উপমন্যু রায়
সত্যিই, পৃথিবীটা যেন আচমকাই বদলে গিয়েছে। সেই খোলামেলা ঘুরে বেড়ানোর পৃথিবীটা আজ যেন স্বপ্নের মনে হয়। জানি না তেমন মুক্ত দিনগুলি আবার কবে ফিরে আসবে!
মাঝে মাঝেই পরিচিত–অপরিচিত অনেকের মুখেই একটা সংশয় এবং চিন্তার কথা শুনতে পাচ্ছি। এই করোনা পরিস্থিতি এবং তার জেরে লকডাউনই যে অনেকের মানসিকতায় এই পরিবর্তন এনে দিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁরা ভাবছেন, মানুষের মধ্যে এখন পারস্পরিক সংশয় এবং সন্দেহ আরও অনেক বেড়ে যাবে। অনেকেই ভাববেন, যিনি কাছে এসে কথা বলছেন, তিনি বন্ধু–বান্ধব বা আত্মীয়স্বজন, যিনিই হোন না কেন, তিনি করোনামুক্ত তো? এখন তো উপসর্গহীন করোনা সংক্রমণও হচ্ছে!
যাঁরা এমন ভাবছেন, তাঁদের ভাবনা অমূলক নয়। উড়িয়ে দেওয়াও যাবে না। আর, এ কথাও সত্য, ভাবার মতো কথাই বলছেন তাঁরা। পৃথিবী জুড়ে চালু হওয়া পারস্পরিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম এখন আমাদের বাস্তবিকই সকলের কাছ থেকে দূরে, আরও দূরে সরিয়ে দেবে না তো? তা হলে তো আমরা আরও একা হয়ে যাব! আরও স্বার্থপরও হয়ে যাব!
এমনিতেই এই উত্তর–আধুনিক পৃথিবীতে ব্যক্তিগত সাফল্যের চিন্তায় আমরা ক্রমশ নিজেদের নিঃসঙ্গ করে ফেলছিলাম। অন্যকে দেওয়ার মতো সময় আমাদের হাতে অনেক–অনেকটাই কমে আসছিল। তাতে ব্যক্তিগত সাফল্য আসলেও মানসিক দিক থেকে আমরা তো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম অন্তঃসারহীন এক পৃথিবীর দিকে। প্রথমে না হলেও পরে যে সেই পরিণাম আমরা বুঝতে পারছিলাম না, তা তো নয়। কিন্তু আমাদের যেন কিছু করার ছিল না। আসলে আমরা সেই সময় এবং তার রীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছিলাম!
কেন জানি না, হয়তো তাই আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কি সত্যিই স্বাধীনতা চায়? নাকি দাসত্বকেই মনের গোপনে নিজের অজান্তেই লালন করে চলে? না হলে এ ভাবে আধুনিকতার এমন অস্বাভাবিক রীতির কাছে সে কেন আত্মনিবেদন করে বসে?
কিন্তু, করোনা এবং লকডাউন এসে আমাদের পৃথিবীর সেই উত্তর–আধুনিক রীতিকে শুধু চ্যালেঞ্জ করেনি, আমাদের সকলকে ঘরে বসিয়ে দিয়েছে। একদিন, দু’দিন বা তিনদিন নয়। মাসের পর মাস। আমরা ঘরবন্দি হয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। প্রথম দিকে ছুটির আমেজে বিষয়টাকে নিলেও পরে একঘেয়ে লাগতে শুরু করে দেয় সেই বন্দিজীবন। তার পর সময় যত গড়িয়েছে জীবন ও জীবিকার চিন্তা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে সকলের সামনে।
এর পরও তো আমাদের সামনে আরও একটা চিন্তার পরিসর খুলে দিয়েছে এই সময়। তা হল, এই যে আমরা একা গৃহবন্দি হয়ে রয়েছি, এই একা থাকার যন্ত্রণা তো আমরা এখন ভালোই উপলব্ধি করতে পারছি। কখনও কখনও হাঁফ ধরে যাচ্ছে একা থেকে। বুঝতে পারছি, কতদিন পরিচিত কত মুখের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে না! আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ভিডিও কলিং, চ্যাটে কথা হলেও মুখোমুখি বসে কথা বলার সেই সুন্দর মুহূর্ত তো এখন আর আসে না। সেই সুযোগটা একবার আসুক, এখন যেন আমরা মনে মনে সেই কামনাই করে চলেছি।
সেই সঙ্গে এই উপলব্ধিও কি আমাদের হচ্ছে না যে, পৃথিবীতে মানুষ কখনও একা বাঁচতে পারে না! বাঁচতে হলে বাঁচতে হবে একসঙ্গেই। জানি, স্যাটেলাইট আর কেবলের সৌজন্যে এখন পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। মানে বিশ্বগ্রাম। ইংরেজিতে যাকে সুন্দর করে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলি আমরা। ভিলেজ, —গ্রাম! গ্রামই তো! —তবু একা বাঁচতে গিয়ে কি মনে হয় না, সেই গ্রামটাও কম বড় নয়? সেখানে একা একা দিনযাপন কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবও।
তা হলে এই করোনা আবহ কি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষগুলিকে আবার পরস্পরের কাছাকাছি এনে দেবে না? আমরা কি পরস্পরের দিকে বাড়িয়ে দিতে পারব না বিশ্বাস ও নির্ভরতার একটা হাত? সামনের পথ ধরে হাতে হাত রেখে আমরা কি এগিয়ে যেতে পারব না আগামীর দিকে?
