1. abrajib1980@gmail.com : মো: আবুল বাশার রাজীব : মো: আবুল বাশার রাজীব
  2. abrajib1980@yahoo.com : মো: আবুল বাশার : মো: আবুল বাশার
  3. Azharislam729@gmail.com : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
  4. bobinrahman37@gmail.com : Bobin Rahman : Bobin Rahman
  5. farhana.boby87@icloud.com : Farhana Boby : Farhana Boby
  6. mdforhad121212@yahoo.com : মোহাম্মদ ফরহাদ : মোহাম্মদ ফরহাদ
  7. harun.cht@gmail.com : চৌধুরী হারুনুর রশীদ : চৌধুরী হারুনুর রশীদ
  8. shanto.hasan000@gmail.com : Rakibul Hasan : Rakibul Hasan
  9. msharifhossain3487@gmail.com : Md Sharif Hossain : Md Sharif Hossain
  10. humiraproma8@gmail.com : হুমায়রা প্রমা : হুমায়রা প্রমা
  11. dailyprottoy@gmail.com : প্রত্যয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রত্যয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  12. namou9374@gmail.com : ইকবাল হাসান : ইকবাল হাসান
  13. mohammedrizwanulislam@gmail.com : Mohammed Rizwanul Islam : Mohammed Rizwanul Islam
  14. hasanuzzamankoushik@yahoo.com : হাসানুজ্জামান কৌশিক : এ. কে. এম. হাসানুজ্জামান কৌশিক
  15. masum.shikder@icloud.com : Masum Shikder : Masum Shikder
  16. niloyrahman482@gmail.com : Rahman Rafiur : Rafiur Rahman
  17. Sabirareza@gmail.com : সাবিরা রেজা নুপুর : সাবিরা রেজা নুপুর
  18. prottoybiswas5@gmail.com : Prottoy Biswas : Prottoy Biswas
  19. rajeebs495@gmail.com : Sarkar Rajeeb : সরকার রাজীব
  20. sadik.h.emon@gmail.com : সাদিক হাসান ইমন : সাদিক হাসান ইমন
  21. safuzahid@gmail.com : Safwan Zahid : Safwan Zahid
  22. mhsamadeee@gmail.com : M.H. Samad : M.H. Samad
  23. Shazedulhossain15@gmail.com : মোহাম্মদ সাজেদুল হোছাইন টিটু : মোহাম্মদ সাজেদুল হোছাইন টিটু
  24. shikder81@gmail.com : Masum shikder : Masum Shikder
  25. showdip4@gmail.com : মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ : মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
  26. shrabonhossain251@gmail.com : Sholaman Hossain : Sholaman Hossain
  27. tanimshikder1@gmail.com : Tanim Shikder : Tanim Shikder
  28. riyadabc@gmail.com : Muhibul Haque :
  29. Fokhrulpress@gmail.com : ফকরুল ইসলাম : ফকরুল ইসলাম
  30. uttamkumarray101@gmail.com : Uttam Kumar Ray : Uttam Kumar Ray
  31. msk.zahir16062012@gmail.com : প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক : প্রত্যয় নিউজ ডেস্ক
বেগম ফজিলাতুননেছা : শেখ মুজিবের জীবনে অর্ধেকেরও বেশি - দৈনিক প্রত্যয়

বেগম ফজিলাতুননেছা : শেখ মুজিবের জীবনে অর্ধেকেরও বেশি

  • Update Time : রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১
  • ১৭৩ Time View

ওয়েব ডেস্ক:

১.

‘সাম্যের গান’ গাইতে গিয়ে কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ দৃশ্যতই কবি এখানে পূর্ণাঙ্গতার চিত্র এঁকেছেন। নারী-পুরুষ আধাআধি হলেই পূর্ণাঙ্গ হয়— এমনই কবির সরল সমীকরণ। কিন্তু সমীকরণেরও ব্যতিক্রম হয়। কবির কল্পচিত্রের চাইতে কখনও কখনও ভিন্ন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবলভাবে।

যেমন- ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি; জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’— মন্তব্যের সামনে আবেগময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘কবিগুরু, আজ এসে দেখে যান, বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। আপনার কবিতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ তখন কি নতুন এক সত্য দৃশ্যমান হয় না?

আজ এমন একজন নারীকে নিয়ে আলোচনা, যিনি তাঁর জীবনসঙ্গী পুরুষটিকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন, তবে তাঁর জীবনের অর্ধেক হয়ে নয় বরং তার অনেক বেশিই হয়ে। পুরুষটি পূর্ণ হয়েছিলেন সত্যি, তবে তাঁর জীবনে এই নারীর অবস্থান অর্ধেকের চাইতে বেশি।

বলছি, শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুননেছার কথা।

২.

বাবা শেখ জহুরুল হকের দুই কন্যা। জিন্নাতুননেছা ও ফজিলাতুননেছা রেনু। আমাদের কাহিনী এগোবে রেনুকে অনুসরণ করেই। বাবার ইচ্ছে দুই মেয়েকেই বিএ পাস করাবেন। কিন্তু হঠাৎ মারা যান শেখ জুহুরুল হক। রেনুর বয়স তখন মাত্র দুই বছর। বাবা হারানোর কিছু কালের মধ্যেই মাকে হারান রেনু। পারিবারিক নানা সমীকরণে শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হয় রেনুকে বিয়ে দিতে হবে। কনে রেনুর বয়স তখন তিন বছর আর পাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ১৩ বছর। বিয়ে হলে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন, ‘মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেনুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে।’ আজকের হিসেবে ‘বাল্যবিবাহ’ই বটে!

মায়ের রুচি ছিল অসাধারণ। ঘরদোর সবসময় থাকত সাজানো-গোছানো। রান্না-বান্না, সেলাই-ফোঁড়াই সবকিছুতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাড়ির মশারি থেকে শুরু করে লেপের কভার পর্যন্ত— সবই সেলাই করতেন। আর ভালোবাসতেন গান শুনতে। মা ছিলেন অসম্ভব ধীমান। সিরাজউদ্দৌলার সংলাপ, এমনকি মাইকেল থেকেও তিনি মুখস্থ শোনাতেন আমাদের। তাঁর এই প্রতিভা পরবর্তীকালেও খুব কাজে লাগে। জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাইরের সব খবর তিনি অবিকল পৌঁছে দিতেন

