দৈনিক প্রত্যয় ডেস্কঃ রাজশাহীতে পছন্দের স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। বুধবার রাজশাহী সার্কিট হাউস এলাকায় খ্রীস্টিয়ান কবরস্থানে অনন্তকালের জন্য তাকে সমাহিত করা হয়। শিল্পীর এই মহাপ্রয়াণের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে চোখের জল ঝরান হাজারও ভক্ত-অনুরাগীরা।
সকাল পৌনে ৮টার দিকে এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘর থেকে বের করে সিটি চার্চে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখানে ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। এরপর মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু সময়ের জন্য চার্চের সামনে একটি মঞ্চে রাখা হয়।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি এমন অনেক গান গেয়েছেন, যা ছড়িয়ে গেছে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। পেয়েছিলেন জনপ্রিয়তা। সুরের মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া সেই মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধাতে জানাতে এসে তাই তাদের চোখের কোণে জল। শেষ বিদায়ের আগে ধর্মীয় আচার শেষ করা হয় সিটি চার্চে এন্ড্রু কিশোরের পছন্দের পুরোহিতকে দিয়ে। যে দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তার পরিবার। শেষবারের মতো অনেকে দেখতে এসেছেন প্রিয় শিল্পীকে। সেখানে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাজশাহী সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও নায়ক জায়েদ খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট।
এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে এন্ড্রু কিশোরের কফিন। বেলা ১১টার দিকে মরদেহ খ্রীস্টিয়ান কবরস্থানে নেওয়া হয়। কবরস্থানে ঢুকতেই ডান পাশে শিল্পীর পছন্দ করা স্থানে আগে থেকেই খনন করা হয়েছিল কবর। সেই কবরে তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
হাসপাতালের হিমঘর থেকে সমাহিত করা পর্যন্ত এন্ড্রু কিশোরের পাশেই ছিলেন তার সহধর্মীনি এন্ড্রু লিপিকা, ছেলে জয় এন্ড্রু সপ্তক এবং মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা। সিটি চার্চে ধর্মীয় প্রার্থনা শেষে তারা কফিনের পাশে বসেন। এ সময় তারা ডুকরে কাঁদেন। কবরে কফিন নামানোর পরও পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা।
বাবার কফিনের ওপর মাটি দেওয়ার পর ছেলে ও মেয়ে এই কবরস্থানেই থাকা তাদের দাদা, দাদি, চাচা এবং চাচাতো বোনের কবরে ফুল দেন। এই চারটি সমাধি আছে পাশাপাশি। তবে এন্ড্রু কিশোরের সমাধি হলো সামান্য একটু দূরে। মৃত্যুর আগে জায়গাটি তিনি নিজেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
জীবন ফুরিয়ে গেলেও ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় না। তাই শেষবারের মতো শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাতে এসেছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। তারা বললেন, এন্ড্রু কিশোরের চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি। সরকার ও গীতিকার ইথুন বাবু বললেন, এন্ড্রু কিশোর ছিলেন প্লেব্যাক সম্রাট। তার জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। নায়ক জায়েদ খান বললেন, সাদা-কালো থেকে শুরু করে রঙিন, সব আমলেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তার এই শূন্যতা আর কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা বললেন, আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এন্ড্রু কিশোরকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়ার দাবি জানাবেন তিনি। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও বললেন, নগরীর একটি রাস্তার নামকরণ করতে চান গুণী এই শিল্পীর নামে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের দাবিও থাকবে সরকারের কাছে।
রাজশাহীতে ১৯৫৫ সালে জন্ম নেন এন্ড্রু কিশোর। তার বাবার নাম ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ। মা মিনু বাড়ৈ। স্কুলশিক্ষিকা মিনু ছিলেন সংগীত অনুরাগী মানুষ। মায়ের ইচ্ছাতেই রাজশাহীর ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সংগীতের তালিম নেন এন্ড্রু কিশোর। সত্তর দশকের শেষ দিকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর ১৫ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন নন্দিত এই শিল্পী।
তাকে বলা হয় ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পী ক্যানসারে ভুগছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি সিঙ্গাপুরেই ছিলেন চিকিৎসার জন্য। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি চিকিৎসার পরও দ্বিতীয়দফায় তার দেহে ক্যানসার বাসা বাঁধে। ফলে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেন।
তাই শিল্পীর ইচ্ছায় তাকে দেশে আনা হয় গত ১১ জুন। এরপর থেকে রাজশাহীতে তিনি বোনের বাসায় ছিলেন। গত ৬ জুলাই সন্ধ্যায় এখানেই উপমহাদেশের এই কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার দুই সন্তান পড়াশোনা করেন অস্ট্রেলিয়ায়। তাদের ফেরার অপেক্ষায় মরদেহ রাখা হয়েছিল হিমঘরে।
এন্ড্রু কিশোরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মরদেহ রাখার কথা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার ও রাজশাহী কলেজ চত্বরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। তাই ভক্তদের শ্রদ্ধাতে জানাতে এই সুর সম্রাটকে সমাধিস্থ করার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সারাদেশে একসঙ্গে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়।
ডিপিআর/ জাহিরুল মিলন