বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:মঙ্গলবারই নন্দীগ্রামে তৃণমূলের দাপুটে নেতা তথা রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর সভা। ঠিক তার আগের দিনই তাঁর বিরুদ্ধে নাম না করে তোপ দাগলেন পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি। অধিকারী পরিবারের বিপরীত মেরুর লোক হিসেবেই মেদিনীপুরের রাজনীতিতে অখিল গিরি পরিচিত। সোমবার তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এবং তৃণমূলের প্রতীক না থাকলে কারও কোনও কর্মসূচিতে যেন দলের নেতা–কর্মীদের কেউ না যান। উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন যাবৎ শুভেন্দু অধিকারীর সভাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এবং তৃণমূলের প্রতীক দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো জলঘোলা হয়েছে। চর্চা চলছে বিভিন্ন মহলে।
নন্দীগ্রাম দিবস মঙ্গলবার ১০ নভেম্বর। ১৩ বছর আগে নন্দীগ্রামে হানা দিয়েছিল সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনী। গায়ের জোরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তার পরই রাজ্যবাসীর মন থেকে একেবারেই সরে যায় সিপিএম। আর ৯ বছর আগে এই নন্দীগ্রামের পথ ধরেই বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। সেই নন্দীগ্রাম দিবসে নন্দীগ্রামেই শুভেন্দু সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে একটি সভার আয়োজন করেছেন। সেই সভা ঘিরেই এখন গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক মহল আলোড়িত। এই সভার প্রচারে অবশ্য শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামীরা (হয়তো তাঁর নির্দেশেই) একটি ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছেন।
দু’দিন আগেই সভার প্রচারের যে পোস্টার নন্দীগ্রাম–সহ পূর্ব মেদিনীপুরে দেখা গিয়েছে, সেগুলির মধ্যে কিছু পোস্টারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল শুভেন্দুর ছবি। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য জুড়ে আলোচনাও কম হয়নি। রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ অবশ্য মনে করছে, শুভেন্দু অধিকারীর অন্য সভাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বা দলের প্রতীক না থাকলেও ইচ্ছে করেই তিনি নন্দীগ্রামের সভার প্রচারের কিছু পোস্টারে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি রেখেছেন। আসলে শুভেন্দু নন্দীগ্রামের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও তখন দলনেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তাঁর আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের নামেই। তাই তিনি নিজের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর ছবিও পোস্টারে রেখেছেন। তবে তাঁরা মনে করছেন, ওই পোস্টারের ভিত্তিতে বাংলার রাজনীতিতে শুভেন্দু–বিতর্কের ইতি ঘটে যায়নি। তৃণমূলের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে নন্দীগ্রাম দিবসেই তিনি দলের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দল ছাড়তে পারেন।
তৃণমূলের সেই অংশের এমন আশঙ্কার সঙ্গত কারণও রয়েছে। কারণ, নন্দীগ্রাম দিবসেই শুভেন্দুর সভাকে কার্যত অস্বীকার করেই নন্দীগ্রামের হাজরাকাটায় পাল্টা সভা ডেকেছে তৃণমূল। সেখানে উপস্থিত থাকবেন শেখ সুফিয়ান থেকে অখিল গিরির মতো নেতারা। শোনা যাচ্ছে, সেই সভায় যোগ দিতে আসছেন রাজ্যের অন্য এক দাপুটে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম স্বয়ং। যদি তিনি থাকেন, তা হলে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার নেবে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। এদিন সাংবাদিকদের কাছে এ ব্যাপারে নিজের মত পুরোপুরি গোপন রাখেননি ফিরহাদ। তিনি বলেছেন, ‘শুভেন্দু নন্দীগ্রামে নিজে সভা করে ঠিক করছেন না। তিনি তৃণমূলের সদস্য। তাঁর উচিত ছিল তৃণমূলের সভায় যোগ দেওয়া।’ তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘আমরা কেউ নির্দল নই। আমাদের দল আছে। আর সেটা হল তৃণমূল। নন্দীগ্রামে দল কোনও সভা করলে তিনি যেতেই পারেন।’ পাশাপাশি রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়েছেন বিধায়ক অখিল গিরি। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, দাদার অনুগামী বলে কোনও পোস্টার পড়লেই, সেখানে সদলবলে চলে যাওয়ার অভ্যাস এবার তাঁদের ত্যাগ করতে হবে।
জমিরক্ষার আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে আগামীকাল ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর সমাবেশ রয়েছে। কিন্তু ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে ওই কর্মসূচি শুভেন্দুর ডাকে হলেও অধিকাংশ পোস্টারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের পতাকা নেই। তাই ওই সভার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অখিল গিরি। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘মন্ত্রী হোক আর দলের নেতা, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি লাগাতে হবে ও দলের পতাকা টাঙাতে হবে। সকলের মনে রাখা উচিত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে দেখেই বাংলা। মমতাকে দেখেই আমরা সবাই। তাই মমতাকে বাদ দিয়ে কোনও অনুষ্ঠান হতে পারে না।’ যদিও রাজনৈতিক দলের অনেকের ধারণা, এ ভাবে তৃণমূলে শুভেন্দু–বিতর্ককে বাড়িয়ে দিয়ে দলনেত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন তিনি।