বিয়ের পর বাবা-মা হারা রেনু তাঁর শাশুড়িকেই ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। এই শাশুড়ি যেমন মা হিসেবে তাঁর পুত্রকে গড়ে তুলেছেন, তেমনি পুত্রবধূর মধ্যেও ছড়িয়েছেন আলো। শিশু থেকে কৈশোর পার হয়ে তারুণ্যে পা রাখার সময়ই রেনুকে তাঁর শাশুড়ি মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, ‘কেউ দ্বারে এলে যতটুকু পার দিও। ফিরায়ে দিও না। অন্যের জিনিস দেখে অজ্ঞান হয়ে যেও না। মানুষকে কখনও গর্ব দেখাবে না। এমন কিছু করবে না যাতে মানুষ কষ্ট পায়।’

পাঠক, লক্ষ্য করুন; মায়ের এই দর্শন শেখ মুজিব ধারণ করেছেন, তা সঞ্চারিত হয়েছে পুত্রবধূর মধ্যেও। নানী, বাবা-মা হয়ে এই জীবনাচার কি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার মধ্যেও দেখতে পাই না? পারিবারিক সংস্কৃতি এভাবেই প্রবাহিত হয় প্রজন্মের হাত ধরে।

মা সম্পর্কে শেখ রেহানা বলছেন, ‘মায়ের রুচি ছিল অসাধারণ। ঘরদোর সবসময় থাকত সাজানো-গোছানো। রান্না-বান্না, সেলাই-ফোঁড়াই সবকিছুতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাড়ির মশারি থেকে শুরু করে লেপের কভার পর্যন্ত— সবই সেলাই করতেন। আর ভালোবাসতেন গান শুনতে। মা ছিলেন অসম্ভব ধীমান। সিরাজউদ্দৌলার সংলাপ, এমনকি মাইকেল থেকেও তিনি মুখস্থ শোনাতেন আমাদের। তাঁর এই প্রতিভা পরবর্তীকালেও খুব কাজে লাগে। জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাইরের সব খবর তিনি অবিকল পৌঁছে দিতেন।’

৩.

শেখ রেহানার বর্ণনায় তাঁর মাতৃগুণের বাস্তবচিত্র দেখব আরও পরে।

বয়স যাই হোক, রেনুর জীবন বাঁধা হয়ে যায় এই দেশের রাজনীতির এক ঝড়ের পাখি শেখ মুজিবের সাথে। বালিকাবধূ টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়া গাঁয়ে বড় হচ্ছে। অন্যদিকে, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখা শেখ মুজিব কলকাতায় এঁকে চলেছেন রাজনীতিঘেরা তাঁর জীবনের চিত্র।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।”

“আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ‘রেণুর ঘরে’ এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।’” এভাবেই সারাজীবন ‘রেনুর ঘর’ ছিল শেখ মুজিবের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের রাজনীতির এক টালমাটাল সময়ে ঢাকায় চলে আসেন ফজিলাতুননেছা, তখন তিনি দুই সন্তানের মা। পেছনে ফেলে আসেন স্মৃতিময় এক আটপৌরে পারিবারিক জীবন। যে জীবন তাঁর স্পর্শে উজ্জ্বল ছিল। শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে এক বিশাল সুখী পরিবার। একটাই অপূর্ণতা ছিল, ঝড়ো হাওয়ার পাখি, রাজনীতিতে সর্বাত্মক নিবেদিত জীবনসঙ্গীকে সার্বক্ষণিক কাছে না পাওয়ার। ঢাকায় এসেই শুরু হলো রেনুর উথাল-পাতাল নতুন জীবন। উঠলেন রজনী বোস লেনের ভাড়া বাড়িতে। এর মধ্যেই একটু সুখের ঝলক। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হলেন যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী। বাড়ি পেলেন মন্ত্রিপাড়ায়। কিন্তু সুখ কপালে সইল না। সরকার ভেঙে দেয়া হলো, বাড়ি হারালেন মন্ত্রী, উদ্বাস্তু হলেন রেনু।

শিষ্য শেখ মুজিবকে দেয়া গুরু সোহরাওয়ার্দীর গাড়িটি বিক্রি করে কেনা হলো জমি। কিন্তু বাড়ি তৈরির উপায় কী? সে এক কাহিনী। যক্ষ্মায় আক্রান্ত এক আওয়ামী লীগকর্মী নূরুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন শেখ মুজিব। এই কর্মী হাসপাতালে শুয়ে শেখ রেহানার নামে ‘গেট এ ওয়ার্ড’ খেলতে গিয়ে পেলেন আট হাজার টাকা। সেই টাকা তুলে দেয়া হলো রেনুর হাতে। ওই টাকায় তিনতলা ফাউন্ডেশনে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়ি বানিয়ে ১৯৬১ সালে বসত গড়লেন ফজিলাতুননেছা। পরে ধানমন্ডির সেই বাড়ি হয়ে উঠল বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ

১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব আবার মন্ত্রী, আবার মন্ত্রিপাড়া কিন্তু আবারও বাড়িছাড়া। শেখ মুজিব হলেন টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, আবার সরকারি বাড়ি। ১৯৫৮ তে সামরিক শাসন। গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব, আবার সরকারি বাড়ি গেল। এবার নতুন বিপদ। শেখ মুজিবের পরিবারকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। শেখ মুজিব ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে, সংসারের উথাল-পাতাল সামাল দিচ্ছেন রেনু, তাঁর স্বভাবসুলভ ধীরতা দিয়ে। শেষে শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পাওয়া গেল এক টুকর জমি, কিন্তু টাকা কই জমি কেনার। শিষ্য শেখ মুজিবকে দেয়া গুরু সোহরাওয়ার্দীর গাড়িটি বিক্রি করে কেনা হলো জমি। কিন্তু বাড়ি তৈরির উপায় কী? সে এক কাহিনী। যক্ষ্মায় আক্রান্ত এক আওয়ামী লীগকর্মী নূরুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন শেখ মুজিব। এই কর্মী হাসপাতালে শুয়ে শেখ রেহানার নামে ‘গেট এ ওয়ার্ড’ খেলতে গিয়ে পেলেন আট হাজার টাকা। সেই টাকা তুলে দেয়া হলো রেনুর হাতে। ওই টাকায় তিনতলা ফাউন্ডেশনে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়ি বানিয়ে ১৯৬১ সালে বসত গড়লেন ফজিলাতুননেছা। পরে ধানমন্ডির সেই বাড়ি হয়ে উঠল বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঁশের বেড়ার ওই বাড়িটিকে বাসযোগ্য হিসেবে বানাতে ইট-কাঠ-লোহা-সিমেন্টের জোগান নিশ্চিত করতে ফজিলাতুননেছার যে অবিরাম পরিশ্রম ও নিষ্ঠা সে আরেক ইতিহাস।

৪.

