উপমন্যু রায়
করোনা–সময়ে আগুন নিয়েই খেলছে চিন। আর তা এখন আন্তর্জাতিক স্তরেও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই অধিকাংশ দেশই চিনের বিরুদ্ধে নিজেদের বিরক্তি গোপন রাখছে না।
আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া তো সেই ক্ষোভ প্রকাশ্যেই উগরে দিয়েছে। করোনা আবহে অনেক দেশই মনে করছে, পৃথিবী জুড়ে কোভিড–১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে চিনই সম্পূর্ণ জড়িয়ে রয়েছে।
এরই মধ্যে গালোয়ান উপত্যকায় চিন সেনার হামলা ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলিকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘেও। পাকিস্তানের সুরে সুর মিলিয়ে সন্ত্রাস ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি পেশ করতে চেয়েছিল চিন।
কিন্তু জার্মানি এবং আমেরিকা তার তীব্র বিরোধিতা করেছে। এটা যে চিনের কাছে একটা ধাক্কা এবং ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক স্তরে কোণঠাসা হয়ে পড়ার একটা উদাহরণ, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
গালোয়ান উপত্যকায় কর্তৃত্ব কায়েম করতে ব্যর্থ হওয়ার পর চিনের এখন মনে পড়েছে পাকিস্তানের কথা।
আর ইমরান খানের সৌজন্যে পাকিস্তানের অবস্থা তো এখন ‘না ঘরের, না রাস্তার’ হয়ে গিয়েছে। তাই চিনের কোনও দাবিতেই দ্বিমত জানানোর ক্ষমতা তাদের নেই। এই সুযোগে চিন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সীমান্ত ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
ভারতের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের এয়ার স্ট্রিপগুলিতে এই মুহূর্তে চিনা বিমানের তৎপরতা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। সেখানে চিনা কর্তারা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল বদরের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন।
চিনা কর্তারা চাইছেন, পাক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে। তার মানে পাকিস্তান ও চিন, এবার যৌথ ভাবে ভারতকে বিব্রত করতে শুরু করবে। হ্যাঁ, এই করোনা–পরিস্থিতিতেও।
চিনের এই চরিত্রের কথা এখন কারও অজানা নেই। মায়নমারও একই রকম একটি বিষয় নিয়ে এবার সরব হয়েছে। তাদের অভিযোগ, সে দেশে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে চিন মদত দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, চিনকে শিক্ষা দিতে আন্তর্জাতিক সাহায্যও চেয়েছে তারা।
আবার, হংকং নিয়েও ব্রিটেন–চিন সঙ্ঘাত নতুন করে দেখা দিয়েছে। ১৯৮৫ সালের ব্রিটেন–চিন চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৯৭ সাল থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত হংকংয়ের মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না বেজিং।
কিন্তু সম্প্রতি চিনের জিনপিং প্রশাসন নতুন আইন এনে সেই চুক্তি খেলাপ করেছে বলে অভিযোগ। ব্রিটেন জানিয়ে দিয়েছে, তারা হংকংয়ের ৩০ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্ব দেবে।
ব্যাপারটা যে চিনের ওপর পাল্টা একটা ভয়ঙ্কর চাপ, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
ভারত–চিনের সীমানা–বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ। ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে চিন দক্ষিণ তিব্বতের অংশ বলে মনে করে।
এ ব্যাপারে তারা অদ্ভুত একটা কথা বলে থাকে। তা হল, ঐতিহাসিক দিক থেকে এইসব অঞ্চল নাকি তাদের ছিল। কোন কালে কোন চিনা রাজার আধিপত্য ছিল কোনও অঞ্চলে, অতএব এই একুশ শতকেও সেই অঞ্চলগুলি তাদের চাই। এমন যুক্তিকে কোন মানদণ্ডে বিচার করতে হবে, তা ভেবে উত্তর খুঁজে পাবেন না কেউই।
কারণ, চিনের এই যুক্তি মানতে হলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর মানচিত্রটাই বদলে যাবে।
