সম্রাট শাহজাহান ভালোবেসে মমতাজের জন্য তাজমহল তৈরি করেছিলেন। কথিত আছে; তাজমহলটি তৈরিতে ২০ হাজার শ্রমিকের ২০ বছর সময় লেগেছিল। ভালোবাসার এই অপূর্ব উপহার দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের ভিড় পড়ে দিল্লির আগ্রায়।
অনেকেরই আবার স্বপ্ন থাকে ভালোবাসার এই নিদর্শনটি দেখার। কবি-সাহিত্যিকরা তাজমহল নিয়ে হাজার হাজার কথা লিখেছেন। অনেকেই মনে করেন ভালোবাসা নয়, ভেতরের অনুতপ্তবোধ থেকেই সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছেন। অনুতপ্তবোধ কেন? সম্রাট শাহজাহান কি মমতাজকে ভালোবাসতেন না? নাকি অন্য কিছু?
লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েটসহ প্রেম-ভালোবাসার এ রকম অনেক নিদর্শন আমাদের ইতিহাসের পাতায়। অতিরিক্ত আবেগ আর ভালোবাসা থেকে যেমন তৈরি হতে পারে তাজমহল তেমনি অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যেতে পারে অনেক কিছুই। জীবনটা তো আর থেমে থাকবে না?
প্রেম ভালোবাসা চির শাশ্বত। যুগের পর যুগ মানুষ প্রেম-ভালোবাসায় আসক্ত। ভালোবাসা না থাকলে হয়তোবা জীবনই অচল হয়ে যেত। তের চৌদ্দ বছর বয়সের যে আবেগ অনুভূতির জন্ম তা বয়সাধের আবেগ-অনুভূতির সমান নয়।
বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা প্রসঙ্গে এক জায়গায় বলা হয়েছে ‘যে তরুণ-তরুণী অল্প বয়সে এই উপন্যাস পড়ে লজ্জা অনুভব করত তারা এখন পরিণত বয়সে এর ভেতরে খুঁজে পান মানব জীবনের গভীর দার্শনিকতা। অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও স্রোতের মতো ভেসে যাওয়া বেদনাহত জীবন।
প্রিয় পাঠক, সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের আলোচিত বিষয় এখন কানাডার বেগমপাড়া। টরোন্টো শহরে রিচমন্ড হিলে এই ‘বেগমপাড়া’ অবস্থিত। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বেগমপাড়া বলে কিছু নেই এখানে। মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা অনেকেই বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন।
এই বাংলাদেশি বেগমদের বেশিরভাগের বসবাস টরোন্টোসহ কানাডার অন্যান্য শহরে। এছাড়া মন্ট্রিয়ল, অটোয়া শহরের অভিজাত এলাকাতেও তারা আছেন। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রী এবং সন্তানরা থাকেন, সে কারণেই বেগমপাড়া শব্দটি এসেছে। এর আগে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বার ‘বেগমপুরা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন।
এর মূল কাহিনি নেয়া হয় কানাডার মিসিসাগা শহরের সেই স্ত্রীদের নিয়ে। তাদের স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন। সিনেমাটিতে ধনী স্বামীদের নিঃসঙ্গ স্ত্রীদের জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে। বেগমপাড়া শব্দটি এখান থেকেই এসেছে।
গোলকধাঁধার বেগমপাড়ার অধিবাসীর বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রী। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক সচিব থেকে শুরু করে বর্তমানে কর্মরত আছেন এমন যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের সন্তানরা কানাডার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এই সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের একাধিক বাড়িও আছে। প্রশ্ন উঠছে, বেগমপাড়ার অভিজাত বাংলাদেশি বাসিন্দাদের অর্থের জোগান হচ্ছে কীভাবে। এই প্রশ্ন শুধু এখন নয়, এ প্রশ্ন সবসময়ের। শুধু ঘুরে-ফিরে বারবার আসে।
খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের ধনীদের কালো টাকা কীভাবে কানাডায় আসে। তার উদাহরণ দিয়ে একজন প্রবাসী জানান, প্রায় দেড় বছর আগে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব অবসর নেন। তার স্ত্রী-কন্যা কানাডায় থাকেন।
দেখা যায়, সচিব থাকার সময়ে ওই মন্ত্রণালয়ের একাধিক বড় প্রকল্পে কাজ করা একটি বিদেশি কোম্পানির এজেন্টরা টরোন্টোতে সেই বেগমের কাছে নিয়মিত অর্থ সরবরাহ করছেন সুকৌশলে।
আবার এই টাকার একটা অংশ কানাডায় আয় দেখিয়ে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবেও পাঠানো হয়। সেই ‘বৈধ’ টাকা দিয়ে দেশে ওই সাবেক সচিব ঢাকায় দামি ফ্ল্যাটও কিনেছেন। এমন কৌশল ব্যবহার করা হয় যে, বিদেশে ঘুষের টাকা পরিশোধের কোনো প্রমাণই থাকে না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমন অনেক ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেই চলেছে। আর আমরা দর্শকরা চা কফি নিয়ে টিভি সেটের সামনে বসে বসে দেখছি।
পুরো কানাডায় বর্তমানে প্রবাসী অভিবাসী বাঙালিদের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। এই অভিবাসীর মধ্য ব্যবসায়ী সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদরাও রয়েছেন। আবার কায়িক পরিশ্রমে অনেক প্রবাসী বাঙালিও রয়েছেন যারা দুই থেকে তিনটা জব করে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন।
দশ বছর ধরে পরিশ্রমী ব্যক্তিটি যখন দেখে তার বাড়ির পাশেই হুট করে একজন বাংলাদেশ থেকে এসে পরিশ্রম ছাড়াই আলিশান বাড়ি কিনে, তখন তার অবস্থাটা কেমন হতে পারে?
প্রিয় পাঠক, প্রতিটি মানুষের জীবনেই স্বপ্ন থাকে বড় হওয়ার। কেউ চায় ডাক্তার হতে, কেউ চায় ইঞ্জিনিয়ার হতে। কেউবা আবার নিজস্ব গণ্ডি থেকে কিছু করতে। ছোটবেলায় বয়োজ্যেষ্ঠরা জিজ্ঞাসা করত ‘বাবা তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও’? সেই হতে চাওয়া আর আজকের হতে চাওয়ার মধ্যে তফাৎটা কতটুকু? আপনার পকেটের টাকা নিয়ে যদি আমি, আমার ভাইকে দিয়ে সুখী করি। তাহলে আপনার অবস্থাটা কেমন হতে পারে? কতটুকু ভালোবাসলাম আপনাকে?
ভালোবাসা আর ঘৃণা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবেসে দেশের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ পরিচালনায় অংশ নিলাম, জনগণের নিবেদিতপ্রাণ হয়ে রাজনীতি করলাম, সেই আমিই নিজের স্বার্থে দেশ ও জনগণের সাথে বেঈমানি করে পাড়ি দিলাম অন্যদেশে।
সম্রাট শাহজাহান স্ত্রীকে ভালোবেসে নিজ দেশেই তাজমহল করেছেন, তিনি কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় তাজমহল করেননি। তাহলে বাঙালিদের ভালোবাসা কি সম্রাট শাহজাহানকেও হার মানায়?