বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : সিঙ্গুর আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে বাংলার মানুষের দৃষ্টি নিয়ে গেলেও পায়ের তলায় মাটি দেয়নি। দিয়েছিল নন্দীগ্রাম। কিন্তু, অনেকেই বলেন, সেই মাটি নাকি মমতা পেয়েছিলেন শুভেন্দুর জন্য। কিন্তু পরবর্তী কালে দলে শুভেন্দু গুরুত্ব পেলেও দলনেত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরার জন্য নাকি তাঁকে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সেই অভিমান শেষে জ্বলে উঠেছে এই ডিসেম্বরেই। মমতা ও শুভেন্দুর পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নন্দীগ্রাম এখনও রয়েছে। তবে সেই নন্দীগ্রাম কাকে পছন্দ করে, কাকে গুরুত্ব দেয়, তা বোঝা যাবে এবার। তারিখটা নতুন বছরের ৭ জানুয়ারি। একই দিনে নন্দীগ্রামের দুই দিকে দুই জনসভা। তেখালির সভার আয়োজক তৃণমূল। যার প্রধান বক্তা অবশ্যই মমতা। অন্য একটি সভার আয়োজক বিজেপি। প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই শুভেন্দু।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সমস্ত কৃতিত্ব দাবি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, তা যে পুরোপুরি সত্য নয়, তা বলে দিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বলে আসছেন, ‘নন্দীগ্রামের আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব ছিল শুভেন্দুর। তিনি যদি না থাকতেন, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি তৈরি দূরের কথা, পায়ের তলায় মাটিও খুঁজে পেতেন না।’ এবার সেই শুভেন্দু সরে গিয়েছেন তৃণমূল থেকে। যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। তার পর থেকেই তাঁকে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লেগেছে তৃণমূল। আর তা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই নির্দেশে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক মহলের ধারণা তেমনই। ইতিমধ্যে শুভেন্দু অধিকারীকে বিশ্বাসঘাতক থেকে ধান্দাবাজ, নানা অভিধায় অভিযুক্ত করে আক্রমণে নেমে পড়েছেন সৌগত রায়, ফিরহাদ হাকিম থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সকলেই। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, শুভেন্দু যদি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নেতা না–ই হতেন, তা হলে তাঁকে এ ভাবে তৃণমূলের শীর্ষনেতারা নিশানা করতেন না।
তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের জমি আন্দোলনের পর ২০১১ থেকে নন্দীগ্রাম তৃণমূলেরই দখলে। ২০০৬ সালের শেষে হলদিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির এক বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তির জেরে উত্তর হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম। সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে খেজুরি, ভাঙাবেড়া, তেখালি। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলে স্থানীয় সংগঠিত করে তুলেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। ২০১৬ সালে সেই নন্দীগ্রামেই জিতে বিধায়ক এবং পরে মন্ত্রী হন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু সেই শুভেন্দুর গড় নন্দীগ্রামেই এবার বিজেপি এবং তাঁকে জবাব দিতে চান মমতা। বলা যায়, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে শুভেন্দুর ক্ষমতা খর্ব করতে শেখ সুফিয়ানের অনুরোধে মমতা নন্দীগ্রামে সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে ৭ ডিসেম্বর মেদিনীপুরে সভা করেছিলেন মমতা। তখন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেও বিধায়ক পদে ছিলেন শুভেন্দু। বিজেপিতেও যোগ দেননি। তবু মেদিনীপুরের সভায় মমতা নাম না করে শুভেন্দুর উদ্দেশ্য বলেছিলেন, ‘তৃণমূল অত দুর্বল নয়। কেউ যদি মনে করেন, তৃণমূলকে ব্ল্যাকমেলিং করবেন, বার্গেনিং করবেন, বিজেপির যাঁরা বন্ধু, তাঁদের মনে রাখা উচিত, তাঁরা ভুল করছেন। তাঁদের বলব, আগুন নিয়ে খেলবেন না। এভাবে তৃণমূলকে জব্দ করা যাবে না।’
আর শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর কাঁথিতে বুধবার মিছিল করে তৃণমূল। সভাও করে। বলা যায়, শুধু শুভেন্দু নন, কাঁথি থেকে অধিকারী পরিবারকে কার্যত হটিয়ে দেওয়ার অভিযানই এদিন শুরু করে দিল শাসক দল। সেখানে সৌগত রায়, ফিরহাদ হাকিমের আক্রমণের নিশানা ছিলেন শুভেন্দুই। সৌগত রায় দাবি করেন, ‘মমতার নেতৃত্বেই নন্দীগ্রামের আন্দোলন হয়েছিল। তিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব না দিলে সেখান থেকে সিপিএম এবং লক্ষ্মণ শেঠকে সরানো যেত না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প নেই।’ এখানেই থেমে যাননি তিনি। শুভেন্দুর নাম না করে তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেও আক্রমণ করেন। বলেন, ‘কিছু সুবিধাবাদী গান্ধীর হত্যাকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন। মানুষ তাঁদের ক্ষমা করবে না। নির্বাচনের ময়দানেই তাঁদের জবাব দেবে।’
আর ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘ধান্দাবাজির জন্য, নাকি জেলে যাওয়ার ভয়, ঠিক কী কারণে শুভেন্দু দল ছেড়েছেন, তা ভবিযৎ বলবে। এখানে সভা করতে আসার পথে কোলাঘাটে যখন ঢুকেছি, তখনই বুঝে গিয়েছি, আমরা বেঁচে গিয়েছি। শুভেন্দু চলে যাওয়ায় রাজ্যের সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা খুবই খুশি।’ যদিও রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ভাবে শুভেন্দুকে আক্রমণ করার অর্থ হল, পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারছে না তৃণমূল। এ কথা ঠিক, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর তো বটেই, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে মালদা, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুর, কোচবিহারেও শুভেন্দুর যত অনুগামী রয়েছেন, তাঁরা সত্যিই যদি এককাট্টা হন, তা যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই নির্বাচনের ময়দানে ভয়ের হতে পারে।