সংসারের প্রধান পুরুষ কখন জেলে, কখন বাইরে তার হিসাব রাখা মুশকিল।

এভাবেই ফজিলাতুননেছার সংসার হলো চারটি। টুঙ্গিপাড়ায় শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে একটি, ধানমন্ডিতে পুত্র-কন্যাসমেত একটি, শেখ মুজিবের জেলজীবন নিয়ে একটি আর এই তিন নম্বরটির সাথে যুক্ত হলো শেখ মুজিবের রাজনীতির খোঁজখবর রাখা, দলের নেতাকর্মীদের সাথে সমন্বয় নিয়ে চার নম্বর সংসার। দেখা যাবে এই চার সংসারেই সফল ফজিলাতুননেছা।

টুঙ্গিপাড়ার পরিবার : পুত্রবধূ ও শ্বশুর-শাশুড়ির পারস্পরিক নির্ভরতার কথা জানি সেই টুঙ্গিপাড়ার কাল থেকে। মূলত, ফজিলাতুননেছাই একসময় হয়ে ওঠেন এই বড় পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। এক পর্যবেক্ষক বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের দায়িত্বশীলতার কোনো তুলনা হয় না। তিনি পুত্রের সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য দেশ থেকে চাল-ডাল সব পাঠাতেন। পাশাপাশি রেনুর পৈত্রিক সম্পত্তির আয়ের সম্পূর্ণ টাকা তিনি রেনুর হাতে তুলে দিতেন। তা দিয়ে রেনু ভালোভাবেই সংসার চালাতেন। তবে বিপত্তি বাঁধত রেনুর কাছে কেউ কোনো সাহায্য চাইলে। তিনি তাদেরকে না বলতে পারতেন না। এমনও হয়েছে, তাঁর হাতে টাকা নেই, তখন তিনি সংসারের একটি প্রয়োজনীয় জিনিস বা গহনা বিক্রি করে সেই জরুরি প্রয়োজন মিটিয়েছেন। কাউকে তিনি বুঝতে দেননি অভাবের কারণে তাঁকে কাজটি করতে হয়েছে। দেবরের বিয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসা, শেখ মুজিবের বোনদের নানা সমস্যার সমাধানে নিজ যোগ্যতা দিয়ে পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন ফজিলাতুননেছা।

পুত্র-কন্যাদের নিয়ে সংসার : ফজিলাতুননেছা কীভাবে চালাতেন এই দ্বিতীয় সংসার? শেখ রেহানার বর্ণনা থেকে শুধু কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিনি বলছেন, ‘ছোটবেলায় আমি নাচতাম। যখনকার কথা বলছি তখন বাবা কারাগারে। উকিল-মোক্তারের খরচ, বাড়ির এতগুলো মানুষের নানা রকম খরচ নিয়ে মায়ের ওপর তখন ভীষণ অর্থনৈতিক চাপ। এর ভেতরে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠানে আমার নাচার কথা। সেজন্য ঘুঙুর চাই। চামড়ার ওপরে বকলেস লাগানো ঘুঙুরের অনেক দাম। মা তখন নিজেই কাপড়ের ওপর ঘুঙুর বসিয়ে দিলেন। বললেন, নরম কাপড়ে পায়ে ব্যাথা লাগবে না। আমিও খুশি, সবদিক শান্তি। পরে বুঝতে পেরেছি, পয়সা বাঁচিয়ে মা এইসব দিক সামলাতেন।’

তখন তো আর গ্যাস ছিল না, কেরোসিনের চুলাও ছিল ব্যয়বহুল। রান্নার একমাত্র ভরসা শুকনো লাকড়ি। কিন্তু বর্ষায় বিপদ। তাই  ফজিলাতুননেছা পাটকাঠির ওপর গোবর দিয়ে ঘুঁটি বানিয়ে শুকিয়ে রাখতেন। একবার নাকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘এত শিক-কাবাব বানিয়েছ কেন বৌমা?’

শেখ মুজিব জেলে গেলে ফজিলাতুননেছার কাজ বেড়ে যেত। পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন তো আছেই, মাওলানা ভাসানীর শরীর খারাপ, ছুট খাবার-দাবার আর ফলমূল নিয়ে। খন্দকার মুশতাক জেলে, তার অসুস্থ স্ত্রীকে লন্ডনে পাঠানোর যাবতীয় দায়িত্ব ফজিলাতুননেছার।

শেখ মুজিব রাজনীতির জন্য সংসারে সময় দিতে পারেন না, আবার জেলে গেলে তো সবই বন্ধ। এই সময়গুলোতে অর্ধেক নয়, শেখ মুজিবের পুরো দায়িত্বই পালন করতেন ফজিলাতুননেছা।

শেখ মুজিব যখন জেলে : এটি যেন আরেক সংসার ফজিলাতুননেছার। পরিসংখ্যান বলছে, শেখ মুজিবের জেলযাত্রা শুরু ১৯৩৮ সাল থেকে। নানা মাত্রার বিরতি দিয়ে এটি চলেছে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই কথা বলাই যায়, ফজিলাতুননেছা যে সময় তাঁর বিয়ের কথা বুঝতে শুরু করেছিলেন, সেই সময় থেকে এটিও বুঝতে শুরু করেছিলেন যে, তাঁর স্বামী আর জেলখানা সমার্থক। জেলখানা বুঝি তাঁরও জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবের এই জেলযাত্রা কেমন ছিল?

শেখ রেহানার বর্ণনায়, পুলিশ এলে মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হতেন শেখ হাসিনা। কিছুতেই পুলিশকে ঢুকতে দেবেন না, যেতে দেবেন না বাবাকে। শেখ মুজিব বলতেন, যেতে তো হবেই। তবে মা ঘাবড়াতেন না কখনও, কেবল মুখটা বিমর্ষ হয়ে উঠত। অন্যভাবেও বুঝা যেত তাঁর কষ্ট। বাবা যতদিন জেলে থাকতেন ততদিন ভালো বা রঙিন শাড়ি পরতে ইচ্ছা হতো না তাঁর। বাবা ফিরলে সব ঠিক।

জেলখানায় বন্দি শেখ মুজিবকে দেখতে যাওয়াই ছিল পরিবারের একমাত্র আনন্দের সময়। কিন্তু ধীমান ফজিলাতুননেছা এই সময়টুকুও কাজে লাগাতেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথে। দল ও বাইরের রাজনীতির খবরাখবর যতটুকু পারতেন ততটুকু মুখে বলতেন, আর নিয়ে যেতেন ছোট ছোট চিরকুট। শেখ রেহানা আর ছোট রাসেল ব্যস্ত রাখত এসবির লোককে, খোকা (শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার চাচা) সবাইকে চা-নাস্তা খাওয়াতেন; এই ফাঁকে ফজিলাতুননেছা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দিতেন চিরকুটগুলো

