বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিন গোনা শেষ। এ কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার ছিল তাঁর এই রাজ্য সফরের দ্বিতীয় দিন। এদিন তিনি ছিলেন খুবই ব্যস্ত। সারাদিন তাঁর ছিল ঠাসা কর্মসূচি। সফর শেষ করে রাতে দিল্লি ফিরে যান। তার পর ফেসবুকে এক বার্তায় ইংরেজি এবং বাংলাভাষায় তিনি লেখেন, ‘ধন্যবাদ পশ্চিমবাংলা। মমতাদিদি, একটা বার্তা কিন্তু পরিষ্কার। আপনার দিন গোনার পালা শেষ।’ তার আগে এদিন সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। সেখানে বলেন, ‘পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস, সিপিএম এবং তৃণমূলের শাসন দেখেছে বাঙালি। সিপিএম এবং তৃণমূল রাজ্যের কোনও উন্নতিই করতে পারেনি। তৃণমূল তো রীতিমতো অপশাসন কায়েম করেছে রাজ্যে। এই দুরবস্থা থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র বিজেপিই। আপনারা বিজেপিকে একবার সুযোগ দিন। আমরা পাঁচ বছরের মধ্যে সোনার বাংলা গড়ে দেখিয়ে দেব।’
এদিন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের কাজ নিয়ে ওঠা প্রশ্নে সাংবাদিকদের কাছে কড়া প্রতিক্রিয়া জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্পষ্ট বলেন, ‘এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই কাজ করছেন রাজ্যপাল। আপনারা বরং এক্তিয়ারের কথা তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করায় এক জেলাশাসককে যাঁরা রাতারাতি বদলি করে দিয়েছেন। রাজ্যপালের নামে সরকারের পদাধিকারী মন্ত্রীরা যে সব মন্তব্য করছেন, তা সংবিধানসম্মত কিনা, তা তাঁদের কাছেই জানতে চান।’ এরই পাশাপাশি রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যে তল্লাশি চালাচ্ছে, তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বিষয়েও মুখ খুলেছেন অমিত শাহ। সাংবাদিকদের এদিন তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার লালাজির বাড়িতে সিবিআই অভিযান চালিয়েছে বলে মমতাদির অভিমান হয়েছে। তাই তিনি এ–সব কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন, লালাজির সঙ্গে মমতাদির কী সম্পর্ক? এই বিষয়টি তিনি আগে প্রকাশ্যে আনুন। লালাজির জন্য তাঁর কেন এত চিন্তা হচ্ছে?’ একই সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেন, ‘কয়লার রাজস্ব যারা চুরি করে, তাদের জন্য কেন এত চিন্তা মমতাদির। তার চেয়ে রাজ্যে মহিলাদের ওপর যে অপরাধ হচ্ছে এবং বেড়ে চলেছে, তা নিয়ে তিনি একটু চিন্তা করুন। কই, সে সব নিয়ে তো তাঁকে কখনও চিন্তিত হতে দেখি না!’
এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আক্রমণ করে বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলেন, ‘দীর্ঘ বাম এবং তৃণমূল শাসনে বাংলার কোনও উন্নতি হয়নি। অনেক আশা নিয়ে বামেদের বিদায় দিয়ে রাজ্যের মানুষ ২০১০ সালে তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু মানুষের কোনও আশাই পূরণ করতে পারেনি তৃণমূল। সারা রাজ্যে এখন তোলাবাজি চলছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার শাসক দল। তার অশুভ প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।’ পাশাপাশি তিনি দাবি করেন, বাংলায় সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে একমাত্র নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপিই। যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, সেইসব রাজ্যেই প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। এখনও হচ্ছে। সুযোগ পেলে পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাকে সোনার বাংলা তৈরি করব আমরা।’ তিনি রাজ্যের প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও এদিন প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘রাজ্যের প্রশাসনের পুরোপুরি রাজনীতিকরণ করা হয়েছে শাসক দলের স্বার্থে। আর শাসক দলের সৌজন্যে বাংলার রাজনীতি হয়ে উঠেছে অপরাধীদের আখড়া। বাংলা জুড়ে এখন শাসক দলের নেতৃত্বে চলছে দুর্নীতিরাজ। করোনা–আমফানের ত্রাণবিলিতেও সেই দুর্নীতি চলেছে। সাধারণ দুর্গত মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও জাতপাতের রাজনীতি করা হয়েছে।’