অনেকেই হয়তো বলবেন, আগে করোনা পরিস্থিতি কাটুক, আগে জীবিকার নিশ্চয়তা আসুক, তার পর ও–সব ভাবা যাবে। —না, ভাবতেই হবে এখন। —হ্যাঁ, এখনই। না হলে আবার সেই স্বার্থপরতা এসে গ্রাস করবে আমাদের। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সামনে এখন কিন্তু বিরাজ করছে ভয়ঙ্কর এক অন্ধকার। সেই অন্ধকার কিন্তু এই সভ্যতাকে গিলে খেতে বিন্দুমাত্র সময় নেবে না!
কারণ, এরই মধ্যে একটি আশঙ্কার কথাও শোনা গিয়েছে। বলা হচ্ছে, করোনা নাকি সবে শুরু। আরও বড় বিপদ নাকি আসছে আমাদের সামনে। পরবর্তী সংক্রামক রোগের হাত থেকে মানব জাতিকে বাঁচাতে হলে এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। এই হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছে চিনের ‘ব্যাট উওম্যান’ নামে পরিচিত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ তথা উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির ডেপুটি ডিরেক্টর শি ঝেংলির মুখে।
তিনি বলেছেন, যে ভাইরাস এখন পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তা নাকি হিমশৈল্যের চূড়ামাত্র। এর পর আরও ভয়ঙ্কর ভাইরাস আসছে পৃথিবীকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিতে। —সত্যিই অবাক লাগে ভাবতে, চিন ঠিক চাইছেটা কী? আগেই অভিযোগ উঠেছে, এই ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নাকি উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি নামে ওই ল্যাবরেটরিতেই। যদিও এই ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর ওয়াং ইয়ানয়ি বারবার তা খারিজ করে দিয়েছেন।
চিনও করোনা ভাইরাসের সমস্ত দায় থেকে বারবার নিজেদের বাঁচাতে চেয়েছে। এখনও চাইছে। শুধু তাই নয়, কখনও তা আমেরিকার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, কখনও আবার পশ্চিমের দেশগুলির স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের কোনও অভিযোগই বৈধতা পায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও (বা, ‘হু’) তারা পাশে পেয়েছিল প্রথমে। এখনও ‘হু’ তাদের পাশ থেকে সরে যায়নি। তবে গলা নামিয়ে পরে স্বীকার করে নিয়েছে, উহানের সি ফুড মার্কেট থেকেই নাকি ছড়িয়েছে কোভিড–১৯।
আমরা এখনও পুরো সত্যিটা জানি না। বর্তমান বিপদ কেটে যাওয়ার পর পৃথিবীর উচিত করোনা উৎপত্তির মূল কারণ উদ্ধার করে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো। নাকি, সেই সময়ই আমরা আর পাব না! যে কারণে আরও ভয়ঙ্কর কোনও ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে উহানের সেই ল্যাবরেটরির তরফে! এও আমরা জানি না, চিনের উদ্দেশ্যটা ঠিক কী? সেও কি চাইছে এ–ভাবে পৃথিবীকে নাস্তানাবুদ করে জগতের অধীশ্বর হতে? যেমন চেয়েছিলেন হিটলার! তাঁর পরিণতি কিন্তু ভালো হয়নি। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সে কথা মনে রাখা উচিত।
জানি না আমরা আবার কবে মুক্ত মনে ঘুরে বেড়াতে পারব গোধূলির ছায়ায় ঢাকা রাস্তা ধরে! জানি না আবার কবে সন্ধ্যাগুলি কাটাতে পারব কাচে ঢাকা আলোয় ঝলমল রেস্তোরাঁগুলিতে! জানি না সেই দিনগুলি কবে আসবে! বা, আদৌ আসবে কিনা। তবে বিশ্বাস করি, হ্যাঁ, হতাশার এই সূচিভেদ্য অন্ধকারেও বিশ্বাস করি, আবার আকাশ নির্মল হবে। আবার ভোরের রোদ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। আবার, আবারও রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ আমাদের অনেক দূরের ভাবনায় নিয়ে যাবে।
সেই দিনগুলি যেন আমরা আর নষ্ট করে না দিই। তারই মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে এই বন্দিজীবনে। তার সঙ্কেত কিন্তু ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে অষ্ট্রিয়া থেকে জার্মানি, রুমানিয়া থেকে নেদারল্যান্ডস, চিলি থেকে কানাডা ইত্যাদি দেশে। এমন অনেক মানুষের কথা আমরা জেনে গিয়েছি আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে, যাঁরা জীবনটাকে নিয়ে সত্যিই ভাবছেন। অনেকেরই আত্মবিশ্লেষণে উঠে আসছে নিঃসঙ্গ থাকার যন্ত্রণার কথা। তাঁরা কিন্তু বুঝতে পারছেন, ভবিষ্যতের পথে চলতে হলে আমাদের এগোতে হবে একসঙ্গে।
এই ধারণাকে কার্যকর করতেই হবে। প্রত্যেককেই। নিজের মতো করে। জীবন একটাই। সময়ও দ্রুত এগোয়। জীবন এবং সময় কিন্তু মানুষের স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করে না!
আপাতত সেই সুন্দর দিনগুলির অপেক্ষায় না হয় থাকলাম আমরা।