রাজনৈতিক কারণে স্বামী জেলে। সরকার তাঁকেও শত্রু গণ্য করত, নজরদারিতে রাখত। কিন্তু ফজিলাতুননেছা তো হাল ছেড়ে বসে থাকতে পারেন না। শেখ কামাল ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু মোনায়েম সরকারের বাধা, শেখ মুজিবের ছেলেকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করা যাবে না। বাবার দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলেন মা, বেগম ফজিলাতুননেছা। ফোন করলেন সরাসরি প্রিন্সিপালের কাছে। শেখ কামালের ভর্তি সমস্যার সমাধান হলো।

জেলখানায় বন্দি শেখ মুজিবকে দেখতে যাওয়াই ছিল পরিবারের একমাত্র আনন্দের সময়। কিন্তু ধীমান ফজিলাতুননেছা এই সময়টুকুও কাজে লাগাতেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথে। দল ও বাইরের রাজনীতির খবরাখবর যতটুকু পারতেন ততটুকু মুখে বলতেন, আর নিয়ে যেতেন ছোট ছোট চিরকুট। শেখ রেহানা আর ছোট রাসেল ব্যস্ত রাখত এসবির লোককে, খোকা (শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার চাচা) সবাইকে চা-নাস্তা খাওয়াতেন; এই ফাঁকে ফজিলাতুননেছা শেখ মুজিবের হাতে তুলে দিতেন চিরকুটগুলো।

জেলখানায় ফজিলাতুননেছার খাবার পাঠান ছিল বিশেষ আলোচনার বিষয়। শেখ মুজিবের সহবন্দি কারও কিছু খেতে ইচ্ছা করলে শুধু শেখ মুজিবকে বলার অপেক্ষা। সাথে সাথেই অর্ডার চলে যেত ফজিলাতুননেছার হেঁশেলে, বাকিটুকু শুধু বাস্তবায়ন।

ফজিলাতুননেছা কখনওই কোনো দায়িত্ব পালন থেকে এতটুকু সরে আসেননি। আগরতলা মামলার সময় গুজব ছড়ান হলো ফজিলাতুননেছাকেও আটক করা হবে। নিজের আটক হওয়া নয়, ফজিলাতুননেছা চিন্তিত হলেন বিয়ের যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে। এর মধ্যেই পাত্রের সন্ধান হলো, জেল থেকে শেখ মুজিবের সম্মতিও আনা হলো। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আকদ হলো শেখ হাসিনার। কিন্তু কন্যা সম্প্রদান তো করতে হবে। সেই কঠিন দুঃসময়ের মধ্যেও মেয়েজামাই নিয়ে কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বেগম ফজিলাতুননেছা। নিয়ে গেলেন কলম, ঘড়ি, মিষ্টি আর দুটি ফুলের মালা। বাবা শেখ মুজিব এভাবেই সম্প্রদান করলেন তাঁর আদরের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে। বৈরী সময় আর কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও ফজিলাতুননেছা পালন করলেন মা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব, স্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব। আড়ম্বর হয়তো হলো না কিন্তু কোনো অপূর্ণতা রইল না শেখ মুজিবের দায়িত্ব পালনে।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনজুড়ে কতটা জড়িয়ে আছেন বেগম ফজিলাতুননেছা? যদিও বলছি, সেটি তাঁর চতুর্থ সংসার। কিন্তু দেখা যাবে শেষ পর্যন্ত এই চতুর্থ সংসারই হয়ে উঠেছে তাঁর সবচাইতে বড় সংসার। পরবর্তী অধ্যায়জুড়ে সেই আলোচনা।

৫.

দলের তালিকাভুক্ত কর্মী বা সদস্য না হয়েও বেগম ফজিলাতুননেছা ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সবচাইতে একনিষ্ঠ কর্মী, তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অতন্দ্র প্রহরী। স্ত্রী হিসেবে শুধু স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের পর্যবেক্ষকমাত্র ছিলেন না; ছিলেন কঠিন সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এক নির্মোহ পরামর্শদাতা। এক অজপাড়া গাঁয়ে বেড়ে ওঠা, প্রায় একাডেমিক শিক্ষাহীন এই মহিলা কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যে তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন সত্যিই তা এক অপার বিস্ময়। অনেক নেতা এমনকি  রাষ্ট্রনায়কের মধ্যেও এ ধরনের সময়োচিত, দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার নজির হয়তো মিলবে না।

ওই যে বললাম, ফজিলাতুননেছা ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের অতন্দ্র প্রহরী, কীভাবে? জবাব মিলবে শেখ রেহানার বর্ণনায়। শেখ রেহানা বলেন, ‘বাবার কোনো মিটিং থাকলে তাঁকে রওনা করিয়ে দিয়ে তিনিও (ফজিলাতুননেছা) একবার চারপাশটা চক্কর দিয়ে আসতেন। নিজে দেখে তিনি যেন বলতে পারেন কেমন লোকসমাগম হয়েছে, কেমন তাদের আচার-আচরণ। যাতে কেউ ভুল তথ্য দিতে না পারে। রিকশা, গাড়ি যা পেতেন তাতে চেপে চলে যেতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অভ্যাসটা বজায় রাখেন তিনি। বাজারেও চলে যেতেন জিনিসপত্রের দাম দেখতে। বাবাকে নিজেই সব তথ্য দিতেন, অন্য কেউ যাতে বিভ্রান্ত করতে না পারে। কেবল একটিবার সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে, সেবার তিনি যাননি মিছিলের চারপাশে চক্কর দিতে। সেটা ৭ মার্চের কথা।’

মনে হয় না আর ব্যাখ্যার দরকার আছে, শেখ মুজিবের শেখ মুজিব হয়ে ওঠার সাথে ফজিলাতুননেছা জড়িয়ে আছেন কতটুকু জুড়ে।

শেখ মুজিব ততদিনে বঙ্গবন্ধু হয়ে গেছেন। ঘোষণা করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা। কিন্তু চক্রান্ত হয়েছে সেই ছয় দফা নিয়েও। ছয় দফাকে আট দফা বানানোর চক্রান্ত শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় রেখেই। ৩২ নম্বর বাড়িতে দলের নেতাদের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল তর্ক। কিন্তু পাহাড়ের মতো সামনে এসে দাঁড়ান বেগম ফজিলাতুননেছা। রাজনীতিক না হয়েও রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়েই বলেন, ‘আমার বাড়িতে বসে কোনো চক্রান্ত চলবে না। আপনাদের নেতা ছয় দফার জন্য বছরের পর বছর জেলে। তাঁর অবর্তমানে তাঁর কোনো কর্মসূচি আপনারা বদলাতে পারেন না। আপনাদের নেতার নির্দেশ ছয় দফা যারা মানবেন না, তারা দল ছেড়ে চলে যেতে পারেন

