শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বাংলাদেশের অবস্থান
— নাইম ইসলাম নিবির
অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ১২ এপ্রিল নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়। যদিও শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধের ‘নিখুঁত রেকর্ড’ রয়েছে। জ্বালানির মতো অপরিহার্য উপকরণ আমদানি চালু রাখতে দেশের রিজার্ভ সংরক্ষণ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব ঋণদাতা সংস্থা বা দেশ ঋণ দিয়েছিল, তারা তাদের মতো করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে এ পন্থার কথা বলা হয়েছে। প্রচণ্ড বিক্ষোভে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। হরতালে দোকানপাট বন্ধ, গণপরিবহনও বন্ধ, ২২ মিলিয়ন মানুষের দেশটি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি ও ব্ল্যাকআউটসহ খাদ্য ও জ্বালানির দুর্লভ ভয়াবহ দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রচণ্ড ক্ষোভে অনেক সরকারি ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালিয়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, জরুরি ওষুধ, খাদ্যসঙ্কট এসব বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিক্ষোভ করছে শ্রীলঙ্কানরা। সরকারে থাকা ২৬ জন মন্ত্রীর সবাই পদত্যাগ করেছেন। অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগে বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের অনেকে বলেছেন, তারা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিত হয়েছেন। বিরোধী দলগুলো এরই মধ্যে একটি ঐক্য প্রশাসন গঠনে রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বাধীনতার পর কখনো এমন দুরাবস্থা ও সংকটের মাঝে পড়েনি দেশটি।
শ্রীলঙ্কার এরূপ বিপর্যস্ত অবস্থার অনেক কার্যকারণ রয়েছে; যা বহু দিন ধরে পুঞ্জীভূত হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এখন মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে তাদের। দেশের ঋণ থেকে জিডিপি ২০১৯ সালের ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ১০৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কাগজপত্র, দুধের গুঁড়োসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ পেতে তীব্র অসুবিধা দেখা দিয়েছে। দেশটি প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হচ্ছে, এমনকি কাগজের অভাবে নিউজপ্রিন্টের মুদ্রণ বন্ধ হয়ে গেছে। এবছরের মার্চে দেশটিতে সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৩০.২ শতাংশ। আর এতে করেই মূলত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার মূলধারার গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রকাশ করছে, এটি এমন কিছু অকার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপ, যার ফলে বর্তমান সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার এহেন পরিস্থিতিতে কিছু পশ্চিমা মিডিয়া অসত্য দাবি প্রচার করছে যে, এটি চীনের ‘ঋণের ফাঁদ’ যা শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ঋণ কাঠামো জটিল। বৈশ্বিক পুঁজিবাজার থেকে কলম্বো সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে, যা মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ, তার পর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ১৩ শতাংশ, জাপান ১০ শতাংশ, চীন ১০ শতাংশ, বিশ্বব্যাংক ৯ শতাংশ ও ভারত ২ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে, তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদ’ কোনো সত্যের সাথে জড়িত নয়। শ্রীলঙ্কানদের ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে এটি বানোয়াট পশ্চিমা ফাঁদ।
গত এক দশকে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে মাত্র ছয় বিলিয়ন ডলার। ঋণের আরেকটি বড় উৎস হলো সার্বভৌম বন্ড। ২০০৭ সালে সরকার এ সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করা হয়। এ বন্ড বাবদ ঋণ রয়েছে ১২.৫ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক ঋণ থেকে ২.৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়। এ বছরের জানুয়ারিতে ৫০০ মিলিয়ন পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা, তাই রিজার্ভে টান পড়েছে, এ কারণে তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে পারছে না দেশটি। সরকারের বিভিন্ন বিলাসবহুল প্রকল্পও অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সমুদ্র ও বিমানবন্দর, সড়ক-মহাসড়কে গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল যার অনেকটা বাস্তবিক রূপও পেয়েছে। রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে। এটির কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৬ বছর। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও হংকংকে টেক্কা দিতে এই সিটি নির্মাণ করছে শ্রীলঙ্কান সরকার। চীনের সাথে একত্র হয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শ্রীলঙ্কা। এ ধরনের আরো বহু প্রকল্পের জন্য শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। যদিও বিপুল অর্থ খরচ করেও অনেক প্রকল্প লাভজনক হচ্ছে না।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতির গতি সঞ্চার করা। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ শেষে মাহিন্দা রাজাপাকসে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যার কারণে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। সেই আলোকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বাড়াতে একই পদক্ষেপ নেন। এ ঘটনার কয়েক মাস পরই কোভিড মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। আয়কর ও ভ্যাট কমানোয় সরকারের আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অবস্থা সামাল দিতে সরকার আরো ঋণ নিতে থাকে। কোভিড শেষ হলে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে এই ভাবনায় দুই বছর দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে যায়। সরকারের দূরদৃষ্টি না থাকায় কর ও ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয় না। ফলে একটি শোচনীয় পরিণতির দিকে দেশ এগিয়ে যায়। অন্য দিকে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাদকতাও মেনে চলতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। তাই সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায় দেশটি।
