বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
নজিরবিহীন ঘটনা। পশ্চিমবাংলার এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেছে কিনা, এই মুহূর্তে কেউই মনে করতে পারছেন না। এমনকী, স্মরণীত কালের মধ্যে ভারতের ইতিহাসেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে কেউ নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছেন না। ঘটনাটি হল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ তুলে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে কড়া চিঠি পাঠিয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আপনি মনোনীত রাজ্যপাল, আমি নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী।’ আর তার কিছুক্ষণ পরেই রাজ্যপাল চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করে টুইট করেছেন। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, শুক্রবার তিনি মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে বিস্তারিত জানাবেন। রাতের দিকে চিঠির উত্তরে কিছুটা প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলেও জানান। নিজের বলা কথা অনুযায়ী রাতে তিনি পালটা চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আপনার চিঠি আমি পেয়েছি। কিন্তু কথা হল, আপনি সাংবিধানিক ভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আপনাকে বলতে চাই যে, সংবিধানকে আপনারাই সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা করেছেন।’ নবান্ন এবং রাজভবনের এই লড়াই রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে।
রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়ে পশ্চিমবাংলায় আসার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। বিভিন্ন সময়ে নানা অপ্রীতিকর প্রশ্ন তুলে বারবার অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন সরকারকে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জবাব দিয়েছেন কম। তবে তাঁর দলের অন্য নেতারা রাজ্যপালের সমালোচনা করেছেন বহুবার। করোনা পরিস্থিতিতেও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। কখনও টুইট করে, কখনও ভিডিও বার্তায় ত্রাণে রাজনীতিকরণ, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, বিরোধী দলের সাংসদ ও অন্য নেতাদের লকডাউন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে পুলিশ দিয়ে আটকে দেওয়া, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অসহযোগিতা, অথচ বিদেশি (হু) পর্যবেক্ষকদের সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে সরব হয়েছেন রাজ্যপাল। রাজ্যপালের মন্তব্যগুলি যে ভালো ভাবে নিচ্ছেন না, তা বুধবারই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্ন থেকে বলেছিলেন, ‘তাঁর সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। তিনি খুব লম্বা, আমরা ছোট। তিনি ৮ ফুট, আমরা ৫ ফুট। আমরা এত ছোট যে, তাঁর মতো লম্বা মানুষকে মাপতেই পারব না।’ মুখ্যমন্ত্রীর সেই ইঙ্গিতবহ কথার জবাব অবশ্য রাজ্যপাল দেননি। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে তিনি সরেও আসেননি। বৃহস্পতিবারও তিনি নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
এর পর এদিন সন্ধ্যায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ পাতার দীর্ঘ চিঠি লেখেন রাজ্যপালকে। সেখানে তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘আপনি বোধ হয় ভুলে গিয়েছেন যে, আপনি মনোনীত রাজ্যপাল, আর আমি ভারতের গর্বিত একটি রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী।’ তীব্র আক্রমণ শানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আপনার কথা বলার ভঙ্গি, শব্দচয়ন অসাংবিধানিক। বিষয়টি আপনার নিজেরই বিচার করে দেখা উচিত। আপনার মন্তব্য আমার দফতরকে অসম্মানিত করেছে। আমার মন্ত্রিসভাকেও অপমান করেছে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার এবং আমার মন্ত্রিসভার পরামর্শ আপনি উড়িয়ে দিতেই পারেন, কিন্তু আম্বেদকরের কথা আপনার অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। যে রাজ্যের রাজ্যপাল আপনি, সেই রাজ্যের সরকারকে আক্রমণ করাটাই আপনার কাজ হয়ে উঠেছে।’
রাতে পালটা চিঠিতে রাজ্যপাল বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে তিনি যে সব অভিযোগ করেছেন, তা শুধু ভুলই নয়, সাংবিধানিক ভাবেও একেবারেই দুর্বল। কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারীকে নিজে আইন হয়ে ওঠার অধিকার আমাদের দেশের সংবিধান দেয়নি। জমিদারির মতো রাজ্য চালানো যায় না। সংবিধানের সমস্ত শর্ত মেনেই চালাতে হয়। ক্রোধ থেকেই যে আপনি এমন কথা বলেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে। আমি সংবিধানের মধ্যে থেকেই যা করার করব। যতই আমাকে চ্যালেঞ্জ করুন, আমি আমার কাজ করবই। আমি কাল বেলা এগারোটার সময় এর বিস্তারিত জবাব দেব। আমি মনে করি, প্রকৃত সত্যটা রাজ্যের সাধারণ মানুষেরও জানা উচিত।’ তিনি এ কথাও মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আপনি যেমন সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছেন, আমিও তেমনই সংবিধানের ১৫৯ নম্বর ধারা মেনে শপথ নিয়েছি। সেই ধারা মেনে আমি দেশের সংবিধান ও আইনকে রক্ষা করতে যথাসাধ্য করব। সেই সঙ্গে রাজ্যের মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করব। কিন্তু আপনার বক্তব্য পড়ে আমার মনে হয়েছে, আপনি চান রাজ্যপাল স্লিপ মোডে চলে যাক।’ তাঁর বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলে রীতিমতো জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পত্রাঘাতের বিস্তারিত জবাবে শুক্রবার তিনি কী বলেন, সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।