সুন্দরী, সেগুন আর ম্যান গ্রোভের দেশে
লতিফুর রহমান প্রামানিক
(চতুর্থ পর্ব)
আমি পরের নৌকার অপেক্ষায় থাকি ।অন্যদের নামিয়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে । আমাদের জাহাজ থেকে তার দুরুত্ব অনেক খানি ।তিন কিমির হয়তো কম নয় । পানির বুকে পথের দুরুত্ব সহজে অনুমান করা যায় না। আমাদের নিতে নৌকা ফিরে আসিলে আমরা যারা শেষের যাত্রী তাদের নামিয়ে দিল তীরে। আমাদের দলের আগাম নেমে পড়া আইনজীবীরা ততক্ষনে সমুদ্রের বালু তটে ফুটবল খেলা নিয়ে ব্যস্য হয়ে পড়েছে। আমি ও যোগ দিলাম। সূর্য তার প্রজ্বলতা হারাতে বসেছে। কেউ কেউ হাতের মুঠোয় সমুদ্রের ছবি তুলে রাখছে। এই স্ম্রতি অমলিন থাকবে।
রাসমেলা এবং শুটকি পল্লীর জন্য সুপরিচিত সুন্দরবনের দুবলার চর। আসলে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝের দ্বীপ এই দুবলার চর। দুবলার চরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চরে শুধু মাত্র টেলিটক এর নেটওয়ার্ক রয়েছে। আমি রায়হান, তারিক আর পরে যোগ দেয় অনেকেই বকুল , দুবলার চর মূলত জেলে গ্রাম। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে চার মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলে পল্লী স্থাপিত হয়। এই চার মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের সদর দপ্তর বাগেরহাট থেকে মাছ সংগ্রহের পূর্বানুমতিসাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কন্যাম্পশন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান, এছাড়া আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব।
প্রতি বছর কার্ত্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পূণ্যস্নানের জন্যও দ্বীপটি বিখ্যাত। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে[৩] , তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯—১৯২৩), এই মেলা চালু করেন।[৪] প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ। দুবলার চরের রাসমেলায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্তের শহরবাসী এমনকি বিদেশি পর্যটকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে থাকেন। তিনদিনব্যাপী এ মেলায় অনেক বিদেশী পর্যটকেরও সমাগম হয়।
দুবলার চরের জেলে পল্লীতে বনদস্যুদের উৎপাত, খাবার পানির অভাব, স্বাস্থ্য সেবা সংকট, বাঘ ও কুমিরের আক্রমণ, নিম্ন মজুরি ইত্যাদি প্রায় প্রতি মৌসুমের নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়া বড়সড় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসে বিপর্যস্থ হয় দুবলার চরের জেলে পল্লী। বনদস্যুদের উৎপাত ঠেকাতে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ ও বন বিভাগের প্রহরীরা থাকলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব ছিল। অবশেষে ২০১২ সালে র্যাব মহাপরিচালককে প্রধান করে সুন্দরবনের জলদস্যু