বেগম ফজিলাতুননেছা রাজনীতির এই চর্চাটি করতেন তাঁর নিজের জায়গাতে বসে, নিজের মতো করে। শেখ হাসিনা ইডেন কলেজ ছাত্রসংসদে ভিপি পদে নির্বাচন করবেন। শেখ মুজিব তখন জেলে। কী হয়, না হয় ভেবে মা ফজিলাতুননেছার কিছুটা আপত্তি। শ্বশুরের পরামর্শ নিলেন। পরে রাজি তো হলেনই, নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন মেয়ের নির্বাচনে। ছাত্রলীগের সবাইকে ডেকে বললেন, হাসুকে জেতাতে হলে তো সবাইকে কাজ করতে হবে। তাঁর নির্দেশনাতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বাচনে। রাতে যখন শেখ হাসিনার বিজয়ের খবর আসে সেটি ছিল বেগম ফজিলাতুননেছার বড় আনন্দের একটি সময়। পরদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয় ’ভিপি পদে মুজিব-তনয়া’। মা বেগম ফজিলাতুননেছা কি সেদিনই তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে ভবিষ্যতের নেতা হয়ে ওঠার বীজটি বপন করেছিলেন?

শেখ মুজিব ততদিনে বঙ্গবন্ধু হয়ে গেছেন। ঘোষণা করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা। কিন্তু চক্রান্ত হয়েছে সেই ছয় দফা নিয়েও। ছয় দফাকে আট দফা বানানোর চক্রান্ত শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় রেখেই। ৩২ নম্বর বাড়িতে দলের নেতাদের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল তর্ক। কিন্তু পাহাড়ের মতো সামনে এসে দাঁড়ান বেগম ফজিলাতুননেছা। রাজনীতিক না হয়েও রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়েই বলেন, ‘আমার বাড়িতে বসে কোনো চক্রান্ত চলবে না। আপনাদের নেতা ছয় দফার জন্য বছরের পর বছর জেলে। তাঁর অবর্তমানে তাঁর কোনো কর্মসূচি আপনারা বদলাতে পারেন না। আপনাদের নেতার নির্দেশ ছয় দফা যারা মানবেন না, তারা দল ছেড়ে চলে যেতে পারেন।’

ছয় দফার সমর্থনে ৭ জুনের হরতাল সফল করার বিষয়ে মা’র রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মাকে দেখেছি, আমাদেরকে নিয়ে ছোট ফুপুর বাসায় যেতেন। ওখানে গিয়ে পায়ের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলাতেন, বোরখা পরতেন।  স্কুটারে করে আমার মামাকে নিয়ে গিয়ে ছাত্রনেতাদের সাথে বৈঠক করতেন। আন্দোলন কীভাবে চলবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’

সরাসরি ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বললেন, ‘ভাই, আপনাকে একটা অনুরোধ জানাব। শেখ মুজিবকে আইয়ুব খান আবার জেলে ভরতে চান, আমার আপত্তি নেই। আমার এই বাড়িঘর দখল করতে চান, তাতেও দুঃখ পাব না। আপনাদের কাছে আমাদের দুজনেরই অনুরোধ, আমাদের মাথা কিনতে চাইবেন না। শেখ মুজিবকে মোনায়েম খান বানানোর চেষ্টা করবেন না

ওই ছয় দফা নিয়ে আরেকটি ঘটনা। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে আইয়ুব খান পাঠিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। লক্ষ্য শেখ মুজিব যেন ছয় দফা থেকে ফিরে আসেন, সে বিষয়ে তাঁকে রাজি করাতে। ধানমন্ডির বাড়িতে গেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। আলোচনা চলছে। বেগম মুজিব আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু কান খাড়া রেখেছিলেন আলোচনার দিকে। এক সময় বঙ্গবন্ধু ও ফজলুল কাদের চৌধুরীকে একা পেয়ে আসল চেহারা দেখালেন বেগম মুজিব। সরাসরি ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বললেন, ‘ভাই, আপনাকে একটা অনুরোধ জানাব। শেখ মুজিবকে আইয়ুব খান আবার জেলে ভরতে চান, আমার আপত্তি নেই। আমার এই বাড়িঘর দখল করতে চান, তাতেও দুঃখ পাব না। আপনাদের কাছে আমাদের দুজনেরই অনুরোধ, আমাদের মাথা কিনতে চাইবেন না। শেখ মুজিবকে মোনায়েম খান বানানোর চেষ্টা করবেন না।’

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে যখন প্যারোলে মুক্তির প্রসঙ্গ আসে, দলের অনেক নেতা এর সমর্থন করলেও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বেগম ফজিলাতুননেছা। কন্যা শেখ হাসিনাকে চিরকুট দিয়ে বাবার কাছে পাঠান তাঁর মত জানাতে। শেখ হাসিনাও অল্প সুযোগে বাবাকে বলেন, ‘মার সাথে দেখা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।’ এ সময় দলের অনেক নেতা বেগম ফজিলাতুননেছাকে বলেন, আপনি জানেন না, ওনাকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলবে। ধীরস্থির কণ্ঠে বেগম ফজিলাতুননেছার জবাব, ‘বিধবা হলে তো আমিই হব, আর পিতা হারালে আমার সন্তানরা হারাবে, আপনারা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সারা বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে তিনি প্যারোলে যেতে পারেন না।’ এ সময় সন্ত্রস্ত কন্যা শেখ হাসিনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব বলেছিলেন, ‘কিছুই হবে না, তোর বাবা মাথা উঁচু করে ফিরে আসবেন।’ হয়েছিলও তাই। এটি এক অপার বিস্ময়! রাজনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের বাইরে একজন গৃহবধূ যে দূরদৃষ্টি নিয়ে বিষয়টি দেখতে পেলেন, আমাদের দুঁদে রাজনীতিকরা তা ধারণাও করতে পারলেন না!