শ্রীলঙ্কায় পর্যটন খাত থেকে সে দেশের বড় জোগান আসে। করোনার দুই বছরে পর্যটন খাত বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ থাকে। বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, মহামারীর আগে বেশি পর্যটক আসত চীন থেকে, চীনে করোনা বিধিনিষেধ কঠোর থাকায় সেখান থেকে পর্যটক আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রা আসার আরেকটি বড় চ্যানেল হলো বিদেশে কর্মরত লঙ্কান নাগরিকদের পাঠানো অর্থ, মহামারীর কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিমারীর আগে পর্যটন খাতে শ্রীলঙ্কায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হতো।
২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। দেশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়। সার আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়। চালের দেশ শ্রীলঙ্কা খাদ্য ঘাটতি মেঠাতে ৪৬০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করে। এতে চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। অর্গানিক কৃষির নীতিমালা দেশের চা উৎপাদনেও পড়ে। চা রফতানি করে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এ খাত সজীব রাখতে সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। দেশজুড়ে খাদ্যঘাটতিতে জনদুর্ভোগ প্রকট আকার ধারণ করে।
বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে শ্রীলঙ্কার এ মুহূর্তে প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। দেশটি তাই অনেকের দ্বারস্থ হচ্ছেন এ তালিকায় আছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে ১৫ শতাংশ মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে এক ডলার সমান শ্রীলঙ্কার ২৩০ রুপি; তা বেড়ে ৩১৬ রুপিতে দাঁড়িয়েছে। আমদানি বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা। জরুরি খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি কেনার জন্য ভারত এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ২৫ কোটি ডলারের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ এবং চলমান সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে সহায়তার অংশ হিসেবে ২০ কোটি টাকা মূল্যের জরুরি ওষুধ উপহার দেয়।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের ভবনের সামনে বিশাল বিক্ষোভ তার জনসমর্থনে ধস বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতায় আসার সময় দেশের উন্নয়ন তথা অর্থনীতির উন্নয়ন ও শক্তভাবে দেশের হাল ধরার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন তিনি। দেশকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বানানোর প্রতিশ্রæতিও দেয়া হয়েছিল। এসব কিছুই অর্জিত না হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখন বিক্ষোভ করছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজাপাকসে বড় ধরনের কর হ্রাস ও আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বর্তমান অবস্থাকে আরো সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে বলে জনদাবি সোচ্চার হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, লঙ্কা এখন যে পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে তার মূল কারণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার কয়েক ভাই ও ভাতিজারা। এর আগে দুই মেয়াদে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তার আরেক ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে, দেশের প্রধানমন্ত্রী, ৯ মে তিনি পদত্যাগ করেছেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায়ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা রয়েছেন। দেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট চললেও তাদের পরিবারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। রাজাপাকসে পরিবারের বিপুল বৈভবও জনরোষের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান ভয়াবহ অবস্থা আসলে কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা পরিস্থিতির পুঞ্জীভূত কালো মেঘের ঘনঘটা, এককভাবে দায়ভার নেয়ার কেউ নেই। অব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্লেষকরা নেতৃত্বকে দায়ী করছেন। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারটিকেও অযোগ্যতা, অহঙ্কার ও দুর্নীতি বলে দাবি করা হচ্ছে।
এখান থেকে বের হওয়ার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার। বাড়াতে হবে রফতানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ। রাজস্ব খাত ঢেলে সাজানো ও অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোভিড-পরবর্তী অবস্থায় অর্থনীতি কিছুটা সচল হওয়ায় সাথে সাথে ভ্যাট ও কর হ্রাস প্রত্যাহার করা উচিত। অর্গানিক চাষে ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। ভারতে মোদি সরকার সব প্রদেশে
এটি চালু করেনি। সিকিম ভারতের প্রথম স্টেট যেখানে অর্গানিক চাষ বিধিসম্মত করা হয়। এটার ফল, ‘এরর ও ট্রায়াল’ পদ্ধতির অভিজ্ঞতায় অন্যান্য প্রদেশে বলবৎ হবে এমনই সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে ঋণের পর্বত থেকে শিগগিরই উত্তরণের কোনো ম্যাজিক পথ খোলা নেই। সেটি ধীরে-সুস্থে হয়তো সমাধা হবে।
সমালোচকরা বলছেন, সরকারের অনৈতিক প্রশাসনের অদক্ষতা, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মিথ্যাচার ও সরকারি সম্পত্তির পরজীবী চুরি করার অভিযোগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে; তা এখন প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে, জনগণ রাস্তায় নেমে তাদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছে। সরকার কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও কারফিউ দিয়ে অবস্থা সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। এ পদক্ষেপ পরিস্থিতির উন্নতি করবে নাকি আরো খারাপ হবে ঠিক বিশ্লেষণ করার বিষয়। তবে সঠিক ব্যবস্থা নিতে অক্ষম হলে দেশ নৈরাজ্যবাদী অবস্থায় পতিত হয়ে নরকে পরিণত হবে।