তা হলে গ্রিস তো দাবি করতেই পারে যে, তাদের দেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণ–পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত বিশাল অংশ তাদের। কেন না, সম্রাট আলেকজান্ডার এই বিশাল অংশগুলি জয় করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
ভারতও দাবি করতে পারে পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে সমগ্র দক্ষিণ এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া তাদের। এক সময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় রাজতন্ত্র এবং সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।
কাম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাটের মন্দির থেকে জাভার (ইন্দোনেশিয়া) বরবুদুরের মন্দিরে তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে।
এইসব কল্পনা থেকেই চিন দক্ষিণ, দক্ষিণ–পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ছলছুতোয় বিভিন্ন সময়ে নানা দেশের বিভিন্ন অংশ একটু একটু দখল করে নিতে চাইছে।
যেমন এ ভাবেই জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৮ হাজার কিলোমিটার জায়গায় চিনা সেনারা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। ১৯৬৩ সালে চিন–পাক চুক্তির সময় আচমকাই ভারতের ৫ হাজার ১৮০ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে নেয়।
শুধু ভারত নয়, তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক’ দাবি নিয়ে চিন সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে তাইওয়ানের সঙ্গেও। তাইওয়ান ৩৬ হাজার ১৯০ বর্গ কিলোমিটারের একটি স্বাধীন দ্বীপ অঞ্চল।
চিনের কল্পনা, তাইওয়ান আসলে তাদেরই একটি অংশ। মূল চিন থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ বা রাজ্য হল এই অংশটি।
তাই আগামী কোনও একদিন পুরো তাইওয়ান ফের চিনের সঙ্গেই মিশে যাবে। এ ছাড়া, তাইওয়ানের প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ, স্কার্বো অঞ্চল, ম্যাকসেলফ্লিড চর, স্প্রেটলি দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ চিন সাগরকে এখনই তারা নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।
ভিয়েতনামের সঙ্গে এই করোনা–সময়েও পায়ে পা লাগিয়ে সমস্যা তৈরি করছে চিন। একটি মাছধরার নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে দিয়েছে তারা।
আসলে ভিয়েতনামের সঙ্গে চিনের দ্বন্দ্বের মূল রয়েছে আরও পেছনে। আর রয়েছে সেই একই কারণ।
ভিয়েতনামের একটা বিশাল অংশ নিজেদের বলে দাবি করেছে তারা। ১৩৬৮ সাল থেকে ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত সেখানে আধিপত্য ছিল মিং রাজবংশের। তার আগেও চিনের বিভিন্ন শাসক বারবার ভিয়েতনামে আক্রমণ চালিয়েছেন। অনেকবার আধিপত্য স্থাপনও করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৪৫ সালের সেপ্টম্বর মাসে হো চি মিন ভিয়েতনামকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভিয়েতনাম (ডিআরভি) বলে ঘোষণা করেন এবং ভিয়েতনামের চেয়ারম্যান হন।
কিন্তু এই বিশাল অংশটি ঐতিহাসিক ভাবে তাদেরই বলে চিনের বক্তব্য। যদিও চিনের এমন অদ্ভুত দাবি স্বীকার করেনি ভিয়েতনাম।
এ নিয়ে কমিউনিস্ট ভিয়েতনামের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সঙ্ঘাতেও গিয়েছে চিন। কিন্তু চিনকে ছেড়ে কথা বলেনি ভিয়েতনাম। তাদের রক্তচক্ষুর দিকে চোখ রেখেই কথা বলেছে তারা।
এবার আসা যাক জাপানের কথায়। সেনকাকু বা দিয়াওউ দ্বীপপুঞ্জ জাপানেরই। ১২০ বছর ধরে সেখানে জাপানিরা বসবাস করছে।
তার আগে এই দ্বীপপুঞ্জে জনবসতি ছিল না বললেই চলে। ১৮৯৫ সাল থেকে জাপান এই দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। সেই অবস্থা আজও বর্তমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছুদিনের জন্য এই দ্বীপপুঞ্জ আমেরিকার অধিকারে চলে যায়। তার পর ফের ফিরে আসে জাপানের হাতে।