শুক্রবার বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ নিউটাউনের হোটেল থেকে দক্ষিণেশ্বরে রওনা হন অমিত শাহ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুকুল রায়, বাবুল সুপ্রিয়, দিলীপ ঘোষ, অনুপম হাজরা, কৈলাস বিজয়বর্গীয় প্রমুখ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে সেই সময় কিছুক্ষণের জন্য মন্দিরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান অগ্নিমিত্রা পাল–সহ বিজেপির মহিলা মোর্চার সদস্যরা। সওয়া এগারোটা নাগাদ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পুজো দেন অমিত শাহ। তার পর বলেন, ‘এই বাংলার মাটি বড় পবিত্র। এই মাটি শ্রীরামকৃষ্ণের। এই মাটি শ্রীচৈতন্যের। কিন্তু বাংলার সেই গৌরব আজ আর নেই। সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলার সমস্ত ঐতিহ্য নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে তোষণের রাজনীতি করে। তাই বাংলার মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা একজোট হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করুন। মা কালীর কাছে আমি গোটা বাংলার মঙ্গল কামনা করছি।’
দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে তিনি টালিগঞ্জের গলফ ক্লাব রোডে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘শ্রুতিনন্দন’–এ যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাবুল সুপ্রিয় এবং দিলীপ ঘোষ। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং এবং বিজেপি নেতা সব্যসাচী দত্ত। শ্রুতিনন্দনে কিছুক্ষণ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার পর সোজা চলে যান সল্টলেকের ইজেডসিসিতে। একটা নাগাদ সেখানে সাংগঠনিক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে তিনি দলের নেতাদের স্পষ্ট বলেন, ‘শুধু রাজ্য সরকারের বিরোধিতাই করবেন না, মানুষের আস্থাও অর্জন করার চেষ্টা করুন। তার ওপরই কিন্তু সাফল্য নির্ভর করছে।’ বৈঠকে ছিলেন কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, নদিয়ার শীর্ষনেতারা। সকলকে তিনি পরামর্শ দেন, ‘গোটা বাংলায় বিজেপির চিন্তাভাবনা, দর্শন ও বিচারধারাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন, বাংলার প্রকৃত উন্নতি এবং সুরক্ষার জন্যই বিজেপিকে আজ এখানকার মানুষের বড় প্রয়োজন। গত ৪৫ বছর ধরে অপশাসন বাংলাকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছে। নিজেরা সেটা আগে বুঝুন। পাশাপাশি মানুষকেও বোঝান।’
এদিন বিকেল সওয়া তিনটে নাগাদ তিনি নিউটাউনের মতুয়া মন্দিরে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষ ছাড়া রাজ্যের আরও কয়েকজন নেতা। মন্দিরে পুষ্পবৃষ্টি করে শাহকে স্বাগত জানানো হয়। সেখান থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ বাগুইআটির জগৎপুরের এক মতুয়া উদ্বাস্তু পরিবারের বাড়ি যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং দিলীপ ঘোষ। সেই সময় নবীন বিশ্বাসের বাড়িতে দুপুরের খাবার খান তিনি। খাবারের তালিকায় ছিল পুরোপুরি বাঙালি পদ। বিকেল সওয়া পাঁচটা নাগাদ দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বলেন, ‘আমি কথা দিচ্ছি, এবারের নির্বাচনে রিগিং বা সন্ত্রাস হতে দেব না। কিন্তু আপনারা পাঁচ মাস কঠোর পরিশ্রম করুন। তা হলে ৫০ বছর বাংলার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। সমস্ত বুথ শক্তিশালী করুন। বুথ যদি শক্তিশালী না হয়, তা হলে ক্ষমতা এলেও তা ধরে রাখা যাবে না। আর মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আপনারা নিজেদের কাজ করুন। তৃণমূলের ব্যর্থতার কথা বারবার প্রচার করুন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাফল্যের কথা প্রচারে তুলে ধরুন।’
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নিউটাউনের হোটেলে দলের কোর কমিটির বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষ হওয়ার পর রাত পৌনে দশটা নাগাদ দমদম বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন। সেখান থেকে সওয়া দশটায় দু–দিনের বাংলা সফর শেষ করে বিশেষ বিমানে দিল্লি চলে যান। এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তীব্র কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। এক বিবৃতিতে তৃণমূল জানিয়েছে, মিথ্যের ঝুড়ি নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন অমিত শাহ। দু–দিনের সফরের নামে বাংলায় এসে বাংলার বদনাম করে গিয়েছেন। তারা আরও জানিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তিনি ভিত্তিহীন অভিযোগ করে গিয়েছেন। তৃণমূলের পাশাপাশি মুখ খুলেছে বাম এবং কংগ্রেসও। ভোটের আগে ধর্ম ও জাতপাতের নামে মানুষকে ভাগ করতে চাইছে বিজেপি। বাংলায় সেই কাজটাই জোরদার করে গেলেন অমিত শাহ।