দেশে সংবিধান রয়েছে যা সবার মেনে চলা উচিত; অন্যথায় বিপ্লব হতে পারে। বিপ্লবী সরকারের হাতেও কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা থাকবে না। শ্রীলঙ্কায় বর্তমান পরিস্থিতির বিপরীতে ন্যূনতম শাসনব্যবস্থা একটি প্রতিকার বলে মনে করা হচ্ছে না। এ সঙ্কটের সময় সংসদে দেখেছি কেবল তাদের পূর্বসূরিদের পূর্ববর্তী ভুল কাজগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে জনগণের মানসিক কষ্ট উসকে দেয়া হচ্ছে। সবাই ঘোলা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। লঙ্কার মানুষ শিক্ষিত এবং আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। দেখতে হবে বর্তমান সংসদ কিভাবে ক্রমবর্ধমান জনসাধারণের আর্তনাদকে মোকাবেলা করতে পারে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানে সুন্দর একটি ধারা রয়েছে। সংবিধানের ৩৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, যে কারণ দ্বারা… অথবা অন্য যেকোনো কারণে তিনি তার অফিসের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হবেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের দায়িত্ব ও কার্য সম্পাদনে নিযুক্ত করতে পারেন এবং এ সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদে কাজ করার জন্য মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রীদের মধ্যে একজনকে নিয়োগ করতে পারেন।’ এ ধারার ওপর কাজ করা যেতে পারে। এ পথে চালিত হলে প্রধানমন্ত্রী পদে কাজ করতে রাজাপাকসে পরিবারের বাইরের একজন হলে জনগণ অনেকটা স্বস্তি বোধ করবে।
মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার আগেই সবাই পদত্যাগ করেছেন এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা নিয়োগ করা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য আরো সিনিয়র ও দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া উচিত যিনি আপদকালীন সময়ে প্রয়োজনে মন্ত্রিসভায়ও কাজ করতে পারেন। জনসাধারণের কাছে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী সরবরাহে একটি নতুন বরাদ্দ বিল বিবেচনা করতে জরুরি বৈঠক করাও গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উচিত পুরো দেশের কাছে পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ করে একটি ঘোষণা দেয়া। আঞ্চলিক করপোরেশনগুলোর জন্য প্রতিষ্ঠিত সহআন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করা, যাতে কোনোটিরই বিরোধিতা করা না হয়। আইএমএফ, ডব্লিউবি, এডিবি, চীনা উন্নয়ন ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদির সাথে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় অর্থায়ন ব্যবস্থা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা জরুরি। একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সব বৈদেশিক মুদ্রার ডিলারদের কার্যক্রম স্থগিত করে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ব্যবসা সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন। অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব আমদানির ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখতে হবে। একই সাথে জীবনযাত্রার অবস্থা আরো উন্নত হলে সাধারণ নির্বাচনে সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানানো যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কা সরকারকে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর সমন্বয় সাধন করতে হবে। পরিস্থিতি ভালো হয়ে গেলে ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে আরো বেশি করে নজর দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, শ্রীলঙ্কার টেলিকম সেক্টর এরই মধ্যে মহামারীর আগের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি উৎপাদন করছে, এর তথ্যপ্রযুক্তি খাত ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আর্থিক সেবা খাত ২৮ শতাংশ বেড়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও পরিষেবাগুলোর বিকাশে শ্রীলঙ্কার একটি আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ রয়েছে।
সাপ্লাই চেইনের গতিশীলতা চীনের সহায়তায় উন্নত হতে পারে। গার্হস্থ্য শ্রমবাজারের বিকাশে শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় আরো বেশি বিনিয়োগ করা যেতে পারে। অনেক দেশ সঙ্কট থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তাই শ্রীলঙ্কার ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়। তবে এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে শ্রীলঙ্কার জন্য চটজলদি কোনো সমাধান নেই। জরুরি কাজ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকলে কখনোই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কার্যকারণের সাথে বাংলাদেশের নেতৃত্বে রয়েছে বিশাল তফাৎ। সুতরাং শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যারা বাংলাদেশেও এধরণের বিপর্যস্ত পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা মূলত ক্ষমতা এক শ্রেণির লোভী দুষ্টু চক্র লোকজন। তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য জনগণকে মিথ্যা মতবাদ দিয়ে জাতির পিতার সোনার বাংলা বিনির্মানে বাধা প্রদান করে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে নানান সময়ে নানান সুর তুলে থাকেন। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যদি আওয়ামী লীগের অর্জন এবং বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সম্পর্কে স্পষ্ট খোঁজ রাখেন তবে অবশ্যই তারা বুঝতে সক্ষম হবেন যে বাংলাদেশের অবস্থান কখনোই শ্রীলঙ্কার ধারে কাছেও যাবার সুযোগ নেই।
নাইম ইসলাম নিবির : প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য রাজনীতিক ও কলাম লেখক
nayemulislamnayem148@gmail.com