বেগম ফজিলাতুননেছা তাঁর সুতীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে গোটা রাজনৈতিক প্রবাহের প্রতিটি ঘটনার প্রতি লক্ষ্য রাখছিলেন। এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সাড়ে ৪টার দিকে রেসকোর্সে যাওয়ার আগে দোতলায় যান। সেখানে আধাঘণ্টা থেকে পরে নেমে আসনে। এই আধাঘণ্টায় কী হয়েছিল? বেগম মুজিব সবাইকে তাঁদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর হাসিনা। সেই সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজে। ‘আমার মায়ের সময়োচিত সিদ্ধান্তেই তো দেশ এগিয়ে গেল। ৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভার করেছিলেন বঙ্গমাতা। ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মা সোজা আব্বাকে বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারাজীবন আন্দোলন করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, সেই কথাই বলবা। অন্য কারোর কথা বলার দরকার নাই।’

দলের অনেক নেতা বেগম ফজিলাতুননেছাকে বলেন, আপনি জানেন না, ওনাকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলবে। ধীরস্থির কণ্ঠে বেগম ফজিলাতুননেছার জবাব, বিধবা হলে তো আমিই হব, আর পিতা হারালে আমার সন্তানরা হারাবে, আপনারা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সারা বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে তিনি প্যারোলে যেতে পারেন না

দেশের রাজনীতি নিয়ে কতটা উৎকণ্ঠিত থাকতেন বেগম ফজিলাতুননেছা— সেটি দেখতে পাই আরেকটি ঘটনায়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা। ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার ভাষায়, ওইদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধা মতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এই দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’ এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, ‘আলোচনা এখনও চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না।’ এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না।’

খেলায় কখনও খেলতে হয় আক্রমণাত্মক আবার কখনও রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়ে। বেগম মুজিবকে দেখি, তিনি জীবনযুদ্ধের নানা পর্যায়ে যখন যে কৌশল প্রয়োজন তাই প্রয়োগ করেছেন এবং কোন কৌশলটি কখন প্রয়োগ করতে হবে তা নিশ্চিত করেছেন নিজেই। এখানেই ফুটে ওঠে তার মেধার তীক্ষ্ণতা ও দূরদর্শিতা। তিনটি উদাহরণ দেই।

১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অজ্ঞাত স্থানে। নানা নাটকীয়তা শেষে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে আটকে রাখা হলো বেগম ফজিলাতুননেছাসহ পরিবারের সদস্যদের। এই বাড়ি থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলেন শেখ জামাল। এই নিশ্চিত খবরটি জানতেন কেবল শেখ রেহানা। শেষে বেগম মুজিবও যখন নিশ্চিত হলেন যে, শেখ জামাল সীমান্তের ওপারে যেতে পেরেছে, তখনই আক্রমণাত্মক চালটি চাললেন। তিনি ডাকলেন ডিউটি অফিসারকে, সরাসরি আঙুল তুললেন তাদের দিকে। বললেন, তোমরা আমার ছেলেকে নিয়ে গেছ, ওকে ফেরত দাও। পাকিস্তানি বাহিনীর রথী-মহারথীরা এসে হাজির। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাদের শাসিয়ে চলেছেন বেগম মুজিব। তাঁর এক কথা, আমি ইয়াহিয়ার সাথে কথা বলব। তোমাদের কাস্টডি থেকে আমার ছেলে হারায় কী করে? তিনি সত্যি সত্যিই খোদ ইয়াহিয়া খানকে নোট পাঠালেন, আমার স্বামীর খোঁজ নেই, আমাকে বন্দি করে রেখেছ। তোমাদের কাস্টডি থেকে আমার ছেলে নিখোঁজ হয়েছে।

বলাই বাহুল্য, বেগম মুজিবের এই কৌশলে প্রচণ্ড চাপে পড়েছিল স্বয়ং ইয়াহিয়া।

আমার মায়ের সময়োচিত সিদ্ধান্তেই তো দেশ এগিয়ে গেল। ৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভার করেছিলেন বঙ্গমাতা। ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মা সোজা আব্বাকে বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারাজীবন আন্দোলন করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, সেই কথাই বলবা। অন্য কারোর কথা বলার দরকার নাই

ওই ঘটনার আগে, পরিচয় গোপন করে এক বাসায় (১নং আউটার সার্কুলার রোড) আশ্রয় নিয়েছিলেন বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্যরা। একপর্যায়ে পাকিস্তানিরা তাদের আটক করে। সেদিনও দেখতে পাই বেগম মুজিবের তীক্ষ্ণ মেধার স্বাক্ষর। পাকিস্তানি সেনা অফিসার এসেই জানান দিল, সবাইকে তাদের সাথে যেতে হবে। বেগম মুজিব বুঝলেন, এত অনিশ্চিত গন্তব্যে অনিশ্চিত যাত্রা। কে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলবে না গুম করে দেবে, কেউ তো কিছু জানবে না। দ্রুত তিনি কৌশল ঠিক করে ফেললেন। চারদিকে পাকিস্তানি বাহিনী, ভয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে সবাই স্বেচ্ছাবন্দী। নিচে নামলেন তিনি, প্রতিবেশীদের বন্ধ দরজা-জানালায় আঘাত করে সবাইকে জানান দিলেন। বললেন, ‘ভাই আপনারা শোনেন, আমি বেগম মুজিব, পাকিস্তানি আর্মি আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যদি মেরে ফেলে, আপনার সাক্ষী থাকবেন, আপনারা সাক্ষী থাকবেন।’

তাঁর তীক্ষ্ণ মেধার আরেকটি প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা বেগম মুজিবের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি তাদের কাছ থেকে কোনো সহায়তা চান কি না। বেগম মুজিব বললেন, তিনি আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলছেন, এজন্য সহায়তা পেলে ভালো হয়। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা উৎসাহ ভরে জানতে চাইলেন, কত টাকার প্রয়োজন। বেগম মুজিবের চালের কাছে ওরা ছিল শিশু। তিনি বললেন, আপনাদের টাকা লাগবে না, ব্যাংকে কিছু টাকা আছে। ব্যাগ থেকে চেক বই বের করে বললেন, ‘যদি কয়েকটি চেকে শেখ মুজিবের সই এনে দেয়া যায় তাহলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।’ আসলে বেগম মুজিব বুঝতে চাইছিলেন যে, শেখ মুজিব জীবিত আছেন কি না এবং তিনি সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে আছেন কি না? মাঝারি ওই সেনা কর্মকর্তার পক্ষে বেগম মুজিবের ওই সমস্যার সমাধান করা ছিল অসম্ভব।

অসাধারণ এক মানবিক ও কৃতজ্ঞ নারীর ঘটনা তুলে ধরে এই অধ্যায় শেষ করি। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় এলেও বেগম মুজিব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তখনও গৃহবন্দী। মুক্তি পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ভারতীয় বাহিনীর মেজর তারার হস্তক্ষেপে সেই বাড়ির পাহারারত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করানো হয়। মুক্ত হন বেগম মুজিব ও পরিবারের সদস্যরা। এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনা, এ সময় যে দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের সহায়তায় শেখ জামাল সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তাদের যেন কোনো শাস্তি না হয় সেজন্য বেগম মুজিব মেজর তারাকে বিশেষ করে অনুরোধ করেন।

এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার ভাষায়, ওইদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধা মতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এই দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’ এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, ‘আলোচনা এখনও চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না।’ এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না

৬.

