মিশেল ব্যাচেলেটের সংকেত ও আমাদের করনীয়
— নাইম ইসলাম নিবির
চার দিন সফর শেষে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট গত বুধবার ফিরে গেছেন। ফিরে যাওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা দিয়েছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে- বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে সরকারের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান পরামর্শ- গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠন। মিশেল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওই ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের। বলা যেতে পারে, এটা এ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য শেষ সতর্কবার্তা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার কি এ সংকেত বুঝতে পেরেছে?
অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রায়ই ভারতে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে থাকেন। লেখক-সাহিত্যিক অরুন্ধতী রায়ও বলে থাকেন, ভারতে আইন করে কথা বলার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। খোদ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২১ সালের কান্ট্রি রিপোর্টে বলেছে- ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার ভিন্নমতের সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং বিচার করছে। বিরোধী মত দমন করা হচ্ছে কঠোরভাবে। পাকিস্তানের মানবাধিকার নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- পাকিস্তানে নূ্যনতম মানবাধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। ক্রমে পাকিস্তান একটি মানবাধিকারহীন রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।
এ কথাও অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই- বাংলাদেশে কিছু সমস্যা, কিছু সীমাবদ্ধতা ও সংকট আছে। দায়িত্বহীনতা এবং বাড়াবাড়িও উপেক্ষা করার মতো নয়। কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে সার্বিক অবস্থা যেভাবে দেখানো হচ্ছে; পরিস্থিতি কি ততটা ভয়াবহ? স্মর্তব্য, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে দাবি করেছিল। অভিযোগ রয়েছে- এইচআরসিকে প্ররোচিত করে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবার, যারা বিপুল বিত্তের মালিক। ‘৭৫-পরবর্তী সময়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তারা। মানবাধিকার ইস্যুতে ‘চাপ’ দেওয়ার নেপথ্যেও কি তাদের ভূমিকা নেই?
যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে- জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন মনোভাবও পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এখন ওয়াশিংটন খোলামেলা সমালোচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনও শুধু সমালোচনা করে বসে থাকে না; ব্যবস্থাও নেয়। জো বাইডেন আহূত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, জনগণের ভোটাধিকারের মতো ইস্যু নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র সতর্কবার্তা জারি করেছে। এর মধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থার প্রস্তাব করে গেলেন।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন কী করবে? বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত যে প্রশ্ন, বিতর্ক; তার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায় কম নয়। এটি আমাদের বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। র্যাব নিয়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক সতর্ক করছিল; নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছিল; তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করেছে? ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস কী করেছে? এসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে যাঁদের নুন্যতম জ্ঞান আছে তাঁরা জানেন, হুট করে একটি সংস্থার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয় না। এ জন্য অনেক ধাপ পেরোতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কোনো পর্যায়ে দূতাবাস বা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিষয় জানতে চেয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল, তারও ঠিকঠাক উত্তর দেয়নি মন্ত্রণালয়।
র্যাব এবং এর সাবকে ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ওয়াশিংটনের অনেক প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পর এখন জাতিসংঘ আস্তে আস্তে সে পথেই হাঁটছে। এখানেও একই উপেক্ষার সংস্কৃতি লক্ষণীয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানাল। কর্মসূচি ঠিক করল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ মিলে। প্রথম দিনই হাইকমিশনার তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। ১৫ আগস্ট মানবাধিকারকর্মী ও সংগঠকদের সঙ্গে বৈঠক হলো। মানবাধিকারকর্মী এবং সংগঠকদের যেসব অভিযোগ; তার জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকল না। বিদায়ের আগে মিশেলের সংবাদ সম্মেলন যেন মানবাধিকারকর্মীদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। এত অদূরদর্শী কূটনীতি কীভাবে সম্ভব?
জাতিসংঘ বাংলাদেশে মানবাধিকার-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো তদারকির জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা করার কথা বলেছে। অথচ ২০০৯ সালে সরকার আইন করে স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে। দেশের সার্বিক মানবাধিকার-সংক্রান্ত ইস্যুগুলো দেখভাল করা এই সংস্থার ম্যান্ডেট। অথচ এই সংস্থাটিকে এখন অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তো নয়ই; জাতীয়ভাবেও এ প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। একটি সৌজন্য বৈঠক করা ছাড়া মিশেলের সফরেও এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভূমিকাহীন। একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার দায় এখন পুরো রাষ্ট্রের ওপর চাপল।
জাতিসংঘের পরামর্শ নির্দেশের শামিল। এখন জাতিসংঘ দেখবে, তাদের পরামর্শ সরকার আমলে নিচ্ছে কিনা। এই পরামর্শ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে কিনা। যদি বাংলাদেশ উপেক্ষা করে (যেমন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে), তাহলে জাতিসংঘও একে একে প্রক্রিয়া শুরু করবে। নির্বাচনের আগে হয়তো আচমকা এবং ভয়ংকর কোনো নিষেধাজ্ঞায় হতবিহ্বল হবে সরকার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের সফরের তাৎপর্য কি বুঝতে পেরেছে সরকার? আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপগুলো ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন থেকে দক্ষতা এবং কৌশলের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে সামনে অনেক বড় দুঃসংবাদ আসতে পারে। যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারের নিশ্চয় অজানা নয়- জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশই সবচেয়ে বড় অংশীদার। তাই বাচাল কূটনীতিতে যেন আমরা সর্বনাশ ডেকে না আনি, সে জন্য এখনই সতর্ক থাকতে হবে। এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
নাইম ইসলাম নিবির : প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য রাজনীতিক ও কলামিস্ট
nayemulislamnayem148@gmail.com