নিজস্ব প্রতিবেদক: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। অর্থ্যাৎ দলটি ৭২ বছরে পদার্পণ করলো আজ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন একটি রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে উদারপন্থি নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ তখন তারা মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন।
তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনি ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তখন তারাও এসে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন।
কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোনো অডিটরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে আড়াইশো-তিনশো লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
মুসলিম শব্দ বাদ : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগের যে কাউন্সিল হয় সেখানে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ফলে অমুসলিমরাও এই দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। তবে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ দুটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার শুরু হয়।
আওয়ামী লীগের প্রথম ভাঙন : ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তবে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে এই রাজনৈতিক দলটিতে ভাঙন দেখা দেয়। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি মতদ্বৈততা দেখা দেয় দলের মধ্যে। আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে একটি বই লিখেছেন লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ। সেখানে তিনি লিখেন, ওই বিরোধের এক পর্যায়ে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে দলের যে সম্মেলন হয় সেখানে মওলানা ভাসানীর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে হেরে যায়। এরপর ওই বছরের ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। সেই বছর ২৫ জুলাই তিনি ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে অনেক নেতা তার নতুন দলে যোগ দেন, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়ার মোহাম্মদ খানও। তখন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। সাধারণ সম্পাদক হিসাবে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান।
বর্তমান আওয়ামী লীগ : ১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ আবার পুনর্গঠন করা হয়। ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান। কিন্তু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই তার বিরোধিতা করেন। ওই বছর মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিংয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির আসনে আসার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙালির একচ্ছত্র নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হাত ধরেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ৩৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়।