টুঙ্গিপাড়ার যে শিশুকন্যা রাজনীতির ঝড়ের পাখি শেখ মুজিবুর রহমানের ঝড়ো হাওয়ার সাথী হয়েছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি তিনি নিভৃত সংসার জীবনে ফিরে গেলেন? জবাব হলো, না। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন দেশে ফিরলেন সেদিনের বর্ণনা দিলেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন সব কাজ শেষে বাসায় ফিরলেন, সে এক মহালগ্ন। বেগম মুজিব আঁকড়ে ধরলেন তাঁকে, যেন সারাজীবন আর ছাড়বেন না। ছাড়েনওনি। তাদের সহমৃত্যু সেই সাক্ষ্যই দেয়।’

দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর বেগম মুজিবের শর্ত- তিনি কোনো সরকারি ভবনে উঠবেন না। দ্বিতীয় কাজটি ছিল, প্রতিদিন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্না করে খাবার পাঠানো। কিন্তু রাজনীতির সাথে তাঁর যে সম্পর্ক তা কখনও ছিন্ন হয়নি।

এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য শেখ শহীদকে রাজি করাতে তৎপর ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি এজন্য বেগম মুজিবের সাহায্যও চাইলেন। কিন্তু বেগম মুজিব এটা চাচ্ছিলেন না। শেখ শহীদ তখন সরকারি চাকরি করছেন। বেগম মুজিবের অভিমত ছিল, শেখ শহীদ চাকরি করায় আমার বোনের সংসারটা মোটামুটি চলে যাচ্ছে। সে এই চাকরি ছেড়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হলে সংসারটা আবার অভাব-অনটনের মধ্যে পড়বে। পরে অবশ্য শেখ শহীদ ছাত্রলীগের সভাপতি হন।

বেগম মুজিবকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলেই জানতেন বাংলাদেশের শত্রুরাও। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে এমনই এক ঘটনার বর্ণনা দেন এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া। তিনি বলেন, শাশুড়ি দুপুরে অফিসে গাড়ি পাঠালেন আমাকে বাসায় নেয়ার জন্য। হাসিনা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেখানেই ছিল। খাবার সময় তিনি আমাকে ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি দিলেন পড়ে দেখার জন্য। শাশুড়িকে পাকিস্তান মেডিকেল কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার লিখেছেন চিঠিটি। এটি লন্ডন থেকে পাঠানো হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বঙ্গবন্ধুর শ্বাসনালী থেকে রক্তক্ষরণের সংবাদে উৎকণ্ঠিত হয়ে চিঠিটি লিখেছেন। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, লাহোরে ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর শরীরে গোপনে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য মারাত্মক ক্যানসার জাতীয় ভাইরাস তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। তাঁকে বলা হয়েছিল, সেই ভাইরাস একটি ক্ষুদ্র সুচের মধ্যে থাকবে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করমর্দনের সময় হাতে বা কোলাকুলির সময় ঘাড়ে বা শরীরের যেকোনো অংশে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। ব্রিগেডিয়ার বলছেন, তিনি এতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেশত্যাগ করেছেন। অন্য কেউ কাজটি করে থাকতে পারে।

ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, বঙ্গবন্ধু বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওই চিঠি পড়ে বেগম মুজিব উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে যেকোনো মহল তখন থেকেই তৎপর ছিল, ওই চিঠিতে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

১৯৭৩ সাল থেকে দেশের নানা অস্থিরতা বেগম মুজিবকেও বিচলিত করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু যখন বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সাথে লড়াই করছেন, কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন; তখন বেগম মুজিব অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাঁর পাশে থেকেছেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে তিনি উৎকণ্ঠিত ছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যেদিন চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন, সেদিন বাসার পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া। ‘শাশুড়ি বলছিলেন, আমি এই বাড়ি ছেড়ে তোমার সরকারি রাষ্ট্রপতির ভবনে যাচ্ছি না।’ শাশুড়ির এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধু মিটমিট করে হাসছিলেন।

৭.

শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছেন, বেগম মুজিব বিষয়টি তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন। এটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। তা না হলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে এক নারীকে যখন পদে পদে লড়াই করতে হচ্ছে তখন তিনি কারাবন্দী স্বামীর হতে তুলে দিচ্ছেন রুলটানা খাতা ও কলম, জীবনী লেখার জন্য। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনী। আমার স্ত্রী, যার ডাক নাম রেনু, আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেনু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল, তাই আজ লিখতে বসলাম (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।’

কল্পনা করা যায়! স্বামী কোথায় তিনি জানেন না। দুই পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে, কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না, তাও অনিশ্চিত! বাকিদের নিয়ে তিনি গৃহবন্দী, কখন কী হয় বলা যায় না! এর মধ্যেও বেগম মুজিব বুক আগলে রক্ষা করলেন বঙ্গবন্ধুর লেখা। এই লেখাগুলো শুধু রাজবন্দী শেখ মুজিবের আত্মজীবনী বা রোজনামচা মাত্র নয়; এই দেশের রাজনীতি, সংগ্রাম আর মুক্তির ইতিহাস। এই একটি মাত্র কারণেই এই জাতির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বেগম মুজিবের প্রতি

