য সরকারকে বারবার সংবিধান মেনে কাজ করার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাই তৃণমূলের এত গাত্রদাহ! তারা চায় সংবিধান না মেনে স্বৈরাচারী থাকতে।’
যদিও রীতিমতো উদাহরণ দিয়ে তৃণমূল নেতা সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বাংলার শেষ গভর্নর ছিলেন সিআর রাজা গোপালাচারী। এ রাজ্যে প্রথম রাজ্যপাল পদে বসেন হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী কালে সৈয়দ নুরুল হাসান, ভৈরব দত্ত পাণ্ডে এবং কিছুদিন আগে পর্যন্ত গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকেও রাজ্যপাল হিসেবে পেয়েছি আমরা। তাঁরা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট মানুষ। গত বছর জুলাইয়ে বাংলায় রাজ্যপাল নিযুক্ত হন জগদীপ ধনখড়। প্রথম দিন থেকেই রাজ্য সরকার, সাধারণ প্রশাসন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সব অভিযোগ করে যাচ্ছেন।’
এর পরই তাঁর কথায় উঠে আসে মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার প্রসঙ্গ। উল্লেখ্য, ডায়মন্ড হারবারে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি (জগৎপ্রকাশ) নাড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পর নাড্ডাকে প্রকাশ্যেই কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, ‘নাড্ডা ফাড্ডা চাড্ডা।’ তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন রাজ্যপাল।
সেই প্রসঙ্গের কথা তুলে সুখেন্দুশেখর বলেন, ‘প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে বলছেন তিনি। গত ৭৫ বছরে কখনও কেউ এমনটা শোনেননি। স্পিকারের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। জনগণের নির্বাচিত বিধানসভার সার্বভৌমিকতায় আঘাত হেনেছেন।’ তবে এদিন সুখেন্দুশেখর রায়ের একটি মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ধনখড় রাজ্যপাল পদের যোগ্যই নন। সে কথাই নাকি রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন তাঁরা।