“আয়না ঘর” গনতন্ত্রের আড়ালে শেখ হাসিনার এক রাষ্ট্রীয় জাহান্নামের নাম
(প্রথম পর্ব)
যুগে যুগে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নির্মম নেশায় বুদ হয়ে দুনিয়ার অসংখ্য স্বৈরশাসক ইতিহাসের পাতায় ঘৃনিত শাসকের তালিকায় স্থান পেয়েছে। গনতন্ত্র, সমাজ ব্যবস্থা, তথ্য প্রযুক্তি, মানুষের জীবন যাপনের উন্নতির অন্তরালে ক্ষমতার নেশা শাসকদের করেছে আরো নির্মম আর দস্যুর মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জার্মানির নাৎসি বাহিনী হিটলারের হত্যাযজ্ঞ একটা অন্ধকার নির্মমতার ইতিহাসের গল্প মানুষের মন থেকে আজও ম্লান হয়নি। সেদিনের হিটলারের বাহিনী পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদি ছাড়াও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, সাম্যবাদী, রোমানী ভাষাগোষ্ঠীর (যাযাবর) জনগণ, অন্যান্য স্লাভীয় ভাষাভাষী জনগণ, প্রতিবন্ধী, সমকামী পুরুষ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষদের ওপর এই অমানবিক গণহত্যা পরিচালনা করে। নাৎসিরা এর নাম দিয়েছিল “ইহুদি প্রশ্নের চরম উপসংহার”। নাৎসি অত্যাচারের সকল ঘটনা আমলে নিলে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে নব্বই লক্ষ থেকে এক কোটি দশ লক্ষের মত।
অত্যাচার ও গণহত্যার এসব ঘটনা বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই নাগরিক সমাজ থেকে ইহুদিদের উৎখাতের জন্য জার্মানিতে আইন প্রণয়ন করা হয়। জনাকীর্ণ বন্দী শিবিরে রাজনৈতিক ও যুদ্ধবন্দীদেরকে ক্রীতদাসের মতো কাজে লাগাতো যারা পরে অবসন্ন হয়ে রোগভোগের পর মারা যেত। জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থানকে তৃতীয় রাইখ (“তৃতীয় রাজ্য”) বলা হয়। নাৎসি জার্মানি তখন পূর্ব ইউরোপের কিছু এলাকা দখল করেছে। তারা সেখানে বিরুদ্ধাচরণকারী ও ইহুদিদের গণহারে গুলি করে হত্যা করে। ইহুদি এবং রোমানি ভাষাগোষ্ঠীর লোকদের তারা ধরে নিয়ে গ্যাটোতে রাখে।
গেটো একধরনের বস্তি এলাকা যেখানে গাদাগাদি করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এসব মানুষদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হত। তারপর গেটো থেকে তাদেরকে মালবাহী ট্রেনে করে শত শত মাইল দূরের বধ্যশিবিরগুলোতে নিয়ে যেত। মালবাহী ট্রেনের পরিবহনেই অধিকাংশ মারা পড়ত। যারা বেঁচে থাকত তাদেরকে গ্যাস কক্ষে পুড়িয়ে হত্যা করা হত। তখনকার জার্মানির আমলাতন্ত্রের সকল শাখা সর্বাত্মকভাবে গণহত্যায় জড়িত ছিল। একজন ইহুদি গণহত্যা বিশেষজ্ঞ বলেছেন তারা জার্মানিকে একটি ‘নরঘাতক রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছিল।
এরপর বহু সময় কেটে গেছে, আমেরিকার পারমাণবিক বোমার আঘাতে এক সাথে পুড়ে ছাই হওয়া জাপানের মানুষের ক্ষত আজও শুকায়নি। এখনো হাজারো অনাগত শিশু বহন করছে সেই বোমার তেজস্ক্রিয়তা। এমনই হাজারো লোমহর্ষক হত্যাকান্ড পৃথিবীর মানুষ দেখেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সারা দুনিয়ার বিবেক নড়ে ওঠে। অস্ত্রের ঝনঝনানির অবসান ঘটিয়ে দেশে দেশে গনতন্ত্রের ঝান্ডা উড়তে থাকে সব খানে। গনতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে দেশে দেশে। আর সাথে সাথে সময়ের পরিক্রমায় পাল্টাতে থাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কলাকৌশল। গনতন্ত্রের আড়ালে কিংবা ঠুনকো গনতন্ত্রের দোয়াই দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে চলছে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতারণা। বাংলাদেশের ১/১১ এর সামরিক শাসন একটা সময় হিতে বিপরীত বা অসহনীয় হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতায় গনতন্ত্রের ছদ্দবেশ ধারণ করে চেপে বসলেও মানুষের প্রত্যাশা থেকে যায় আকাশের মতো। এরপর শুরু হতে থাকে একের পর এক ঘটনা পরিক্রমা। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থাকে হত্যা করেছে সরকারের তাবেদার বিচারক গন। সুশীল সমাজের মানুষ, রাজনৈতিক দল কিংবা সাধারণ মানুষ ফুসে উঠতে থাকলে বাক স্বাধীনতার টুটি চেপে ধরে সরকার। শুধু তাই নয় একের পর এক ইস্যু নিয়ে পরবর্তীতে ক্ষমতার মসনদে সরকার পাকাপোক্ত করে বসে। দেশের আমলা, প্রশাসন, বিচারক, আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনির একপেশে চাটুকারিতা, বিবেক বিসর্জন দিয়ে যে কোন মূল্যে সরকার কে ক্ষমতায় রাখতে উঠে পড়ে লাগে। আর সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের নিরস্ত্র প্রতিবাদ ঠুনকো ফানুশের মতই বিফল হতে থাকে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলায় রয়েছে জেনেই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার নিত্যনতুন আইডিয়ায় জনগণকে বোকা বানাতে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুনিয়ার ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় প্রান যায় দেশের সেনাবাহিনীর অফিসারের। যার সঠিক ইতিহাস চাপা পড়ে রয়েছে আজও। ছাত্র যুব সমাজকে লেলিয়ে দিয়ে গন জাগরণ মঞ্চ কথিত যুদ্ধ অপরাধের বিচার নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব শুন্য করে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বনাম স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি নামে দেশের মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করা, জঙ্গি নাটক, রাজাকার হয়ে উঠে সরকারের অস্ত্র। স্পর্শ কাতর বিষয় হওয়ায় দেশের মানুষ সেদিন স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধের বিচারের নামে অবিচারের জুডিশিয়াল কিলিং দেশবাশী হজম করতে থাকে অবলীলায়। এক সময়ে নাস্তিকতার বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়ে উঠা হেফাজত ইসলামের পক্ষে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পেলেও খুব বেশীদূর এগুতে পারেনি সেই ইসলামি কওমী মাদ্রাসার ছাত্র আন্দোলন। লাখো মানুষ শাপলা চত্তরে অবস্থান করলে রাতের বেলা ৫ ই মে ২০১৩। বিদ্যুৎ বন্ধ করে নিরিহ জনতার উপর গুলি চালিয়ে আলেম সমাজকে অত্যন্ত সুচারু রুপে দমন করলে সরকারের সাহস আরো বেড়ে যায়। সেই রাতের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর প্রধান আদিলুর রহমান (বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা) সরকারের রোষানলে পড়ে জেলের ভাত খেতে বাধ্য হয়।
লেখক: লতিফুর রহমান।
আইনজীবী, লেখক।
(চলবে..)