কিন্তু ১৯৭০ সালে চিন আচমকাই এই দ্বীপপুঞ্জের অধিকার দাবি করে বসে। মূল বক্তব্য সেই একই। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ নাকি তাদেরই ভূখণ্ডের। ফলে জাপানের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করে তারা।
ব্রুনেইর সঙ্গেও চিনের সম্পর্ক তিক্ত। আর তা চিনের দখলদারি মনোভাবের কারণেই।
ব্রুনেইর স্প্রেটলি দ্বীপপুঞ্জের নানা দিকে সাড়ে সাতশোরও অনেক বেশি প্রবাল প্রাচীর, ডুবো পাহাড় এবং ছোট ছোট দ্বীপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ চিন সাগরের অনেকগুলি ছোট ছোট দ্বীপ।
এই সমস্ত অঞ্চলেরও অধিকার দাবি করে চলেছে চিন। ব্রুনেইর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অনেকবার ঝামেলাও হয়েছে। আবার এ দেশের স্প্রেটলি দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ–পূর্বে রয়েছে লুইসা রিফ। এই অঞ্চলটির আর্থিক সমৃদ্ধি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।
এই লুইসা রিফেরও অধিকার দাবি করেছে চিন। ফলে ব্রুনেইর সঙ্গে চিনের সম্পর্ক এখন আদায়–কাঁচকলায়।
এবার বলি দক্ষিণ কোরিয়ার কথা। আগে মূলত জাপানেরই অধিকারে ছিল অবিভক্ত কোরিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে কোরিয়া তাদের হাতছাড়া হয়।
তখন কোরিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ভাগ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্লকে যোগ দেয়, তার নাম হয় উত্তর কোরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এখন অবশ্য উত্তর কোরিয়া চিনের খুব কাছের দেশ। আর অন্য ভাগটি আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্লকে চলে আসে, আর তার নাম হয় দক্ষিণ কোরিয়া।
এই দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও ঐতিহাসিক কারণে ভূখণ্ডের অধিকার নিয়ে ঝামেলা বাধিয়েছে চিন। কিন্তু কথা হল, ঐতিহাসিক কারণের কথাই যদি বলা হয়, তা হলে সেই ভূখণ্ডের দাবিদার দক্ষিণ কোরিয়াও। সেখানে একটা সময় ইয়ান রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এ ছাড়া পূর্ব চিন সাগরের কিছু অংশও চিন দাবি করে। অথচ, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার সীমার মধ্যেই রয়েছে পূর্ব চিন সাগরের সেই অংশ। তাই সেই অংশ চিনের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয় দক্ষিণ কোরিয়াও।
এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা অদ্ভুত কারণে চিনের নাপসন্দ। তাই দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও চিনের সমস্যা বেড়েই চলেছে।
শুধুই কি এই? কিরঘিজস্তানের অধিকাংশ অংশও চিন নিজেদের বলে দাবি করছে। তাদের যুক্তি, ১৯ শতকে রাশিয়া ওই অঞ্চলগুলি চিনের কাছ থেকে নিয়ে নেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন ১ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯০০ বর্গ কিলোমিটারের কিরঘিজস্তান স্বাধীন একটি দেশ। তাই সে দেশটি এখন নিজেদের অধিকারে নিতে চাইছে চিন।
একই ভাবে পুরো মঙ্গোলিয়াকেই চিন নিজেদের বলে দাবি করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাদের সেই অদ্ভুত যুক্তি রয়েছে। এক সময় নাকি মঙ্গোলিয়ার সমস্ত অংশই নাকি চিনের অধিকারে ছিল।
এ কথা ঠিক, সুদূর অতীতে (১৩ শতকে) ইয়ান রাজবংশের আধিপত্য ছিল সেখানে। তাই এই ঐতিহাসিক কারণ দেখিয়ে তিব্বতের মতো পুরো মঙ্গোলিয়াই তাদের বলে দাবি করে চলেছে চিন, যা মানতে রাজি নয় মঙ্গোলিয়া।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক দেশই মনে করছে, চিনের এমন কল্পনার মায়াজাল বন্ধ করা উচিত। না হলে একদিন গোটা পৃথিবীকেই ভয়ঙ্কর বিপদের সামনে ফেলে দেবে তারা।
করোনার সৌজন্যে আজ যেমন অবস্থা হয়েছে পৃথিবীর, তার চেয়েও বীভৎস ঘটনা তারা ঘটাতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানির চরিত্রই আজ মনে করিয়ে দিচ্ছে চিনের এই আগ্রাসী প্রবণতা।