শুধু কি লেখার তাগিদেই দেয়া? এই লেখা যে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ, সেটিও তিনি বুঝেছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’র ভূমিকায় বেগম ফজিলাতুননেছার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, (১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দিজীবন) এই সময় এক মেজর সাহেব এসে বলল, বাচ্চা লোগ ‘সুকুল’ মে যাও। যা হোক স্কুলে যাবে বাচ্চারা; জামাল, রেহানা আর রাসেল। আমি বললাম বইখাতা কিছুই তো নাই, কী নিয়ে যাবে? আর যাবেই বা কীভাবে? জিজ্ঞেস করল, বই কোথায়? বললাম, আমাদের বাসায়, আর সে বাসা তো আপনাদের দখলে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বাসা। ওরা ঠিক করল জামাল, রেহানা, আর রাসেলকে নিয়ে যাবে, যার যার বই আনবে। আমি বললাম, আমি সাথে যাব। কারণ, একা আমি আমার ভাই-বোনদের ছাড়তে পারি না। তারা রাজি হলো। আমার মা আমাকে বললেন, একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস। খাতাগুলো কোথায় রাখা আছে তাও বলে দিলেন। আমি মায়ের কথা মতো জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির ওপর ডানদিকে আব্বার খাতাগুলো রাখা ছিল। খাতা পেলাম কিন্তু সাথে মিলিটারির লোক, কী করি? যদি দেখার নাম করে নিয়ে যায়, ভয় হলো। যা হোক, অন্য বইখাতা কিছু হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একটা গায়ে দেবার কাঁথা পড়ে থাকতে দেখলাম। সেই কাঁথা হাতে নিলাম, তারপর এক ফাঁকে খাতাগুলো সেই কাঁথায় মুড়িয়ে নিলাম। ফিরে মায়ের হাতে খাতাগুলো তুলে দিলাম। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত বাড়ি লুটপাট করেছে, তবে রুলটানা খাতাগুলোকে গুরুত্ব দেয় নাই বলেই তা পড়েছিল। আব্বার লেখা খাতাগুলো উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা-কলম দিতেন, লেখার জন্য বারবার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন, মা সোজা জেলগেটে যেতেন আব্বাকে আনতে। আব্বার লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলো অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন।

কল্পনা করা যায়! স্বামী কোথায় তিনি জানেন না। দুই পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে, কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না, তাও অনিশ্চিত! বাকিদের নিয়ে তিনি গৃহবন্দী, কখন কী হয় বলা যায় না! এর মধ্যেও বেগম মুজিব বুক আগলে রক্ষা করলেন বঙ্গবন্ধুর লেখা। এই লেখাগুলো শুধু রাজবন্দী শেখ মুজিবের আত্মজীবনী বা রোজনামচা মাত্র নয়; এই দেশের রাজনীতি, সংগ্রাম আর মুক্তির ইতিহাস। এই একটি মাত্র কারণেই এই জাতির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বেগম মুজিবের প্রতি।

৮.

সেই যে টুঙ্গিপাড়ার বালিকাবধূ, তাঁর জমানো টাকা থেকে কিছু দিতেন স্বামীর খরচ হিসেবে। সেই থেকে একসাথে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার পুরো পথটাই ছিল বেগম ফজিলাতুননেছা আর শেখ মুজিবুর রহমানের পরস্পর নির্ভরতার। এই নির্ভরতার স্বরূপটি জানতে আমাদের ফিরতে হবে আবার তাদের দুজনের কাছেই।

ডায়েরির আরেক অংশে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, (রেনুকে বলছেন) সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি। আমি যখন জেলখানার বাইরে থাকতাম তখনও সত্যিকার অর্থে সংসার নিয়ে কোনোদিন চিন্তা করতাম না। তোমার সংসার তুমিই চালাও

১৯৬৭ সালের ২৮-৩০ এপ্রিল। শেখ মুজিব ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আজ ১৪ দিন হয়ে গেছে। রেনু তাঁর ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসবে দেখা করতে বিকেল সাড়ে ৪টায়। ৪টার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম। বহুদিন পর ছেলে-মেয়েদের সাথে, রেনুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড়ঘণ্টা। ঘর-সংসার, বাড়ির কথা, আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটুও ভীত হয় নাই, মনে হয় পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেনু বলল, পূর্বেই সে জানত যে আমাকে সাজা দিবে। ছেলে-মেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো। তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে আরও অনেকদিন থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে, আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে-জেলে কাটাইয়াছি, তোমার মাই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’

ডায়েরির আরেক অংশে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ‘(রেনুকে বলছেন) সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি। আমি যখন জেলখানার বাইরে থাকতাম তখনও সত্যিকার অর্থে সংসার নিয়ে কোনোদিন চিন্তা করতাম না। তোমার সংসার তুমিই চালাও।’

নির্ভরতার অপর অংশের চিত্রটি দেখি। বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে রেনুকে চিঠি লেখেন শেখ মুজিব। জবাবে রেনু লেখেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দেন।’

বেগম ফজিলাতুননেছা সম্পর্কে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খোদ শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘Mujib, She is a very precious gift to you from Allah, don’t neglect her, Please’. এর চাইতে সত্যি কথা বুঝি আর হয় না।

জবাবে রেনু লেখেন, আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দেন

এই সত্যকে অনুসরণ করেই বলি, বেগম ফজিলাতুননেছাকে নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত। সেই গবেষণায় দেখা যাবে, শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবেই নয়, তার মৌলিক চিন্তা ও কাজ আমাদের একটি বিশেষ সময়ের রাজনীতি, ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করেছে। তার এই কাজ বঙ্গবন্ধুকেই পূর্ণতা দিয়েছে। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা হতে পারেন সেই গবেষণার সূত্র। এই দুজনের স্মৃতিচারণ অনুসরণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ অডিও ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্য হতে পারে জাতির এক বড় সম্পদ।

৯.

শুরুতে যে কথাটি বলেছিলাম, সেখানেই ফিরে যাই। বিশ্বে মহান আর চির-কল্যাণকর সৃষ্টির জন্য কবি সরল সমীকরণ করেছেন ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কিন্তু বেগম ফজিলাতুননেছা আর শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনপ্রবাহ প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, এই সহজ সমীকরণেরও ব্যতিক্রম আছে। শেখ মুজিবই পূর্ণ বাংলাদেশ। এই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি, এই পূর্ণতায় বেগম ফজিলাতুননেছা ছিলেন শেখ মুজিবের জীবনজুড়ে অর্ধেকের চাইতেও বেশি। তাঁদের জীবনপ্রবাহ এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

তথ্যসূত্র- 

১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান
২. কারাগারের রোজনামচা : শেখ মুজিবুর রহমান
৩. শেখ মুজিব আমার পিতা : শেখ হাসিনা
৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ : এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া
৫. অন্তরঙ্গ আলোয় বঙ্গবন্ধুর পরিবার : সঞ্চিতা
৬. রেনু থেকে বঙ্গমাতা : নাছিমা বেগম
৭. শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও বক্তব্য
৮. বেগম সুফিয়া কামাল, এ বি এম মুসা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিমের স্মৃতিচারণ
৯. প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিত বহুজনের লেখা
১০. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইট

মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। এডিটর ইন চিফ, টিভি টুডে

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ দেখুন..