দমনের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন হয়েছিল। সাংবাদিক মোহসীন-উল-হাকীমের মধ্যস্থতায় ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দস্যুমুক্তকরন শুরু হয় এবং ১ নভেম্বর ২০১৮ জলদস্যুদের সর্বশেষ ৬ টি বাহিনী আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রায় ৪০০ বছরের জলদস্যুতার অবসান ঘটে। দুবলার চরে শুধু টেলিটক(আমাদের ফোন) এর নেটওয়ার্ক রয়েছে।
আমরা সবাই শুটকি মাছের বাজার দেখার জন্য ছুটে চলছি সব আড়তের ঘরে ঘরে। দামের ব্যাপারটা সুখকর নয়। আসলে এটাই বাস্তবতা। সুন্দরবনের মধু ভালো মানের হবে বলে সুযোগ-সন্ধানী ব্যবসায়ীরা য়ার ফায়দা লুটে খাচ্ছে, আকাশচুম্বি দাম আর ভেজালে পরিপূর্ণ। শুটকির বানিজ্য টাও একই অবস্থা। দেশের ভিন্ন দুরের অঞ্চলের শুটকি মাছের দামের চেয়ে কিছুটা বেশী দাম।হাকাচ্ছে এরা। কেউ কেই বধ্য হয়ে আর শখের বশে কিনে নিল। একপাশে অসীম জলরাশীর সমূদ্র আর তার বিপরীতে সুন্দরবন ঘিরে আছে দুবলার চারপাশে।রাতের বেলা এই নির্জন তীরে যেন একখন্ড ব্যস্ততার হাট। দলে দলে মানুষ আসছে, কেনাকাটার হুমদুম যেন। মোটামুটি সব কিছুই মেলে এখানে। এরপর চারমাস পর কেউ আর এখানে থাকতে পারবে না। তখন লাল কাকড়ার দখলে থাকবে। সন্ধ্যা যতটা গড়াচ্ছে তীরে প্রচুর বিশাল বিশাল নৌকা আর জাহাজ নোংগর গড়ছে। শত শত মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে পুরো দ্বীপ। সমূদ্রের গর্জন আর শো শো বাতাসে এক ভিন্ন রূপ যেন দেখার সৌভাগ্য হলো। আমরা কয়েক জন হাটতে হাটতে অনেক ভিতর চলে যাই। শত শত মাছের আড়ত আর মাছ শুকানোর ঘিঞ্জি অঞ্চলে সয়লাব হয়ে গেছে। সারাদেশে শুটকি মাছের চাহিদার সবচেয়ে বড় যোগান হয় এখান থেকেই।
আমরা যেন ফিরে যাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, আড্ডা বাজি, মানুষের হাট আর সমূদ্রের গর্জন শুনে শুনে।
রাত সাড়ে নয় টায় আমাদের নৌকা তীরে এসে ভিড়ে যায়। বহুদুরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাহাজ, নীল আর লাল বাতির আলোয় অতি সুন্দর ভাবে ফুটে থাকা জলের উপর যেন এক আলোর চমকানি। উজ্বল চাঁদের আলো যেন উপচে পড়ছে জলের উপর। ঢেউয়ের সাথে যেন আলো মাখামাখি রূপ।
রাতের বেলা সমূদ্রের বুকে নৌকায় উঠে চলাচল করার মতো সাহসী কখনো নই। ভীষণ রকমের ভীতিকর নির্জনতা আর পরিবেশ। পানির ঢেউ মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ছে আমাদের শরীরে। ভীষণ হিম বাতাস আর হিম জলের ফোটায় বুকের ভিতর ও কেপে উঠে থেকে থেকে। নৌকার দোলানী দেখে দেখে মনে হয় সমূদ্রের বুকে জীবন সহজ নয়। অবশেষে জল মাড়িয়ে জাহাজে উঠে পড়ি। প্রতিবার নিরাপদে জাহাজে উঠে পড়া মানে আমাদের জীবন নতুন করে ফিরে পাওয়া।
রাত নয় টার দিকে রাতের খাবার টেবিলে যাওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা শুনে আরিফ, শফি কামাল, লাভলু ভাই, আমি চলে যাই। আমরা সবাই এক টেবিলে বসে পড়ি।
