মুজিববর্ষ এবং আমরা শেখ মুজিবের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি না তো ?
বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার অগ্রদূত, ৬ দফায়,৭ই মার্চে – পরাধীনতার নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ অর্জনের স্বপ্নদ্রষ্টা, মানব প্রেমের উজ্জ্বল দীপ্তির প্রতীক আর সত্য ও ন্যায়ের জন্য যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের অনন্ত সাহস জাগানো ভালোবাসার এক চিরন্তন ঠিকানা : বঙ্গনন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিব, যার স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাংলার জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তি সংগ্রামে ; ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করেছিল আকাশ-বাতাস, আর এক প্রচ্ছন্ন শক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে অর্জন করেছিল বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ; সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই যখন ঐ অমোঘ মন্ত্রকে দলীয়করণের হীন প্রচেষ্টা চলতে থাকে এবং কতিপয় গোষ্ঠীর প্ররোচনায় সেটাই হয়ে পড়ে মানুষের মাঝে বিভক্তির চিহ্ন,তখন সত্যিই হতবুদ্ধি হতে হয় ! শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার সর্বজন-স্বীকৃত মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে অর্থহীন বিতর্ক সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিজীবীও যে এ দেশে রয়েছে এবং জনগণের চোখ-কান খ্যাত মিডিয়া যে ঘটা করে ঐসব প্রচারও করছে, তাই যেন কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ রূপে প্রতীয়মান হচ্ছে !
মানুষ হিসেবে কেউই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়,আর শেখ মুজিব নিজেই যেখানে আত্মশুদ্ধি, আত্মসমালোচনার কথা বলেছেন, সেখানে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনায় কোনো বাধা তো নেই ই, বরং তা হয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক, পূর্বের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধনের পথ হয় সহজ। কিন্তু, উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীগনের উদ্দেশ্য এরূপ মঙ্গলসাধন কি না তা, যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে !
অনেকে হয়তো আনন্দিত হয়ে থাকেন যে, শেখ মুজিবের আদর্শ নিয়ে আবেগঘন সুন্দর কথা বলার মতো প্রচুর ব্যাক্তিও রয়েছেন এবং (এখন) এলাকার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে আইন প্রণয়নকারী সংসদ পর্যন্ত তাঁদের ঝাঁজালো বক্তব্যে সরগরম থাকে। যদিও কারও আনন্দ বিনষ্ট করার ইচ্ছা আমার নেই, তবুও বলতে হচ্ছে, পূর্বোক্ত গোষ্টীসমূহের কার্যকলাপের চেয়ে বহুগুনে বেশি বিস্মিত হতে হয়, এই সমস্ত (কতিপয়) লেবাসধারী, নকল আদর্শবাদী ব্যাক্তিদের কর্মকাণ্ড দেখে ; মনের মধ্যে ভয়ানক শঙ্কাও জেগে ওঠে ! এঁদের মধ্যে এমন লোক আছেন, সরকার পতনের সাথে সাথে লেবাস বদল করে অন্য দলে যোগ দিতে যাদের এক মুহূর্তও লাগবে না। (এ যেন এক জাদুর খেলা !! বলা বাহুল্য, জনগণও এ খেলা ভালোই উপভোগ করছে ! )
দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ধরনের বহুরূপী লক্ষ্মীর বরযাত্রীরা ঠাঁট বজায় রেখেই চলছে, আর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও অযোগ্যতা সকলের দৃষ্টিগোচর হওয়ার মহা-সুযোগও করে দিচ্ছে। এভাবে মানুষকে বিনোদন দিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কতিপয় রুই-কাতলা’দের সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই লক্ষ্মীর বরযাত্রীদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতাই নেই এবং শুধু তাদের জোরেই এরা টিকে আছে। এখন প্রশ্ন হলো,এই রুই-কাতলারা কারা ? কারা এই সমস্ত লেবাসধারীদের জায়গা করে দিচ্ছে এবং শেখ মুজিবের মহান আদর্শের উপর কালিমা লেপনের ঘৃণ্য চক্রান্ত করছে ?
