বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:শুভেন্দু অধিকারী শেষ পর্যন্ত কী করবেন, তাঁকে নিয়ে তৃণমূলই বা শেষ সিদ্ধান্ত কী নেবে, তা একান্তই দুই পক্ষের ব্যাপার। যদিও শুভেন্দুর সঙ্গে বিজেপির নামটা কিছুটা জড়িয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মাঝে মধ্যে গেরুয়া পক্ষও মতামত দিচ্ছে। কিন্তু শুভেন্দু–বিতর্কে বিন্দুমাত্র যোগ নেই কংগ্রেস বা সিপিএমের। স্বাভাবিক কারণেই এই বিতর্কে এই দুই দলের মত জানানোর তেমন কোনও প্রয়োজন হয়নি। সিপিএম এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেওনি। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিতর্কে জড়িয়ে গেল কংগ্রেস। আর তা জড়িয়ে দিলেন স্বয়ং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। শুধু তাই নয়, রীতিমতো বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন এই বিষয়ে। বললেন, ‘শুভেন্দু অধিকারী না থাকলে মুখ্যমন্ত্রীই হতে পারতেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ প্রদেশ সভাপতির এমন মন্তব্যে স্বভাবতই এই বিতর্ক অন্যমাত্রা পেয়েছে। যদিও অধীরের মন্তব্যের জবাবে তৃণমূলের তরফে সরাসরি এর জবাব দেওয়া হয়নি।
একদিন আগেই বসিরহাটের কংগ্রেস বিধায়ক যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। তার পরই সেই বিধায়ক জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যজুড়ে যে উন্নয়নের কাজ চলছে, সেই কর্মযজ্ঞে তিনি শামিল হতে চান। তাই যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। সে দিনই রীতিমতো ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন অধীর। বলেছিলেন, দল ভাঙানোর খেলা খেলতে খেলতেই তৃণমূলের পতন হবে। আর রবিবার বহরমপুর থেকে সরাসরি নিশানা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আর তা করতে গিয়ে টেনে আনলেন শুভেন্দু–বিতর্ক। বললেন, ‘পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের যে শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে, তার পিছনে শুভেন্দু অধিকারীর অবদান স্বীকার করতেই হবে। শুভেন্দু অধিকারী এবং অধিকারী পরিবারের প্রতি নন্দীগ্রামের মানুষের গভীর আস্থা রয়েছে। এ কথা সকলেই জানেন, বামেদের বিরুদ্ধে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামই তৃণমূলকে শক্ত মাটি দিয়েছিল বাংলায়। সেই সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামে কিন্তু দিদির ভাইপোদের দেখা যায়নি। নন্দীগ্রাম তৃণমূলকে সাজিয়ে দিয়েছিল গোটা মেদিনীপুরের মাটি। আর তা করেছিল অধিকারী পরিবারের জন্যই। গোটা রাজ্য ওই সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম দেখেই বামেদের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে তৃণমূলের হাতে দিয়েছিল। শুভেন্দু অধিকারী না থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হত না।’
এদিন রীতিমতো চাঁছাছোলা ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেন অধীর। টেনে আনেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। বলেন, ‘বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চের শীর্ষে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জায়গা করে দেওয়াই এখন লক্ষ্য মমতার। আর তা করতে স্বাভাবিক ভাবেই নিজের দলকে ব্যবহার করছেন। কিন্তু দলে অনেকে প্রথম থেকেই রয়েছেন তাঁর পাশে। তাঁদের জন্য ভাইপোকে সেই জায়গা দেওয়া অনেক কঠিন। তাই তিনি অনেককেই দল থেকে ছেঁটে ফেলে দিয়েছেন। এখনও দিচ্ছেন। পরে আরও দেবেন। এখন শুভেন্দুর পালা। সেটা শুভেন্দু বু্ঝে গিয়েছেন। তাই তাঁর বিদ্রোহ করাটা অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আজেবাজে কথা বলা পছন্দ করি না। শুভেন্দুর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিরোধিতা ছিল। আছে। থাকবেও। কিন্তু, সত্যিটা সত্যিই। নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলার সময় শুভেন্দু তাতে কী ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, আমি সেখানে গিয়ে তা দেখেছি। এ–সব কথা নিয়ে আমি মিথ্যে বলব কেন?’ অধীর মনে করেন না এই বিদ্রোহ বা বিতর্ক এখানেই থেমে যাবে। তাঁর ধারণা, এমন বিদ্রোহ তৃণমূলে আরও ঘটবে। যতদিন যাবে, সেই বিদ্রোহ চরম আকার নেবে। এমনকী, দলনেত্রী নিজেও সেই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তিনি এদিন পরিষ্কার বলেন, ‘এই বিদ্রোহ আরও অনেকদূর গড়াবে। আর তা নিয়ে যাবে তৃণমূলের পতনে। তা শুধু ক্ষমতা থেকে পতন নয়, আগামিদিনে বাংলা থেকে অবলুপ্তই হয়ে যাবে তৃণমূল দলটা। এটা শুধু কথার কথা নয়, যাঁরা বিশ্বাস করছেন না, তাঁরা মিলিয়ে দেখে নেবেন।’
তিনি বলেন, ‘তৃণমূল দলটা হল আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যান ক্লাব। ওয়ান উওম্যান শো। এই দলের নিজস্ব কোনও নীতি বা আদর্শ নেই। মমতা যা বলেন, সেটাই নীতি। সেটাই আদর্শ। সিপিএম বিরোধিতা থেকে এই দলের জন্ম। সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরানোই লক্ষ্য ছিল তাদের। সিপিএম তো ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছে, তা হলে এখন আর তৃণমূলের কী প্রয়োজন? তৃণমূল দলটার এখন আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।’ রাজনীতিতে মোটেও অধীর চৌধুরি এবং শুভেন্দু অধিকারীর বন্ধুত্ব নেই। বরং যেন চিরকালের বৈরিতা দু’জনের মধ্যে। গত লোকসভা নির্বাচনেও বহরমপুরে অধীর চৌধুরিকে হারাতে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু শুভেন্দুকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে গোটা মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে জব্দ করতে পারলেও বহরমপুরে অধীরের জয় রুখতে পারেননি শুভেন্দু। কিন্তু এদিন শুভেন্দু অধিকারী প্রসঙ্গে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বেঁধেন তিনি। সেই সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীকেও তিনি পরামর্শ দেন। বিশেষ করে তাঁর বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুভেন্দুর জানা উচিত, বিজেপির দিকে তিনিই প্রথম নন, তাঁর অনেক আগে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিঁড়ি পাতা আছে।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কয়লা–পাচার কাণ্ডে সিবিআইয়ের অভিযানের কথা টেনে আনেন। বলেন, ‘দিদি জানেন, সিবিআই শুধু পুরুলিয়াতেই আটকে থাকবে না। এর পর দিদির বাড়িতে গিয়েই ঢুকবে। আর এটা জানেন বলেই দিদি বিজেপিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।’
অধীর চৌধুরির বিস্ফোরক মন্তব্যের জেরে কড়া কোনও প্রতিক্রিয়া এদিন দেয়নি তৃণমূল। তবে ইঙ্গিতবহ মন্তব্য করেছেন দলের নেতারা। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, ‘বাংলায় কংগ্রেসের অবস্থা কেমন, তা অধীর চৌধুরির অজানা নেই। গোটা দেশেও কংগ্রেসের অস্তিত্ব আজ বিপণ্ণ। তাই তাঁদের মুখে এ–সব কথা মানায় না।’ আর শুভেন্দু অধিকারী প্রসঙ্গে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সতর্ক ভাবে বলেছেন, ‘শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই সম্পর্ক কখনও ভাঙবে না। ভাঙতে পারে না। অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এ–সব কথা রটাচ্ছেন। এই রটনা কখনও সফল হবে না।’