তাতা ভাই রেজা ভাই ও আমাদের সাথে বসে পড়ে। কিন্তু একি খাওয়ার মেন্যু দেখে ভড়কে গেলাম। বারবিকিউ আজ রাতে। এটা নাকি রেওয়াজ চলে আসছে। আমরা সবাই ভাত খাদক। পিওর বাংগালী আর গ্রামের মানুষ। আমাদের ভাত না হলে চলে। আর রাতের বেলা ভাত না খেলে তো মনে হয় বহুদিন ক্ষুধার্ত হয়ে আছি। এসব খাবারের উপর কারো ঝোঁক নাই। তবে কয়েক জন জুনিয়র এর চোখে তৃপ্তির রূপ যেন পেলাম। তাদের মহা পরিকল্পনার শিকার হলাম আমরা এই কয় জন ভাত খাদক বাঙালি। ততক্ষন কেউ কিছু বলছে না, উলটে পালটে পোড়া মুরগী দেখছিলাম। আর মাত্র চারটি পুরি গোগ্রাসে গিলতে থাকি। তাতা ভাই আর চেপে ধরে রাখতে পারল না, আজ রাতে আর ঘুম আসবে না ক্ষুধার জন্য। আমরা হো হো করে হেসে উঠি। সাথে সাথে আমরা তার কথায় সমর্থন দিয়ে দিলাম বিদ্যুৎ গতিতে।
এরপর পাশের টেবিল গুলোতে ও আলোচনা শুরু হয়। অল্পকিছু ছাড়া বেশিরভাগ আমরা অভাগা বাংগালীরা আধাপেট ক্ষুধা নিয়ে রাত টা কিভাবে পার করব সেই ভাবনায় পাচ হাত শুকিয়ে গেলাম প্রায়।
আজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর মহা পরিকল্পনার কথা জানতে পারলাম। গিটার আর মাইকে মাঝে মাঝে গানের ট্রায়াল চলছিল। আমি ও দিনের বেলা নেটওয়ার্ক পেয়ে কয়েকটি কবিতা মোবাইলে সেভ করে রেখেছিলাম। জানি আজ আর মাফ পাওয়া যাবে না। আমার প্রস্তুতির ঘাটতি ছিলো না বললেই চলে। আরিফ ও কয়েকটি ভাইয়াইয়া গানের কলি গুন গুন করে ধার দিয়ে নেয়। রুহুল ভাই আগের রাতের মতো মাউথপিসের সঞ্চালনায় থাকছেন। একে একে আমাদের গানের শিল্পীদের পরিবেশনায় মুখরিত হয়ে উঠে পুরো জাহাজের আনাচে কানাচে। ভূপতির বাবা আমাদের ধীরেন্দ্র কাকা এতটা ভ্রমণ পাগল মানুষ এই যাত্রায় জানতে পারলাম। তিনি তার ছেলে মেয়ে, জামাই বাচ্ছাদের নিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। মুগ্ধ হয়ে নাতনী জয়ীতার একটার পর একটা গান শুনে যাচ্ছিলেন। মুলত জয়ীতাই একমাত্র প্রফেশনাল শিল্পী ছিলো আর আমাদের বাকী রা চাপে পড়ে শিল্পীর মতো। মিসেস রেজা ভাবি আজও বেশ মাতিয়ে রেখেছিলেন সাথে শিরিন আপা ও কম নন। কয়েকটি পুরনো গান আজও উপহার দিলেন। আমাকে রুহুল ভাই দেখা মাত্রই নাম ঘোষণা দিয়ে দিলেন। আমার প্রস্তুতি ছিলো। ঘাবড়ানোর কারণ নেই আজ। পরপর দুটো কবিতা আবৃত্তি করতে হলো।
আমাদের জাহাজ ছুটে চলছে সামনের পথে।
আগামীকাল জলের উপর শেষ দিন আমাদের। লটারি অব্দি অপেক্ষা করতে হলো। আমি লটারি নিয়ে বরাবরই অনাগ্রহী একজন মানুষ। এসবে আমার খুব মন টানে না। কোনকালেই আমার কপালে পুরস্কার জোটেনি। এবারে ও তাই হবে এটা কনফার্ম ছিলো। যা হবার তাই। আরিফ, ভূপতি, ফাহিম, শফি কামাল, আর জুনিয়র রা কম বেশি সবাই পেয়েছে। আমি আর কয়েক জন অভাগা হাত তালি দিতে ব্যস্ত ছিলাম।
রাত অনেক গভীর এখন। সমূদ্রের বুকে আমাদের জাহাজ ছাড়া আর কোন জাহাজ আর চোখে পড়েনি। এই বিশাল শুন্যতার ভিতর আমাদের যাত্রা।
সুত্র সহায়তা: উইকিপিডিয়া, পত্রিকা আর বিভিন্ন জার্নাল।
(চলবে)