এবার একটি বাস্তবিক বিষয়ে আসা যাক। ধরুন, সম্রাট গোপাল সাহেব একজন মস্ত মানুষ। সকল সিনিয়র নেতাদের সাথে ওঠা -বসা তার, জাঁদরেল আইনপ্রণেতাদের সাথে দহরম -মহরম, বিশিষ্ট মন্ত্রী -প্রতিমন্ত্রীদের সাথে নিয়মিত আহারে দেখা যায়। হঠাৎ (ভুলবসত হয়ে থাকবে : এত বড় মানুষ উনি, কেউ জেনে বুঝে এটা করার সাহস কি করে পাবেন ? ) তার অপকীর্তির কথা ফাঁস হয়ে গেল।সে দেশে বিচারের দায়িত্ব জনগণকেই দেওয়া হয় বলে,জনগণও তার চরম শাস্তির ব্যবস্থা নিজ হাতে করতে পেরে মহা খুশি হলো।
কিন্তু সম্রাট সাহেব যদি ‘সুবিবেচক’ জনগণের কাছে প্রশ্ন করেন, “আমাকে যারা এতদিন, আমার সমস্ত কার্যকলাপের কথা জেনেও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন,আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন,অর্জিত শক্তি-ক্ষমতা, অর্থ-বিত্তের সদ্ব্যবহার করেছেন, তারা কোথায় ? তারাও আমার মতো সমান অপরাধে অপরাধী নয় কি? কিন্ত কই, তারা তো তাদের অবস্থানে ঠিকই রয়েছে। আজ আমি -সম্রাট গোপাল ধরা পড়েছি, বিচারের সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু কাল আবার সম্রাট কপাল, সম্রাট মাতাল-দের তৈরী হওয়ার পথ কি তোমরা বন্ধ করতে পেরেছ? ” পূর্বোল্লিখিত জনগণ, যারা এই বিচারকার্য সম্পাদনের পর খুশি হয়েছিল,তাদের এবার এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবার এবং উত্তর দেবার পালা।
এবার, মুজিববর্ষ উদযাপনে আসা যাক। বড় আকারের কেক কাটা, ফানুস উড়ানো, বড় বড় দালানে আলোকসজ্জা করা, লোভনীয় সব খাদ্যের ভোজসভা আয়োজন করা এবং ঐসব ভোজসভায় যোগদান করার মাধ্যমেই যারা মুজিববর্ষককে সার্থক করার স্বপ্ন দেখেছেন, তারা শেখ মুজিবের আদর্শ ও জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করতে পেরেছেন কি ? অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এসকল অনুষ্ঠানে প্রচুর লোকসমাগম হলেও, উনাকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার লোক খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে !
কখনও এমনো মনে হয় যে, এইসব কাজের পিছনে রয়েছে ওই সকল রুই-কাতলাদের কালোহাত, যারা চায় আদর্শের জন্য নয়, বরং মানুষেরা ‘সম্পূর্ণ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে’এই মহান মানুষটির নামে জয়ধ্বনি দিবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরে যাবে উনার ক্যারিশমাটিক, রাজকীয় এবং ভালোবাসাপূর্ণ নীতি-আদর্শ থেকে অনেক দূরে । অদ্ভুত একটি মিল লক্ষ্যণীয়, এদের উদ্দেশ্যের সাথে মিলে যায় ঐ সকল ব্যর্থ নরপিশাচদের উদ্দেশ্যসমূহের, যা ছিল পুরো শেখ পরিবারকেই হত্যার মাধ্যমে বঙ্গনন্ধুর মহৎ আদর্শের বিনাশ ঘটানো এবং বাংলার উন্নয়কে নস্যাৎ করা !
এখন,এতটুকু উপলব্ধি করা যায় যে, জনগণ তাদের অন্তর থেকে আশা করে, এই সকল লেবাসধারী, নীতিহীন দুধের মাছিদের পতন ঘটবে (ঘটানো হবে) এবং সেই সাথে আদর্শবান,সচ্চরিত্রের অধিকারী যোগ্য ব্যাক্তিরা তাদের ন্যায্য স্থান ফিরে পাবে। আর মুজিববর্ষে মাথা উঁচু করে সকলে বলতে পারবে, “শেখ মুজিবের আদর্শ থেকে তারা এক বিন্দু বিচ্যুত হয় নাই “।
✒ মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ,
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়